সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ-
আগামী ২০২০ সালে ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে গণভোটের ফলাফলের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের বিজয় ডঙ্কায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠদলের নেতা হয়েও ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক মতামতের প্রতি চরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। বলা যায় গণতন্ত্রের এক সুন্দর বলিদান ডেভিড ক্যামেরন। গণভোট চলাকালিন সময় থেকে গণভোট পরবর্তী অবস্থায় এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজনীতির হট টপিক্স হলো ব্রেক্সিট। আর ব্রেক্সিট এবং সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে প্রতিদিনই সিনারিও পরিবর্তন হচ্ছে। মতামত পক্ষে বিপক্ষে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। এরই মধ্যে টেরেজা মে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ইউরোপ ও বার্লিন সফরে গিয়ে ক্লিয়ারলি বলেছেন ব্রেক্সিট মিনস ব্রেক্সিট.. তারপরেও ব্রেক্সিট নিয়ে শঙ্কা, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ কিছুতেই কাটছেনা। এরই মধ্যে ব্রেক্সিট বিরোধী জনমতও প্রবল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে এবং অতি যত্নের সাথে ব্রেক্সিট বিরোধী লবি শক্তিশালী মাত্রায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। যার ফলে বিজনেস ইনসাইডারে জিম এডওয়ার্ড আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছেন, টেরেজা মে আলোচনার দরজা বিলম্বের মাধ্যমে হয়তো ব্রেক্সিট ডিল নাও করতে পারেন। কিন্তু কেন এই শঙ্কা, কেন এই এনালাইসিস। যেখানে খোদ থেরেসা মে নিজেই বলেছেন, ব্রেক্সিট মিনস ব্রেক্সিট।তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়- আদৌ কি ব্রেক্সিট হবে, ব্রেক্সিটের পর কী হতে পারে ?
এমন প্রশ্ন শুধু একজন এডওয়ার্ডের নয়, এই প্রশ্ন অসংখ্য ব্রিটিশদের। অর্থনীতির বিশ্লেষকদের, তরুন-তরুনীদের, শিক্ষকদের, ব্যবসায়ীদের অর্থাৎ সকলেই এখনো উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে ভদাফোন, এইচএসবিসি ব্রিটেন( ব্রেক্সিটের পরে) থেকে চলে গিয়ে নতুন বাজার খুঁজছে এমন সংবাদও বেরিয়েছে। অর্থনীতির মন্দার সংবাদের আশঙ্কাও কেউ কেউ করেছেন। রাজনীতির বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেহেতু সামনে ২০২০ সালের নির্বাচনের ইস্যু, এমন অবস্থায় কনজারভেটিভ হউক আর লেবার দল হউক- কেউই ব্রেক্সিট করে নির্বাচনী ভরা ডুবির ঝুকি নিবেনা । যুক্তি অকাট্য। কিন্তু গণভোটের ফলাফলের রায় ? সেটাও বড় প্রশ্ন। এক মিলিয়নের মতো ব্রিটিশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে দামী চাকুরীতে নিয়োজিত- ২০২০ সালের ভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষের দলকে কোন অবস্থাতেই তারা ভোট দিতে চাইবেননা- সঙ্গত কারণেই বোধগম্য। এমন ঝুকি এখন কোন দল নিবে ? ব্রেক্সিটের টার্মস এন্ড কন্ডিশন নির্ধারন করতে বিশেষ করে ব্রেক্সিট পরবর্তী টার্মস বির্ধারনের জন্য ২৮টি দেশের সাথে ব্রিটেনকে এক এক করে বসতে হবে, নেগোসিয়েশন করতে হবে। সেজন্যে সময় প্রয়োজন। টেরেজা মে ও অ্যাম্বার রূড ও সেটাই বলেছেন। আবার আর্টিকল ৫০ এ ট্রিগারের জন্যে ব্রিটেনের সব দিক নেগোসিয়েশন সম্পূর্ণ না করে ট্রিগার করবেনা- সেটাও ব্রিটেন বলেছে। আর সেজন্যেও দুই বছর সময় দরকার।সেই অবস্থায় ২০২০ সামনে চলে আসবে। বলা হচ্ছে ২০১৮ সালের মধ্যে ব্রেক্সিট হয়ে যাবে; কিন্তু সেটা কতোটুকু যুক্তিসঙ্গত ও লেজিটিমিট- সেটাই মোটা দাগের প্রশ্ন।
