নির্বাচনের সময় যতো ঘনিয়ে আসছে, আওয়ামীলীগ-বিএনপি ও নির্বাচনকামী গোষ্ঠী ও শ্রেণীর মধ্যে বাক-বিতণ্ডা ও নানা আশ্বাসমূলক নতুন নতুন কথা বলা হচ্ছে। ওবামার নির্বাচনী স্টাইলে আওয়ামীলীগ যেমন পরিবর্তনের রাজনীতির কথা মৃদু উচ্চারণের মাধ্যমে বলা শুরু করেছে, একই সাথে বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতির ছক ও চিন্তা-কৌশল প্রকাশ করে রাজনীতির মাঠে বেশ আলোড়ন তুলেছে। এর বাইরে ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দল যেমন আ স ম আবদুর রবের জাসদ সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচী, কাদের সিদ্দিকী ও ডাঃ বি চৌধুরী বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফর্ম, ডঃ কামাল হোসেনের ঐক্যের রাজনীতি, মাহমুদুর রহমান মান্নার তৃতীয় শক্তির উত্থানের রাজনীতি শহরাঞ্চলের জনগণের মধ্যে বেশ আশা ও উদ্দীপনার সূত্রপাত করেছে।
তবে তাবৎ জনগণ যেমন সেই চুয়াডাঙ্গার তশিকুল, সিলেটের শফিউর, রাজশাহীর মুকুল, রংপুরের আজিজ, টাঙ্গাইলের বদর, বরিশালের ফাইজু, ঢাকার মামুন, রাশেদ, বাশার সহ বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে মূলত বিএনপির সম্ভাব্য নতুন ধারার রাজনীতির বক্তব্য বেশ আশাব্যঞ্জক ও সাড়া ফেলে দিয়েছে। এদিক থেকে বলা যায়, বিএনপির নতুন ধারার সরকারের ফর্মুলা জনগণের ব্যাপক সমর্থন পাবে, যদি সত্যি সত্যি বিএনপি দেশ ও জনগণের জন্য এই নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। আবার পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি ও সরকার-এই ধারায় আওয়ামীলীগও বেশ এগিয়ে যেতে পারে যদি আওয়ামীলীগ সত্যিকার অর্থে নিজেদের দলীয় অহমিকা ও এখনকার ভুলগুলো শোধরাতে পারে।
মাঠে-ঘাটে এখন জনগণ পরিবর্তন যেমন চাচ্ছে, একই সাথে আমাদের রাজনৈতিক এই হানাহানি, হিংসা আর হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনৈতিক কালচার থেকে বেরিয়ে আসার আশাবাদও ব্যক্ত করছেন। জনগণ তাই বিএনপি ঘোষিত নতুন ধারার কনসেপ্টের এই রাজনীতিকে অনেকটাই আশাবাদী হয়েছেন। ইতিমধ্যে বিএনপি দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে তারেক রহমানের বক্তব্য জনগণের মধ্যে বেশ আগ্রহের সূচনা করেছে।
জনগণ এখন আর মারামারি, বারে বার হরতাল আর রাস্তা-ঘাট অবরোধ করে ধ্বংসের রাজনীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছেনা, কোন প্লাটফর্ম ও খোজে পাচ্ছেনা, মাঠের একেবারে প্রান্তিক জনগণ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, আধা-মধ্যবিত্ত, স্বল্প মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, সমাজের উঁচু তলার মানুষ, রাজনীতি করেন কর্মী সমর্থক ও নেতা সকলেই কিন্তু রাজনৈতিক এই হিংসার কালচারের পরিবর্তন চান। নানান জনের নানা মত ও পথ, তারপরেও আওয়ামীলীগ ও বিএনপিকে তারা তাদের ভরসা হিসেবে মনে করে এই দুই দলের মধ্য থেকে পরিবর্তন ও নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কালচারের নতুন ধারার সরকারের কথা বার বার উল্লেখ করেছেন।
আমাদের এই দুই দলের নেতা-নেত্রীরা যদি জনগণের মনের ভাষা বুঝে একটু আরো গণতান্ত্রিক ও উদার মনোভাব নিয়ে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের জন্য, আগামীর বাংলাদেশের পজিটিভ রাজনৈতিক পরিবেশ ও উন্নয়নের জন্য আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নেতা-নেত্রীদের মাইন্ড-সেটেরও উন্নয়ন দরকার, পরিবর্তন ও নতুন ধারার রাজনীতির লক্ষ্যে।
কেননা বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা দিনের পর দিন চালু রেখে বাংলাদেশ ও এর জনগণের জীবন-মানের উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়, সেই সাথে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে আমরা খাপ খাইয়ে চলতেও পারবোনা।
