উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় মার্কিনীদের নেতৃত্বে যৌথ বা ন্যাটো বাহিনী যখন ইরাকের মাটিতে ও ইরাকের নানা স্থাপনা দখল করছিলো একের পর এক, তখনো ইরাকের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনে সাদ্দামের ডেপুটি এবং স্বয়ং সাদ্দাম নানা হুমকি-ধমকি ও হাস্যকর বক্তব্য বিশ্ববাসীকে ধোঁকা ও ধাঁধায় ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলো, আর এক শ্রেণীর তার তাবেদার তখনো সাদ্দামের ঐ ফালতু হাম্বী-তম্বি আর রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীর উদ্ভট বীরত্বের কাহিনী প্রচারে বাহবা নেয়ার ও আসর মাতিয়ে রাখার হীন চেষ্টা করছিলো, শ্লোগান, মিছিল দিয়ে গলা ফাটাচ্ছিলো।
আর ঐদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী ইরাক আস্তে আস্তে কব্জা করে ফেলেছিলো। তার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। একই চিত্র আমরা লিবিয়ায় গাদ্দাফী ও তার ছেলেদের কাছে থেকে দেখছিলাম।ন্যাটো বাহিনী যখন গাদ্দাফীর কম্পাউন্ডে বোমা ফেলে গাদ্দাফীর সন্তান ও কর্মচারীদের হত্যা করছিলো, ঠিক তার কিছুক্ষণ পরে গাদ্দাফী যেন গর্তের ভিতর থেকে উদয় হয়ে নিজ নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে বক্তব্য সম্প্রচার করে কি হাস্যকর ও ভয়ানক এক আত্মঘাতী খেলা খেলেছিলেন, বিশ্ববাসী সহ তাবৎ জনগণ সকলেরই ভালো করে জানা আছে। গাদ্দাফী পুত্র সাঈফও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে উদ্ভট সব বক্তব্য দিয়ে নিজ সাপোর্টারদের উদ্দীপ্ত করে রাখার পাশাপাশি বোমার নিষ্ঠুর আঘাতে নির্বিচারে জীবন দানের দিকেই টেলে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য উপরোক্ত এই দুই শাসক কিন্তু যুগের পর যুগ নিজ দেশে প্রচণ্ড ক্ষমতা, দাপট, আর প্রতাপের সাথে নিজ জনগণকে শাসন করেছিলেন। নিজ দেশ ও জনগণের কাছে নিজেদেরকে ভাগ্য দেবতার আসনে বসানোর জন্য নিরন্তর চেষ্টা করেছিলেন, সফলও হয়েছিলেন। উভয় শাসক এতো বেপরোয়া ও উদ্যত ভাবে দেশ শাসন করেছিলেন, গণতন্ত্রের নাম শুনলে ভীষণ রেগে যেতেন, বিরুদ্ধ মত কিছুতেই বরদাশত করতে পারতেননা। কেউ বিরোধী হলে নানা নির্যাতন কিংবা হত্যা অথবা নির্বাসন অবধারিত ছিলো। নিজ দেশে সাদ্দাম হোসেন নিজের প্রতিকৃতির বিশাল বিশাল মূর্তি স্থাপন করেছিলেন, সর্বত্রই সাদ্দামের ছবি শোভা পেতো। আর গাদ্দাফীতো অনেকটা ডিজিটালাইজড স্টাইলে নিজের একচ্ছত্র দেবতারুপী হিরোইজিমের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেন তিনিই সব কাজের কাজী। কাজী আনোয়ার হোসেনের গোয়েন্দা কাহিনীর থ্রিলার স্টোরিকেও গাদ্দাফীর চালচলন ও বেশ-ভূষায় হার মানিয়েছিলো। দস্যু বনহুর রূপী রূপকথার জীবন্ত নায়কের মতো দুর্দণ্ড প্রতাপের সাথে এই দুই শাসক দুটি মুসলিম দেশ শাসন করেছিলেন, অথচ নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, অত্যন্ত কঠোর ও অপমানজকভাবে দুজনকেও বিদায় নিতে হয়েছিলো, যা ইতিহাসের ট্র্যাজিক অংশ হয়ে আছে।
