জঙ্গিবাদঃ শেখ হাসিনা ভিতরের শত্রু- বাইরের শত্রু
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ- লন্ডন থেকে
বেশ কিছুদিন থেকেই মুক্তমনা, ব্লগার, ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত ইত্যাদি নামের তকমায় বাংলাদেশে একের পর এক হত্যাকান্ড চলছিলো। হত্যাকান্ডগুলো ঘটার পর মার্কিনীভিত্তিক সাইট অনলাইন থেকে এসব হত্যাকান্ডের স্বীকারোক্তি বা দায় জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সেই সব হত্যাকান্ডের ব্যাপারে আইএস এর সম্পৃক্ততা শুধু নাকচই নয়, বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রে আইএস এর অস্তিত্ব স্বীকার করা হচ্ছিলোনা। শেখ হাসিনার সরকারের তরফ থেকে এই সিগন্যাল আইএসএস এর মুরুব্বীরাও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলো- ধরেই নেয়া যায়। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি এবং ভারতীয় শক্তি আইএসের আড়ালে জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে- সেটা বার বার সিগন্যাল ডিপ্লোম্যাটিক আলোচনাতেই কেবল নয়, প্রকাশ্যে বিবৃতিতে দিয়ে আসছিলো। আবার সরকারের কতিপয় মন্ত্রী যেভাবে মাদ্রাসা কেন্দ্রিক জঙ্গিবাদকে দায়ী করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ব্যস্ত, ঠিক সেখানে শেখ হাসিনার সরকারের একেবারে ভিতরের অংশ এই মতের সাথে একমত নয়, যেমন নয় পেন্টাগন এবং নয়াদিল্লী ও ও ব্রিটেনের এমআইসিক্স। আবার ভারতীয় গোয়েন্দা র- এর দক্ষিণ দক্ষিণ ব্লক আর ওয়াশিংটন(পেন্টাগনের লবি নয়) আর ব্রিটিশ সোয়াত- জঙ্গিবাদের সাথে মাদ্রাসাকে সম্পৃক্ততা বড় করে দেখছেন বা দেখাতে ব্যস্ত। শেখ হাসিনার ইনার লবি, পেন্টাগন, নয়াদিল্লী, এমআইসিক্স- এর বক্তব্য দুইশ বছরের উপরের পুরনো মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করেনা। গোয়েন্দা খেলার ও চালের জগতে কাউকে না কাউকেতো হারতেই হবে- তার খেসারতও দিতে হয় কঠোর ও ভয়াবহভাবে। বাংলাদেশ এখন সেই খেলার নির্মম ট্র্যাজেডির গল্পের উপাখ্যান শুধু নয়, বাস্তব এক পরিণত হতে চলেছে।
০২) বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এদেশে তিন স্তরের বা ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পৃষ্টপোষকতা চলছে। যে পৃষ্টপোষকতা অস্পৃশ্যতা ও ভেতরের কঠিণ শক্তির কাছে সরকারও অসহায় বা জিম্মি অথবা ক্ষমতার স্বাদ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্যে লাভ এন্ড ওয়ার- সব কিছুই হালাল- এমন নীতিতে চলতে অভ্যস্থ।