আবার কনজারভেটিভ পার্টির ভিতরেও ফুঁসছে ব্রেক্সিট বিরোধী লবি। অন্যদিকে গনোভোট এর ফলাফল মানতে পার্লামেন্টের বাধ্যবাধকতা নেই। এটা শুধু উপদেশমূলক। যদিও কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান বলেছেন, তিনি মনে করেন এটা পার্লামেন্টের জন্য বাধ্যবাধকতা মূলক, যদিও তিনি মনে করেন আইনী বাধ্যবাধকতা নেই।
যে কারণে ব্রেক্সিট না হওয়ার শঙ্কা –
০১) কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ট সরকার হলেও ব্রেক্সিটের জন্যে তারা মূলতঃ মাত্র ১২% অর্থাৎ খুবই ছোট আকারের সংখ্যাগরিষ্ট
০২) প্রাইম মিনিস্টার টেরেজা মে- মূলতঃ প্রো-রিমেইন ক্যাম্পেইন গ্রুপের, যদিও তিনি বলেছেন ব্রেক্সিট মিনস ব্রেক্সিট
০৩) পার্লামেন্টের অধিকাংশ এমপি প্রায় ৭০% সদস্য প্রো-রিমেইনের, যাদের মধ্যে ৫০% এমপি কনজারভেটিভ দলের, ( সূত্রঃ মর্গ্যান ষ্ঠ্যানলি)
০৪) সরকার যদি তার পরিকল্পনা মোতাবেক ব্রেক্সিট করে ২০১৮ সালে, তাহলে এর ঠিক পর পরই ২০২০ সালে সাধারণ নির্বাচন
০৫) এক মিলিয়ন ভোটার ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ সমূহে কাজ করেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। এমতাবস্থায় ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে তাদের নাগরিক স্ট্যাটাস হুমকী হেতু তারা ব্রেক্সিট বিরোধী স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া হচ্ছে।
০৬) ব্রেক্সিট এর ফলে সিঙ্গেল মার্কেটে কম অ্যাকসেস হেতু অর্থনৈতিক মন্দা- যা দ্বিতীয় অর্ধ-বার্ষিকীতেই এর আভাস শুরু হয়েছে
০৭) অর্থনৈতিক মন্দার ঝুকি, নির্বাচনে বিরূপ প্রভাবের ঝুকি, এক মিলিয়ন ভোটারের হুমকী- এতো সব হুমকী ও ঝুকি সামনে নিয়ে কেউ কী ঝুকিকে নিজের কাঁধে নিবে- যেখানে ক্যামেরনের দৃষ্ঠান্ত সামনে রয়েছে ?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনি যা বলছে–
০১) ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রিটেনের সিঙ্গেল মার্কেট এবং স্পেশাল অফার ডিলের ব্যাপারে কোন আলোচনা করবেনা, যতোক্ষন ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রেক্সিট করছে, আর্টিকল ৫০ এ ট্রিগার করছে। একই সাথে সিঙ্গেল মার্কেট ডিল নির্ভর করছে ইউনিয়নের মূল থিম ফ্রি মুভম্যান্টের উপর- সেটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যেই ন্যাশনালিষ্ট মুভম্যান্ট এবং এন্টি ইইউ সেন্টিম্যান্টও বৃদ্ধি পাচ্ছে সর্বত্র।
০২) ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রিটেনের ব্যাংকের ইইউ সিঙ্গেল মার্কেট ঢোকার অ্যাক্সেস তুলে নিবে- যা অর্থনীতির জন্য অশনী সংকেত