বাংলাদেশে এখন যে নির্বাচনী কালচার রয়েছে, আধিপত্য বিস্তার, পেশী শক্তি ও কালো টাকার দাপটের কাছে নতুন ধারার রাজনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে যে সব দক্ষ এক্সপার্ট ও যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে যে সব চৌকস এক্সপার্টদের আমাদের রাষ্ট্র ও নিতি-নির্ধারনী প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের কথা ভাবা হচ্ছে, উভয় দিক থেকে কিংবা তাদের এক্সপার্টিতা ব্যবহার কে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে চিন্তা আজকের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে, বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা ও টাকা ও সন্ত্রাসের ও দলীয় আধিপত্যের কাছে সেই সব এক্সপার্টদের কিছুতেই প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে জয়ী করে নিয়ে আসা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তাদের মতো অনেকেই এই নির্বাচনী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে আসবেননা।
যেমন ধরা যাক, নতুন ধারার রাজনীতি কিংবা পরিবর্তনের জন্য দলীয় নির্বাচিতদের সাথে এই মুহূর্তে আমাদের দরকার ডঃ জামিলুর রেজা, ডঃ দেবপ্রিয় ভূট্রাচার্য্য, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ডঃ কামাল হোসেন, ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস, সিরাজুল আলম খান, খুশী কবির, সুলতানা কামাল, ডঃ এমাজ উদ্দিন, তালুকদার মণিরুজ্জামান, নূরুল কবীর,নাঈমুল ইসলাম খান, ডঃ আসিফ নজরুল, আ স ম আবদুর রব (রব হয়তো জিতে আসবেন), মাহমুদুর রহমান মান্না, বি চৌধুরী, ডঃ আকবর আলী খান, এবং আরো অনেকেই আছেন (কেবল উদাহরণ হিসেবে নামগুলো বললাম, আরো অনেক দক্ষ পেশাজীবি আছেন), যাদেরকে আমরা সরকারে অংশীদারিত্ব দিয়ে তাদের পেশাদারিত্ব ও এক্সপার্টিতার সেবা নিয়ে দেশের কাজে লাগাতে হলে প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থায় কালো টাকা ও পেশী শক্তির কাছে তারা কেউই পেরে উঠবেননা, এবং দলীয় শক্তির কাছে ও টাকার কাছে তারা পরাভূত হয়ে যাবেন। তাহলে এই সব বিশেষায়িত ব্যক্তিদের সেবাকে আমরা কিভাবে দেশের কাজে লাগাতে পারি ? বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায়তো এর কোন পথই খোলা নেই। আর এই সব বিশেষায়িত লোকদের সরকারের বাইরে রেখে নতুন ধারার রাজনীতিও এগিয়ে নেয়া দুঃসাধ্য। কারণ এদের যেমন দলীয় শক্তি নেই, টাকা ও মাসলম্যানের কাছে এরা হার মানবেনই। আর সে কারণে এরাও নির্বাচনী কালচার থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছেন, যা সহজেই অনুমেয়। কেননা জোটের ভিতর ও জোটের বাইরে এমন সব নেতা ও ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় জয়ী হয়ে আসা সম্ভব নয়, অথচ পরিবর্তনের রাজনীতির জন্য তাদের অংশীদারিত্ব অনস্বীকার্য।
তত্বাবধায়কের স্থায়ী বিকল্প হিসেবে সিরাজুল আলম খান ও আ স ম আবদুর রব প্রস্তাবিত দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা বা পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ সংবিধানে চালু করতে রাতারাতি যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক যে জটিলতা কিভাবে নির্বাচন হবে ? সেটাকে রাজনৈতিক দলগুলো বরং আগে সমঝোতায় আসতে হবে তাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বা নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার চালু করতে হলে। এখানেই মূলত তাদের এসিড টেস্টে উতরে যেতে হবে, নতুবা জনগণ ভাববে, দুদলই তাদের নিয়ে চিরাচরিতভাবে আবারো খেলছে।
জনমতে এগিয়ে থাকা অগ্রবর্তী দল হিসেবে বিএনপি ঘোষণা দিতে পারে, এই সব দেশ বরেণ্য এক্সপার্টদের নির্বাচনী আসনে বিএনপি এবং তার ১৮ দলের পক্ষ থেকে কোন প্রার্থী দেয়া হবেনা। কালো টাকার শক্তিকে রুখার লক্ষ্যে বিএনপি এই সব বরেণ্য ব্যক্তিদের বিপরীতে কেউ দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে আগামীর নতুন ধারার সরকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিএনপি তাদেরকেও রুখবে জনগণকে সাথে নিয়ে। আওয়ামীলীগও তাদের পরিকল্পনাতে কারো কারো বিশেষায়িত ব্যক্তিদের সামনে নিয়ে এসে এমন করে ঘোষণা দিয়ে পরিবর্তনের রাজনীতি সূচনা করতে পারে।