ঠিক তার বিপরীতে আমাদের দেশেও ১৯৯০ সালে কথিত সামরিক স্বৈরাচার হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ নয় বছর দুর্দন্ড প্রতাপের সাথে ও নানা ছলনা-কলনা ও কৌশলের সাথে দেশ পরিচালনার পরেও, ছাত্র-শ্রমিক-রাজনৈতিক দল সমূহের যৌথ গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পার্থক্য এখানে, সাদ্দাম-গাদ্দাফীর মতো এরশাদের ভাগ্য বরণ করতে হয়নি, বরং বলা যায়, এখনো তিনি আমাদের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে দুই নেত্রীর নাচের পুতুল হয়ে অনেকটা কুশলী খেলোয়াড়ের মতো যেমনি নাচাও, তেমনি নাচি-পুতুলের কি দুষ আছে বলো- এমন ভূমিকায় হাজির হয়ে আছেন।
তিনটি দেশের ভিন্ন তিনটি প্রেক্ষাপট এখানে আলোকপাত করলাম, এই কারণে যে, আমাদের দেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার দাপটে অন্ধ অহমিকা আর বালখিল্যসূলভ অরাজনৈতিক আচরণ, বক্তব্য আর হরিলুটের শাসনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কেন জানি মনে হচ্ছে, উদ্ধৃত তিনটি রাজনৈতিক ট্র্যাজিক অথচ রাজনীতি বিজ্ঞানের অপরিহার্য নিয়তির দিকেই জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে ক্ষমতাসীনরা নিজেদেরকে নিয়ে যাচ্ছে, এ যেন সিরাজের পতনে ঘষেটি বেগম কিংবা মীরজাফর আলী খানের কুঠিল ষড়যন্ত্রের সেই তথ্যের দিকে আলোকপাত রেখা নিক্ষেপ করে সূরা নাই পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকি, কিংবা আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়-ক্ষুদিরামের সেই করুণ গানের রোদনে বাঁশী বাজিয়ে চলার দৃশ্যের অবতারণা, যেখানে ক্ষমতাসীনরা ধরেই নিয়েছে, ডঃ তালুকদার মনিরুজ্জামানের ভাষায়,যেন তেন ভাবে নির্বাচন কিংবা আরো কিছু স্পেস ইন্টারভেল(সেটা হতে পারে দুই বছর কাল-নিজেদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য)- এদের কার্যকলাপ, বক্তব্য, বিবৃতি এবং উদ্ধত ও মারমুখী মনোভাব সেদিকটাই যেন ইঙ্গিত করে।
আওয়ামীলীগের নেতা আর নেত্রীদের বক্তব্য কোথায় যেন ঐ সাদ্দাম-গাদ্দাফী, এরশাদ আর তাদের দোসরদের সাথে কাকতালীয় ভাবে মিলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক আওয়ামীলীগের মন্ত্রী ও সেক্রেটারি সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য ঐ সাদ্দামীয় আর গাদ্দাফীয়, এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি মওদূদের স্টাইলের ব্লাফের মতো মনে হচ্ছে। ৯০ সালে এরশাদ যেদিন পদত্যাগ করেন, ঐদিন পর্যন্ত এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি মওদূদ সংবিধানের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে এরশাদের বক্তব্যের আলোকে বিটিভির মাধ্যমে বুঝানোর ও ব্লাফ মারার কথা জাতির আজো ভালো করেই মনে আছে। সাদ্দাম, গাদ্দাফী, কিংবা কথিত স্বৈরাচারীরা যুগে যুগে এরকম আজব আজব প্রোপাগান্ডার বাক্স-পেটরা সাজিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করেও শেষ রক্ষা হয়নি।
