বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা এবং ভারত তার বন্ধুপ্রতীম শাসকদলকেই ক্ষমতায় পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চায়-টাইমস অব ইন্ডিয়া

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা এবং ভারত তার বন্ধুপ্রতীম শাসকদলকেই ক্ষমতায় পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চায়-টাইমস অব ইন্ডিয়া

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন সহিংসতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং চায়নিজ কম্যুনিস্ট পার্টি স্কুলে বর্ডার ডিফেন্স ও এগ্রিম্যান্ট নিয়ে বক্তৃতা করছিলেন, তখনি ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনার ঐকান্তিকভাবে এবং অত্যন্ত আগ্রহনিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির দুই দিকপাল শেখ হাসিনা ওয়াজেদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে চলমান তিক্ততা সরিয়ে ডায়ালগ শুরু করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, “যাতে শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচন ও ডেমোক্রেটিক পন্থায় সরকারের পরিবর্তন বা ট্রানজিশনের নিশ্চিত ব্যবস্থা চালু থাকে।“

 

টাইমস অব ইন্ডিয়া এই পর্যন্তই প্রতিবেদন প্রকাশ করেই থেমে থাকেনি। অত্যন্ত যুক্তি ও তথ্য নির্ভরভাবে ইন্ডিয়ান গভর্ণম্যান্টের বাংলাদেশ নিয়ে স্ট্যান্ড এবং তার বিপরীতে বর্তমানে ইউএস ডিপ্লোম্যাট ড্যান মজীনার অবস্থান অত্যন্ত খোলামেলা ভাবে এই প্রতিবেদনে মিঃ সুবীর ভৌমিক তুলে ধরেছেন।এতে ইন্ডিয়া ও আমেরিকা এবং একই সাথে চায়নিজ সরকারের ভেতরকার দৃষ্ঠিভঙ্গী ইন্ডিয়ান সরকারের দৃষ্টিতে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। প্রিয় পাঠক, একটু ভালো করে লক্ষ করে দেখুন, আমাদের রাজনীতি ও দুই নেত্রীর নেতৃত্ব নিয়ে উভয় দেশ ও তৃতীয় দেশ চায়নার মনোভাব এবং তাদের কৌশলী খেলা।

টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, হাসিনা ওয়াজেদ ফাইনালি ব্রোক দ্য আইস, যেখানে তিনি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, এবং সংলাপের মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের আহবান জানিয়েছেন। হাসিনা ওয়াজেদ তার টেলিফোনে খালেদা জিয়াকে তার প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারে শরিক হয়ে বিএনপি নেত্রীকে আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনের সুন্দর পরিবেশ তৈরির আহবানের বিপরীতে খালেদা জিয়া ৩৭ মিনিটের টেলিফোন কলে উদ্যত কথোপকথন প্রকাশ এবং ৬০ ঘন্টার হরতাল অক্ষুণ্ণ রেখে মূলত সারা জাতির ফিলিংস এর কোন তোয়াক্কাই করলেননা।

টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের রিপোর্টে আরো লিখেছে, বিএনপি নেত্রী তার নিউট্রাল তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে অটল থাকলেন পক্ষান্তরে হাসিনা সর্বদলীয় সরকারের বিএনপি নেত্রীকে শরীক হতে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানালেন এবং বিএনপি নেত্রীর নিউট্রাল কেয়ারটেকার গভর্ণম্যান্টের দাবী সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে যেহেতু ইতিমধ্যে বাতিল ও অকার্যকর হয়ে গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনা যে সম্ভব নয় এবং সংবিধান সম্মত নয়, সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকলেন।বিএনপি নেত্রী তার সহিংস আন্দোলন, আগুনের খেলা অক্ষুন্ন রেখে আর রাজনৈতিক “রিকনসিলিয়েশনের” এই সুযোগ হাত ছাড়া করলেন। দুই নেত্রীর এই টেলিফোন আলাপ পরবর্তীতে বাংলাদেশের টেলিভিশন স্যাটেলাইট এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, যা সমগ্র বিশ্বের বাঙালি ও ঢাকার রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করেন-সকলের জন্যই ভাবনার বিষয় হয়ে যায়।