বিএনপি যে নতুন ধারারা রাজনীতি ও সরকারের কথা ভাবছে বলে পত্র-পত্রিকায় এসেছে, সেজন্য এই রকম ঘোষণাও অনেকটা তাদের নতুন ধারার রাজনীতির সমার্থক হিসেবেই প্রতিভাত হবে। জনগণও তাই মনে করেন। কেননা সরকারের মধ্যে কেবলমাত্র দলীয় ক্যাডার ও জী হুজুর মার্কা ব্যক্তিদের মন্ত্রী ও কর্পোরেট পোষ্টগুলোতে বসিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও জবাবদিহি মূলক প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তার ও চর্চা সম্ভব নয়। বিগত সব কটা সরকারেই সেটা প্রমাণিত। সুতরাং সরকারের মধ্যে নতুনের সাথে পুরাতনের সমন্বয় সাধন করে, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সাথে এক ঝাঁক দেশপ্রেমিক নতুন, কর্মচঞ্চল, সাচ্চা দেশপ্রেমিক সরকারের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা ও বিকাশ করা যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন, অর্থাৎ সকলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে।
আমাদের দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিশাল চাপ আর যুগের ও সমাজের উর্ধ্বমুখী চাহিদা ও বিন্যাসের ফলে প্রচলিত পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন এবং জবাবদিহিমূলক সরকারের ব্যবস্থা করা প্রায় দুরহ। সেটা বিগত কয়েকটি সরকারের আমলে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত। তাই আমাদের এখন বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে হবে, প্রচলিত পার্লামেন্টারি ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও আধুনিক করে সকল পেশা-শ্রম-মেধার-কর্মের মানুষদের সমন্বয় সাধন করে বা ব্রিটেন, ভারত, আমেরিকার আদলে দ্বিস্তরের, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সরকার বা আপার হাউস ও লোয়ার হাউস-এর সংসদীয় সরকারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কিংবা আর কারো কাছে কোন উন্নত ও পরীক্ষিত-প্রমাণিত ব্যবস্থা জানা থাকলে সেই ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাশাপাশি সংসদীয় সীমানা পূণঃর্বিন্যাস করে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে এবং বিভিন্ন পেশা ও কর্মের মানুষের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সম্বলিত (ব্যাপক) আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
তাছাড়া, দলীয় প্রধানের যুগের পর যুগ প্রধান পদে আঁকড়ে থাকার যে চিরায়ত নিয়ম, যে দল জিতবে তিনিই বারে বার প্রধানমন্ত্রী হবেন-এমন নিয়মেরও পরিবর্তন দরকার। বিশ্বের কোথাও এমন নিয়ম নেই। দলীয় প্রধান ও দলীয় প্রধানমন্ত্রী কোরানের মতো বেধ বাক্য নয় যে পরিবর্তন করা যাবেনা। পরিবর্তন কিংবা নতুন ধারার রাজনীতির স্বার্থে এই বিদ্যমান ব্যবস্থা কিছুতেই সামঞ্জস্য নয়। যেমন ইংল্যান্ডে যে দলই ক্ষমতায় আসে, সেই দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন, আবার তিনি যদি ব্যর্থ হন, তবে তিনি যেমন পদত্যাগ করেন, একই সাথে দলীয় প্রধানের পদও হারান। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন দলীয় প্রধান নির্বাচিত করে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানো হয় বা ইতিপূর্বে আসীনকেই দলীয় প্রধান করা হয়। একই সাথে পর পর দুবার তিনি প্রধানমন্ত্রী যেমন হতে পারবেননা, তেমনি দলীয় প্রধানও থাকার সুযোগ নেই।তাই বলে দলের কোন ক্ষতিতো হয়নি, বরং নতুন নেতৃত্বের বিকাশ যেমন হয়, মেধা যাচাইয়ের সুযোগের সাথে সাথে প্রতিযোগিতামূলক নেতৃত্বও তৈরি হয়।একই অবস্থা আমেরিকা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের দেশে।
তাই, দুই দলের নেত্রীই ঘোষণা দিতে পারেন, এটাই তাদের জীবনের শেষ ( শেষ বলতে দলীয় প্রধান হিসেবে, প্রধানমন্ত্রী পদের দাবীতে) নির্বাচন। নির্বাচনে যিনিই হারবেন তিনি আর দলীয় প্রধান থাকবেননা। আবার যিনি জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবেন, কেউই যাতে পর পর দুই টার্মের বেশী প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন বা দাবীদার হতে পারবেননা, আইন করে তা বাস্তবায়ন করবেন, পার্লামেন্টের প্রথম দিনের অধিবেশনে।
পরিবর্তন ও নতুন ধারার রাজনীতির জন্য আমাদের দলীয় নেতা-নেত্রীরা কি এই রকম কোন ঘোষণা দিতে পারেননা, দেশ ও জনগণের স্বার্থে ?
(এই বিষয়ে আলোচনা শেষ নয় শুরু মাত্র… ) ।
২৬শে জুলাই ২০১৩,লন্ডন।