আওয়ামীলীগ লুটপাট, ছাত্রলীগ-টেন্ডার লীগের গুণ্ডামির সাথে হেফাজত ইস্যু, ইউনুস ইস্যু, এমনিতেই নাকাল, সেটা যেমন দেশে বিদেশে, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনে।তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে উদ্ভট এক প্রচারণা ডিজিটাল শ্লোগানের সরকারের এনালগ, মান্ধাতার আমলের, পুরনো, বস্তা-পচা মরা লাশের স্টাইলের বিলবোর্ড প্রচারণা। আসলেতো প্রচারণা নয়, সবই ধান্দাবাজী, কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নয়া এক কৌশলী খেলা। নাহলে জুতা আবিষ্কারের মতো ঐ রাজ্যে পানি ঢালা, ধূলি উড়ানো আহাম্মকী তুঘলুকী পরিকল্পনা যে বা যারা দিয়েছে, তাদের সহ আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা ও রিং মেকার নামধারীরা পুরনো ও অকর্মণ্য- বিলবোর্ড প্রচারণাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আজকেও বিবিসির অনলাইনে ঢাকার সাধারণ লোকদের উদ্ধৃতি দিয়ে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে সাধারণ মানুষেরা পর্যন্ত সরকারের এই বিলবোর্ড নামক লুটপাটের রামরাজত্বের প্রচারণা ভালোভাবে নেয়নি, যেমন-আলেয়া পারভিন নামের এক ঢাকাবাসী বলেছেন, প্রথমে বুঝতে পারিনি কী হচ্ছে। কেনই বা এগুলো লাগানো হয়েছে। পরে বুঝতে পারলাম এগুলো আওয়ামী লীগের সফলতার প্রচার। বিষয়টি আমার বেশ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।” -বিবিসি অনলাইন।
পক্ষান্তরে তাহমিদ হক নামের গ্রামীনফোনের কর্পোরেট কমিউনিকেশনস প্রধান বলেছেন, দক্ষতা ও পরিকল্পিত প্রচারণার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানানো হলে সেক্ষেত্রে আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত থাকতাম”-বিবিসি অনলাইন ।
আসলে বিশৃঙ্খলা ও উদ্ভট পরিকল্পনাকারী এইগুলোকে দল থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করলে দল এবং জাতি অনেক উপকৃত হবে।কেননা, মাত্র কিছুদিন আগেও এরা দেখলো, বরিশালের মেয়র হিরণ অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় ও ভালো কাজ করা স্বত্বেও, এই তথাকথিত আহামরি রকমের বিলবোর্ড প্রচারণা করেও মাঠে মারা গেছে, তারপরেও যারা সরকারকে এ রকম উদ্ভট প্রচারণার কৌশল দিয়ে টাকা লুট করে নিয়েছে, এদের সকলেরই বিচার করা উচিত জনশৃঙ্খলা ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যে। সরকারের প্রধান ব্যক্তির খুনটুসি বক্তব্য, অরাজনৈতিক আচরণ দলের ভিতরেও সাধারণ কর্মীরাও যেমন অসন্তুষ্ট, সাধারণ জনগণও ত্যক্ত-বিরক্ত।সরকার তা জানেনা তা নয়। জেনে-শুনেই এখন পরাজয়ের ভয়ে আকাম-কুকাম করে যাচ্ছে। স্বচ্ছ নির্বাচন করার মতো মন-মানসিকতা এখন আর ওদের নেই। এরা জেনে গেছে, পাবলিকের মাইর খাওয়া ছাড়া আর রক্ষা নাই। এরা জানে ৩০ লক্ষ শেয়ার কেলেঙ্কারিতে নিঃস্ব গরীব জনগণ হাতের কাছে পাইলে আর ছাড়বেনা– এমন ডর-ভয় থেকেই এরা এখন উল্টা-পাল্টা শুরু করে দিয়েছে। নাহলে শোধরানোর মতো সময় হাতে পেয়েও এরা তার সদ্ব্যবহার করেনি, বরং পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও যেন তেনভাবে উত্তপ্ত করার খেলায় মেতে উঠেছে।