মেইন সাইডশোঃভারত ও আমেরিকার ডিপ্লোম্যাসি-

টাইমস অব ইন্ডিয়া এখানে এসে আরো লিখেছে, ঢাকার রাজনীতির অভ্যন্তরীণ প্রধান ও সাইডবারের শো-যা ঢাকার পত্র-পত্রিকা ও টকশোগুলোতে সকলেই বলাবলি করছে, “বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও আমেরিকা মূলত একই অবস্থানে আছে।“ বিশেষকরে ঢাকার মার্কিন ডিপ্লোম্যাট ড্যান মজীনা যখন হঠাত করে বলা নেই কওয়া নেই, নিজ উদ্যোগে ঢাকা থেকে দিল্লী উড়ে এসে দিল্লীর হাই অফিসিয়ালদের সাথে সাক্ষাত করে ফিরে যান, তখন ঢাকার পত্র-পত্রিকা উপরোক্ত মনোভাব বা অবস্থান কোট করে বসলে, ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এবং দূতাবাস অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়।ভারতীয় দূতাবাসের সাথে মিনিষ্ট্রি অব এক্সটারনাল এফেয়ার্স তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া জানায়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় এক ডিপ্লোম্যাট তখনি সংবাদ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এই বলে যে, “ঢাকা প্রশ্নে নয়া দিল্লী এবং যুক্তরাষ্ট্র একই অবস্থানে নেই।“

গোপনে ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটের স্বীকারোক্তি-

নয়াদিল্লীর ডিপ্লোম্যাট ইন্ডিয়ার টাইমসের সাংবাদিকের কাছে অফ দ্য রেকর্ডে স্বীকার করেছেন এই বলে যে, নয়া দিল্লীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, “ড্যান মজীনার এক্ট মূলত: বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির একজন মেম্বারের মতো,” যিনি যেকোন ভাবেই বিএনপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে যথাসাধ্য প্রস্তুত। খালেদা জিয়া চাচ্ছেন স্ট্রীট ভায়োল্যান্স, নৈরাজ্য আর ক্রমাগত রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে হাসিনার সরকারকে ফেলে দিতে চান। খালেদা জিয়া ইউ এস-এর ডিপ্লোম্যাটিক বিশেষকরে ড্যান মজীনার মাধ্যমে এবং কট্রর রেডিক্যাল ইসলামিক পন্থী জামায়াতে ইসলামীর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে হাসিনার সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসতে উদগ্রীব খালেদা জিয়া।

আফটার ম্যাথ-

টাইমস অব ইন্ডিয়া আরো লিখেছে, ড্যান মজীনার নয়াদিল্লী থেকে ঢাকা ফিরে যাওয়ার পর ঢাকার পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যখন সংবাদ করে যে ঢাকা প্রশ্নে নয়া দিল্লী এবং যুক্তরাষ্ট্র একই পেইজে, তখনি নয়াদিল্লীর বুঝতে বাকী থাকেনা, “এটাতো যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্বমুভ এবং ড্যান মজীনার মুভেই সংবাদ মাধ্যমে এমন সংবাদ প্রচারিত হয়েছে।“ ইন্ডিয়া টাইমস ডিপ্লোম্যাট থ্রোতে আরো লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজ ইন্টারেস্টে ঢাকার সরকারের পরিবর্তন করে রেডিক্যাল ইসলামিক দল জামায়াতের সহায়তায় বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে চায়, তাহলে “ভারতের পরীক্ষিত এবং বহু দশকের পুরনো বন্ধু আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় রাখতে ও গণতান্ত্রিক ট্রানজিশনের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে পেছনে সমর্থন নিয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক” এই কারণে যে, ঢাকার হাসিনার সরকার ইন্ডিয়াকে যেভাবে বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে সহযোগিতা করে উজাড় করে সব দিয়েছে, পুরনো এই বন্ধুকে তাই ক্ষমতায় দেখা নয়াদিল্লীর স্বার্থের অনুকূল বৈ অন্য কিছুই হবেনা। ইন্ডিয়া টাইমস এখানে এসে লিখেছে, ঢাকার প্রশ্নে ওয়াশিংটনের যদি চয়েস থেকে থাকে, “নয়া দিল্লীর কেন নয়,” পুরনো বন্ধু শাসকদল আওয়ামীলীগের প্রতি? এই চয়েস থাকাটাই “নয়াদিল্লীর রাইট চয়েস হওয়া উচিত নয়কি ?”

টাইমস অব ইন্ডিয়া এখানে এসে লিখেছে, ওয়াশিংটন মনে করছে ঢাকার প্রশ্নে বেইজিং এর “ইনরোড স্টপ” করে দেয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে ফিরিয়ে আনা দরকার। সেখানে নয়াদিল্লীর মুখ্যত রিজার্ভেশন রয়েছে বিএনপির প্রতি। বিগত ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের কার্যক্রম প্রশ্নে নয়াদিল্লি এখনো সংশয় ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। নয়াদিল্লীর আরো সব চাইতে বড় দুশ্চিন্তার যে কারণ আর তাহলো, কট্টর পন্থী জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামীকে নিয়ে।