০৩) আর্টিকল ৫০ বিপরীত (উল্টো) করার ব্যবস্থা- অনেকেরই এখনো অজানা, যেহেতু এই আইন করার পরে এখনো সেটা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নেই। ইউকে চাইলে আর্টিকল ৫০ ট্রিগার করেও আবার সেi আর্টিকল ৫০ ট্রিগার তুলে নিতে পারে- ব্রেক্সিট হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে- যদি ব্রিটেন সেটা চায়। সেক্ষেত্রে কোন আইনী বাধা নেই বা কোন অপশন নেই যে, সেটা করা যাবেনা। সুতরাং এমন অপশন এখনো ব্রিটেনের হাতে তুরুপের তাশ হয়ে আছে ।
যা আশঙ্কা করা হচ্ছে, ব্রেক্সিট হলে-
০১) ব্রেক্সিট হয়ে গেলে ব্রিটিশদের ফরেন ট্রিপ বা হলিডে যেহেতু কম হারে পাউন্ড ব্যব হ্নত হবে, তার মানেই হলো হলিডে অধিক এক্সপেনসিভ হয়ে যাবে।
০২) ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসের ক্ষেত্রে ইমিডিয়েট কোন পরিবর্তন সাধিত হবেনা
০৩) হাই ইনফ্লেমেশন- যেহেতু পাউন্ড ব্যবহার কম হবে, আমদানী মূল্য তখন বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘদিন ধরে মূল্য একই জায়গায় স্থবির থাকবে- প্রেডিক্ট করা হচ্ছে ২% বৃদ্ধি পেতে পারে মাত্র। ফুড এবং কাপড়ের ক্ষেত্রেঈ সেটা বেশী মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করবে।
০৪) ইন্টারেস্ট রেইট বৃদ্ধি পাবে- যদিও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড লিগ্যালি বাধ্যবাধকতা আছে ২% পর্যন্ত ধরে রাখার কিন্তু পাউন্ড মূল্য নীচের দিকে নেমে গেলে দাম বৃদ্ধির দিকে গেলে ব্যাংক ইন্টারেস্ট রেইট বৃদ্ধি করবে।ব্যবসা ও মর্গেজ পেমেন্টের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে
০৫) ব্রেক্সিটের নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হিসেবে রিসেশনের কথা অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন। এমনকি ব্রেক্সিট আলোচনার সময়েই কোম্পানী ও বিনিয়োগকারীরা ইনভেস্টম্যান্ট ও মানি স্থানান্তরিত করছেন বা ভাবছেন।
মর্গান ষ্ট্যানলির অর্থনীতিবিদ জ্যাকোব নীল এবং মেলানি বেকার সম্প্রতি ব্রেক্সিট এবং আফটার ম্যাথ নিয়ে তাদের মতামত সম্বলিত রিপোর্ট পাবলিশ করেছেন । তাদের ফোরকাষ্টের বিজনেস ইনসাইডারে এডওয়ার্ড আরো কিছু বক্তব্য সংযোজন করেছেন। সব কিছু মিলিয়ে দেখা যায় এখনো ব্রেক্সিট নিয়ে রয়ে গেছে নানা দিক, নানা সংশয় এবং আরো ব্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষনের দাবী রাখে। যদিও তাদের অনেক মতের সাথে আমি কিংবা অনেকেই একমত নন বা হওয়াটাও সম্ভব নয়।
মোটা দাগের যে প্রশ্ন সেটা হলো, গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত ব্রিটেনের জনগনের মতামতের ভিত্তিতে ব্রেক্সিটের যে ফলাফল এসেছে, সেই প্রেক্ষিতে ব্রিটেন কী এমন জনমতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে ? সহজেই চোখ বুঝে বলা যায় ব্রিটেনে এমন হবেনা। কিন্তু যেহেতু ব্রিটেনবাসী মাত্র অল্প সংখ্যক মার্জিনে ( 48-52%) দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছেন এবং গণভোটের ফলাফল ও ব্রেক্সিটের আর্টিকল ৫০ ট্রিগার এ পার্লামেন্টের অনুমোদন দরকার- গণতান্ত্রিক রীতি নীতির সুন্দরের এই চর্চায়- শেষ পর্যন্ত নাটকীয় কোন কিছু ঘটে যাওয়াও ব্যতিক্রম নয়।ব্রেক্সিট যাই বলা হউক না কেন- আমাদেরকে তার রেশ দেখতে আরো কয়েক বছর যে অপেক্ষা করতে হবে সেটা বলাই বাহুল্য।
salim932@googlemail.com
30th July 2016, London