নির্বাচন কমিশনের হঠাৎ আজগুবি কর্মকাণ্ড(নিজেদের ক্ষমতা কমানোর মতো), সরকারের অসমঝোতা মূলক আচরণ, আর মন্ত্রী, এমপিদের বেপরোয়া আর উদ্যতভাব কিন্তু আগামী নির্বাচনের ছকের কথা বলেনা। আগামী দিনের রাজনীতি যেমন আরো উত্তপ্ত হবে, একইসাথে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তালুকদার মনিরুজ্জামান যেমন করে বলেছেন, জাতি সংঘ হস্তক্ষেপ করবে, হাসিনার সরকার মূলত সে পথেই এগুচ্ছে, নিরাপদ এক্সিট রুটের স্বার্থেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান যেমন শঙ্কা করেন, ভারতের নিরপেক্ষ ভূমিকার উপর আগামী নির্বাচনের প্রভাব নির্ভর করে, একইভাবে, ভারত বিগত ৪০ বছরে যা পায়নি, হাসিনা সরকার তার সবই উজাড় করে দিয়েছে, তাই তাদের নিরপেক্ষ থাকার আশঙ্কা যেমন অনেকাংশে বাস্তবের কাছাকাছি, তথাপি উপমহাদেশের রাজনীতির একচ্ছত্র ক্যাপ্টেন্সীর মালিক ভারত অবশ্যই কোন না কোন ডিপ্লোম্যাটিক রোল প্লে করবে নিজেদের বাজারের স্বার্থেই- সে ধারনাও উড়িয়ে দেয়া যায়না। ক্রমবর্ধমান অসহিঞ্চু জটিল রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ কিন্তু আরো সংঘাত, আরো রক্তপাতের আশঙ্কার কথাই জানান দেয়।
সমঝোতা নামক অশ্বডিম্ব আষাঢ়ে গুড়ে বালি। ঈদের মতো এমন উৎসব মুখর সুন্দর পরিবেশ এমন হেলাফেলায় হাতছাড়া করা অন্য কিন্তুর জন্ম দেয়।খোদ সরকারি দলের গুণ্ডামি আর বদমাশির খেসারত মিল্কী, ক্রস ফায়ারে তারেক হত্যা- অপশাসন আর দুষ্কৃতির আস্কারাদের আড়াল করার সিগন্যাল যারা জাতিকে দিয়েছে, আর যাই হউক তাদের কাছ থেকে কস্মিনকালেও সুশাসন আশা করা যায়না। হলমার্কের জেসমিনকে শত কোটি টাকার শর্তে জামিনে মুক্তি দিয়ে আদালত পাড়ায় হস্তক্ষেপের ধূর্ত্যকারসাজি এখন জনগণ কোনভাবেই ভালো চোখে দেখেনি।
ঈদের দিন ওবায়দুল কাদেরের শানিত যুক্তির বক্তব্য প্রশংসনীয়। তবে ওবায়দুল কাদেরের এই উপলব্ধি বড় দেরিতে হয়ে গেছে। কেননা, যদিও ধারাবাহিক উন্নতি বজায় রাখার জন্য একটি সরকারের পর পর দুই টার্মে নির্বাচিত হওয়া উচিৎ হলেও আওয়ামীলীগ নামক এই মহা লুটের আর মহা দুষ্টের বিষাক্ত এই ব্যাঘ্রের হিংস্রতা থেকে এই জাতি যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হবে, ততোই জাতির মঙ্গল। বড় দেরি করে ওবায়দুল কাদেরের উপলব্ধি অবশ্য অন্য এক গন্ধের আভাস দেয়। যেমন করে দিয়েছিলেন জয়, একটু ভিন্ন মাত্রায়-সরাসরি। ওবায়দুল কাদের অতিমাত্রায় রাজনীতি ও বিশ্লেষণ মিশিয়ে সেই লোকায়িত স্বপ্নের জালের বুননের তথ্যের কথাই বলেছেন বলে মনে হচ্ছে।
কথায় কথায় খুনটুসি আর বিরক্তির উদ্রেক, আগ বাড়িয়ে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির উদ্রেক ও উসকে দেয়ার এই সংস্কৃতি থেকে এই রাষ্ট্র ও এর জনগণের রক্ষার বিকল্প চালু না করা পর্যন্ত উদ্ভট ও মস্তিষ্ক বিকৃতির এই অপরাজনীতির খেলা থেকে কবে যে মুক্তি মিলবে আল্লাহপাকই ভালো জানেন।
৮ আগস্ট ২০১৩.