ক) তিন স্তরের জঙ্গিবাদ বা সমর্থকদের মধ্যে বলা হচ্ছে জামায়াত-বিএনপি জঙ্গিবাদ উস্কে দিচ্ছে।বিশেষ করে ক্ষেত্র বা এভিডেন্স হিসেবে ১৯৭১ সালের অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধকে পটভুমি ও ক্ষেত্র হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই ষ্ট্রং এভিডেন্সের উপস্থিতিহেতু আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনা স্বচ্ছন্দে জামায়াত-বিএনপিকে জঙ্গিবাদের পৃষ্টপোষক, আর তা প্রমাণ করতে দোষের রাজনীতি নিয়ে আইএসএস এর উপস্থিতি দৃশ্যমান ঢাকতে জামায়াত-বিএনপিকে সামনে রেখে তীর-বন্দুক চালাচ্ছেন। দৃশ্যমান এবং সংগঠিত ঘটনাগুলো সরকারি বক্তব্যে বিএনপি-জামায়াত প্রথম ধাপের জঙ্গিবাদের সমর্থক ও আমদানীতে ব্যস্ত। যেকারণে বিগত দশ বছরের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম ও ঘটনাগুলোর সাথে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির নাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া সত্যেও কোন সরকারই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে গোয়েন্দা ভিজিল্যান্স বা রিফর্ম কার্যক্রম সম্বন্ধে ভাবতেও পারেনি। একেবারে রাজধানীর হার্টের মধ্যে যখন আঘাত করলো, তখন কেবল টনক নড়লো।
খ) দ্বিতীয় ধাপের জঙ্গিবাদের সমর্থক ও পৃষ্টপোষক যদি আমরা দেখি, একটু সরকারের অস্থির কার্যক্রমের আলোকে, সহজেই চোখে পড়ে, আর সেটা বিএনপি, জামায়াত এর যারা আওয়ামীলীগে আশ্রিত এবং আওয়ামীলীগের ভেতরের নতুন বা সংস্কারপন্থীগ্রুপের বা আশ্রিত যে অংশটি- যাদেরকে ধরা যায়না, ছোয়া যায়না- এমন নিরাপদ এক শক্তিশালী সংস্কার গ্রুপ পশ্চিমা কানেকশনের জোরে জঙ্গিবাদ উস্কে দিচ্ছে বাংলাদেশে। যারা সরকারের ভেতরের লোক অথচ পশ্চিমাদের চোখে এরা অনেক প্রিয় ও কাছের এবং বিশ্বাসযোগ্য গণতন্ত্রী হিসেবে খ্যাত। এদের পৃষ্টপোষকতায় জঙ্গিবাদ এখন ছোবল মারছে বাংলাদেশে ব্যাপকহারে- এরা পশ্চিমা শক্তি ও ভারতীয় শক্তিকে বাংলাদেশে ইন্টারভেন করার আমদানীতে অগ্রসেনার কাজ করছে। এই ইন্টারভেনশন হবে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক, কোন কোন ক্ষেত্রে সহযোগিতার আড়ালে সামরিক ইন্টারভেনশন বা জঙ্গিবাদ দমনে সহযোগিতা। কারণ বাংলাদেশের পুলিশ, অধাসামরিক ও সেনাবাহিনী আধুনিক এই জঙ্গিবাদ বা আইএসএস দমনে অভ্যস্থ নয়-সহযোগিতা প্রয়োজন।এই শক্তিশালী গ্রুপ কিন্তু উভয় দলের নেত্রীর নেতৃত্ব বিরোধী- কিন্তু সেটা প্রকাশিত নয়, অপ্রকাশিত। যেকোন সময় ফুসে উঠবে- শুধু সময়ের অপেক্ষা।সেজন্যে চাই অস্থির রাজনীতি ও অস্থির সময়।
গ) ভারতীয় উলফা, আফগানিস্তানের তালেবান, সিরিয়ার আইএসএস, ইরাকের আইএসএস- এখন পশ্চিমাদের তাড়া খেয়ে নিজ নিজ দেশ থেকে ছড়িয়ে বাংলাদেশের ভুমিকে নিরাপদ ও উর্বর মনে করছে। এদের সহযোগি এদেশের প্রতিষ্ঠিত ফ্রন্ট লাইনের সুযোগ সন্ধানী জ্ঞানী, এক্টিভিস্ট, রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন- যারা আওয়ামীলীগকে দীর্ঘদিন থেকে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির সহায়ক এবং সেক্যুলার রাজনীতির সহায়ক হিসেবে প্রচার করছিলো সুশৃঙ্খলভাবে।তারা যেমন আওয়ামীলীগ সরকারের মিত্র, একইভাবে মিডিয়ারও মিত্র, সুশীল সমাজেরও মিত্র। এরা ছদ্মবেশী নয়। ভাসমানও নয়। কারণ এরা উচ্চ শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, অর্থনীতির বিশ্লেষক, রাজনীতি কর্মকান্ডের সংগঠক, আবার দক্ষিণ এশিয়ার সেভেন সিস্টারের আপ-রাইজিং এর বিরোধী ভেতর থেকে, রাজনৈতিক কারণে মোটিভেটেড।