দিল্লীর ডিপ্লোম্যাট স্বীকার করেছেন, “দিল্লীর গুড রিজন রয়েছে, এই অঞ্চলের স্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করার।“ কেননা নয়াদিল্লী মনে করছে, বিগত জোট সরকারের নেতৃত্বে র্যািডিক্যাল ইসলামিক দল জামায়াতের নের্তত্বে জঙ্গি তৎপরতা ওয়াশিংটন ওভার সী করেছে, যা নয়াদিল্লীর সাথে উভয় দেশের ওয়ার এগেনিষ্ট অন টেরোরিজমের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্থ করেছিলো এবং জামায়াত-হেফাজতের খালেদার মাধ্যমে ফিরে আসা মানেই ওয়ার এগেনিষ্ট টেরোরিজমের কার্যক্রম ভেস্তে যাওয়া।

চায়নার উদ্যোগ-
চায়নিজ এম্বাসাডার লি জুনের এক সপ্তাহের ভিতর তিনবারের মতো ঢাকার রাজনীতি প্রশ্নে ষ্টেটম্যান্ট, যা দিল্লী ও ওয়াশিংটনের টাই প্রশ্নে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্রাইসিস ও সহিংসতা বন্ধে সংলাপ ইস্যুতে চায়নিজ উদ্যোগকে ঢাকার ভারতীয় ডিপ্লোম্যাট দেখছেন কনস্ট্রাকটিভ হিসেবে।এই প্রথমবারের মতো কোণ চায়নিজ এম্বাসাডার ঢাকার প্রশ্নে তিনবারের মতো উদ্যোগ নিয়ে বিবৃতি দিলেন, যেখানে তিনি অল পার্টির সংলাপ এবং “উভয় দলের” তার ভাষায় “বন্ধুদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনের উদ্যোগের কথা বললেন।“

বিহাইন্ড দ্য চায়নিজ সিনারীও-

চায়না চাচ্ছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সোনাদিয়া দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে, যা ভারত তার স্বার্থের প্রশ্নে তেমন কোন বাঁধা হিসেবে দেখছেনা। বরং চায়নার এই উদ্যোগে নয়াদিল্লী দেখছে তার নর্থইষ্ট এলাকায় বেটার এক্সেস হিসেবে।নয়াদিল্লী চায়নার এই উদ্যোগের সাথে তার নর্থইষ্টে যোগাযোগের বেটার এক্সেস হিসেবেই শুধু দেখছেনা, বরং মনে করছে পুরো এই প্রজেক্টটির ফলে বাংলাদেশ-চায়না-ভারত-মায়ানমার এর ব্যবসা, ইনভেস্টম্যান্ট, কমার্স এর ক্ষেত্রে ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হবে বলে বিশ্বাস করে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া আরো লিখেছে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি- নয়াদিল্লীকে তার এই ইষ্ট এবং নর্থইষ্ট অঞ্চল নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে। এহেন অবস্থায় নয়াদিল্লীর পক্ষে কোন উগ্র কিংবা অস্থিতিশীল সরকার ও রাজনৈতিক অবস্থা কিছুতেই বহন করা সম্ভব নয়।নয়াদিল্লী এখানে দেখছে বিগত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় তার সীমান্তবর্তী ইষ্ট ও নর্থইষ্ট অঞ্চলে যে ভয়াবহ অবস্থা, যুদ্ধাবস্থা, আর জনতার স্রোতে যে ভয়াল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো, যখন ওয়াশিংটন নেভাল ইন্টারভেনশন করতে যাচ্ছিলো তার সপ্তম নৌঘাঁটির মাধ্যমে-নয়াদিল্লী কিছুতেই সেই ভয়াল অবস্থার পুনরাবৃত্তি করতে দিতে চায়না।

নয়াদিল্লীর একমাত্র বিকল্প-

কাউকে একচ্ছত্র ক্ষমতার নাটাইয়ের দড়ি হাতে নিয়ে নাচাতে নয়, বরং নয়াদিল্লীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিকের ভাষায়, “befriending China to balance off the US and vice versa is a realistic option for India.”

এখন দেখার বিষয় ঢাকার আগামী দিনের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ কোনদিকে প্রবাহিত হয়, যেখানে নির্ভর করছে নয়াদিল্লীর উপরোক্ত একমাত্র বিকল্প অপশনের কার্যকর ডিপ্লোম্যাসী।

(টাইমস অব ইন্ডিয়া ১লা নভেম্বর ইন্ডিয়ান সময় ১২.০৮ মিঃ প্রকাশিত সুবীর ভৌমিকের বিশেষ প্রতিবেদন থেকে)

১লা নভেম্বর ২০১৩
Salim932@googlemail.com

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *