সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ-
বছর ঘুরে এলো.. বৈশাখি মেলা– এক সময় মাকসুদ গাইতেন। জনপ্রিয়ও করেছিলেন তিনি। মাকসুদের কন্ঠে এই গান মানাতোও ভালো। তারপর একে একে গাইলেন আইয়ূব বাচ্চু, খালেদ সহ আরো অনেকেই। সেই গান এখন বাঙালির প্রাণের মেলার সাথে মিশে আছে একাকার হয়ে। সেজন্যেই বোধ হয় বৈশাখী মেলা কখনো শেষ হয়না। বাঙালি ছেলে বুড়ো, বুড়ি, যুবা, যুবতী, কিশোর কিশোরী, শিশু যেখানেই আছে- এই মেলার জন্যই অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। রমনার বটমূল আর টিএসসির মোড় থেকে যে মেলার যাত্রা শুরু বছরের শুরুতেই, সেই মেলা আজ সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে টেমসের এই পারে এসে মিলনের মোহনায় মিলেছে- এ যেন বিলেতের পূর্ব লন্ডনে এক খন্ড সবুঝ-শ্যামল বাংলা মা, যেখানে সমস্বরে গেয়ে উঠে- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
গাইবেইবেনা কেন। বাংলার কৃষক, বাংলার তাতী, বাংলার জ্বেলে, কামার কুমার লাঙ্গল কাস্তের বাঙালি আজ শার্ট-প্যান্ট-টাই পড়ে সাদা চামড়াদের সাথে মিশলেও ভুলতে পারেনি সেই গায়ের কোকিলের ডাক, মেঠো পথের সুর, ভাটিয়ালির টান আর গোয়াল ভরা ধানের সুধা গন্ধ। তাইতো বাঙালি ফিরে চলে প্রাণের টানে- বৈশাখের নবান্নের মেলায়, আদি অকৃত্রিম -শেকড়ের টানে মিশে যায় বৈশাখী উতসবে। সমস্বরে গেয়ে চলে এলোরে বৈশাখ….
লন্ডনে বৈশাখী র্যালী-
রোববার সকাল ১১টায় বৈশাখী মেলার র্যালির উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয় ব্রিকলেনের বাক্সটন রোড থেকে শুরু হয়ে মূল মেলা উইভার্স ফিল্ডের মঞ্চে গিয়ে মিলিত হয়। উদ্বোধনী র্যালীতে টাওয়ার হ্যামলেটস বারার নির্বাহী মেয়র জন বিগস, ডেপুটি মেয়র সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী , স্পিকার খালেস উদ্দিন, কবি সাহিত্যিক শামীম আজাদ, নবাব উদ্দিন সহ বাংলা মিডিয়ার লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
নানান বর্ণের মুখোশ, আর বর্ণিল পোষাকের সমারোহে টাওয়ার হ্যামলেটসের স্কুলের ছোট ছোট ছেলে মেয়ারা শোভা যাত্রায় অংশ গ্রহণ করে এবং র্যালিকে মনমুগ্ধকর করে তোলে।
মূল মঞ্চ- উইভার্স ফিল্ড-
দুপুরের দিকে নাচ গানে মঞ্চ ভরিয়ে তোলেন বিলেতের স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ। এ সময় বিলেতের একমাত্র রেডিও ষ্টেশন বেতার বাংলার নিজস্ব শিল্পীবৃন্দের সঙ্গীত পরিবেশনা ছিলো উপভোগ্য। শুরু যার ভালো, শেষও তার ভালো। বেতার বাংলার এই ভালো শুরু করার মধ্য দিয়ে এবারের মেলায় সেটাই প্রমাণ করে। বিকেল হতেই জনসমাগম বাড়তে থাকে। ৪টার পরে উপচে পড়া ভীড় পরিলক্ষিত হয়।
বিশাল মাঠের একপাশে বসানো সারি সারি নানা পদের ও মজাদার খাবারের স্টল। ঝালমুড়ি, চানাচুর, ফুচকা-চটপটি ও বিরিয়ানি সহ স্টলগুলোতে নানা বাঙালি খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন বিলেতের বাংলাদেশিরা।মেলায় বেশিরভাগ প্রবাসীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মেলা উপভোগ করতে এসেছিলেন। নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে সন্তানদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এক বড় সুযোগ বলে মনে করেন অনেকে ।সুশৃংখলা ছিলো মেলার অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য – যা ঢাকার মেলার থেকে আলাদা ও ভিন্ন এক আমেজে নিরাপদ ও সত্যিকার বাঙালিয়ানায় নিরাপদ পরিবেশে নাচ গান ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সুযোগ ছিলো- যা অনেকের জন্যে বিশাল এক পাওনা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।
এ সময় গানের তালে তালে বাঙালি ছেলে মেয়েদের পরিবার পরিজন নিয়ে খুব নেচে গেয়ে ধুম ধাম করতে দেখা যায়।
ভিন্ন ভাষাভাষীদের মিলন মেলা-
বাঙালির এই প্রাণের মেলায় বাংলা ভাষাভাসি ছাড়াও অন্যান্য কমিউনিটির লোকদেরও ব্যাপক সমাগম হয়। তাদের কেউ কেউ বাঙালি ছেলে মেয়েদের মতো পোষাক পরিধান করে ফুসকা, চানাচুর, মুড়ি খেতে দেখা গেছে।
আইয়ূব বাচ্চু ও হাবিব এর গান-
বিলেতে বৈশাখি মেলায় গান মানেই কোকিল কন্ঠী বেবী নাজনীনের গান। এবার বেবীর অনুপস্থিতিতে কিছুটা ভাটা যে পড়েছিলো- সেটা সহজেই চোখে পড়েছে। উপস্থিতি, আর মঞ্চের ঝলকানো- অনেকের চোখে সেটা সহজেই নস্টালজিকের মতো মনে করিয়ে দিয়েছে। তারপরেও বুড়ো আইয়ূব বাচ্চু এবং তরুণ হাবিবের গান দর্শকদের মন মাতিয়েছে।
ছিলোনা পান্তা ইলিশ-
বৈশাখী মেলার আরো এক আকর্ষন- পান্তা ইলিশের সমারোহ- এই বৈশাখী মেলায় ছিলোনা বললেই চলে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ ষ্টলে নিয়ে এসেছিলেন। তাতে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
র্যালিতে ঘাটতি ছিলো বাংলার আদি সংস্কৃতি-
সন্দেহ নাই র্যালি ছিলো উপভোগ্য। কিন্তু বাংলার চিরায়ত আদি ও লোক সংস্কৃতির যে রীচ এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে- তার ছাপের অভাব অনেকের চোখে লেগেছে। তারপরেও মেলা পূর্ব র্যালি ছিলো অসাধারণ। যদিও বাঙালি সংস্কৃতির বদলে ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকেই মেলার র্যালিতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এমনকি নাচ ও গানেও। এতো বড় বাঙালির এই আয়োজনে বাঙালি সংস্কৃতি ও গান, নাচ দিয়ে দর্শক বিমোহিত ও মাতিয়ে রাখা যেতো। কিন্তু কেন যে তা না করে ভারতীয় সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করানো হলো বোধগম্য নয়। এটা কি বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, নাকি অতি সঙ্গোপনে বিজাতীয় সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্ঠা ? মেলা আয়োজনকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। আগামীতে সেটা থাকবেনা বলেও আয়োজনকারীদের কয়েকজন অবশ্য বলেছেন।
salim932@googlemail.com
31st July 2016, London.