৩) বিশ্ব রাজনীতির ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও কূটনীতির চালে বঙ্গোপসাগর, কক্সবাজার(আরাকান-মিয়ানমারের অংশে)বান্দরবন, সেন্টমার্টিন নিঝুম দ্বীপ- নয়া অদৃশ্য এক রাজনীতির সূক্ষ্ম খেলা্র টার্গেট। এই খেলায় নয়াদিল্লী, গণচীন, জাপান, মায়ানমার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। আর এই তিন বিশেষ অঞ্চলের রাজনীতির সাংগঠনিক সুবিধার জন্যে প্রয়োজন সামনে থাকা শেখ হাসিনার সরকারের। শেখ হাসিনা না চাইলে বিকল্প চয়েসের রাজনীতিও ড্রেস রিহার্সাল হচ্ছে দেশে ঘন ঘন।সেটাও একটা কারণ। এই রাজনীতিতে খালেদা জিয়া আসলেও সামনে থাকতে হবে। কারণ এই ছক এখন বাংলাদেশ ভুল করে হউক, আর সজ্ঞানে ফায়দা উঠানোর জন্যে হউক, শরিক হয়ে গিয়েছে। যেখান থেকে পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। কারণ পেছনে ফেরা মানেই এই তিন অঞ্চলে চরম অশান্তি- যা বাংলাদেশ এই মুহুর্তে সামাল দিতে প্রস্তুত নয়। এখানে যেমন অর্থনীতি জড়িত, তেমনি জড়িত রাজনীতি, একই সাথে সামরিক অবস্থাও জড়িত। ৬২ সালের ব্রিটিশের দ্বারা ইউনেস্কোর রিপোর্টের পর থেকে যে চাল এই তিন অঞ্চল কে কেন্দ্র করে দানা বেধেছিলো, ধীরে ধীরে আজ তা ভারত, চীন, মার্কিনীদের নিজেদের প্রতিযোগীতার ক্ষেত্র হিসেবে উর্বর এক ক্ষেত্র হিসেবে সামনে চলে এসেছে। এই খেলায় কোন কোন ক্ষেত্রে চরম বৈরিতা সত্যেও একে অন্যের সাথে পার্টনারশিপের ও অর্থনৈতিক সমঝোতার রাজনীতি ও কূটনৈতিক খেলা দৃশ্যপটে মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
জঙ্গিবাদ আছে আবার জঙ্গিবাদ নেই, আইএসেস আছে, আইএস নেই- এমন রাজনীতির চালে এখন শেখ হাসিনার সরকার অস্থির করার নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এতে আরো হামলা,আরো প্রাণহানি হবে। বলা হচ্ছে সিকিম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই রাজনীতির খেলা বুঝতে হলে সিকিম নয়, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, পাকিস্তানের দিকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকাতে হবে।সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধু মাত্র আইএসএস ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক ফ্রন্টের আফটার ম্যাথের খেলা নিয়ে ভাবতে হবে।হাসিনা সরকারের ভিতরের ও বাইরের এই শত্রুদের ডিপ্লোম্যাটিক কায়দায় ফেস করে আইএসএস বিরোধী কঠিণ জাতীয় ঐক্যের সঠিক রাজনীতির সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়তে না পারলে- বাংলাদেশ আইএসএসের নিরাপদ উর্বর চর্চার ও গিনিপিগ হিসেবে পরিণত হবে সন্দেহ নাই।এখন আর সন্দেহ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করলে হবেনা, সঠিক একশন নিতে হবে।
7th July 2016, London.