৮৬৫ থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১১বার বিশ্ব মুসলিম কাবায় হজ্ব করতে পারেননি

৮৬৫ থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১১বার বিশ্ব মুসলিম কাবায় হজ্ব করতে পারেননি

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ । দারা রিপোর্ট, সৌদি আরব । মুসলমান (সক্ষম) মাত্রই  জীবনে একবার আর সক্ষম(সব দিক দিয়ে) মুসলমানেরা বার বার আল্লাহর ঘর তাওয়াফ ও জেয়ারত করার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে থাকেন। মুসলিম বিশ্বের কাছে আরবের মরুভুমিতে শায়িত মদীনা মুনওয়ারা আর মক্কার কাবাতুল্লাহ শরীফ জেয়ারত ও তাওয়াফ অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং আল্লাহর ঘর হিসেবে পবিত্র কাবা শরীফ ও নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারকের গুরুত্ব সীমাহীন।

ইসলাম পূর্ব থেকে এই পবিত্র কাবা ঘর তাওয়াফ এবং জেয়ারতের ইতিহাস থাকলেও রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের মধ্য দিয়ে পবিত্র কাবা শরীফে সর্ব প্রকারের শিরক ও মূর্তী পূজা বন্ধ করে এক আল্লাহর একত্ববাদ আর আল্লাহর ঘরের মর্যাদা সমগ্র বিশ্বে এক নব রূপ এবং সম্পূর্ণ আক্কিদা ও ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এই কাবা ঘর জেয়ারত ও হজ্বের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের মুসলিমরা যেমন গমণ করেন প্রতি বছর হজ্বের মওসুমে , তেমনি হজ্ব যুগে যুগে বিশ্ব ইতিহাসের নানা পরিক্রমায় এবং উত্থান পতনে, নানা দুর্যোগ, দুর্বিপাক, প্ল্যাগ মহামারির তান্ডবে মুসলিমরা হজ্ব থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং হজ্ব অনুষ্ঠান সম্পন্ন না হওয়ার ইতিহাসও রয়েছে অনেক। বিশ্ব ইতিহাসের পরিকোষমন্ডল, সৌদি আরবের গ্র্যান্ড আর্কাইভ-বাদশা আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন দারা রিপোর্ট( DARAH Report), গার্ডিয়ান, আরব নিউজ, সিয়াসট, মিডলইষ্ট আই, ফরেন অফিস সৌদি আরব, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির কিং আব্দুল আজিজ ফাউন্ডেশন রিসার্চ আর্কাইভস সহ ইসলামের নানা ইতিহাসের পরিক্রমা সাক্ষ্য দেয়, যুগে যুগে কমপক্ষে ১০ বারেরও কম বেশী পবিত্র হজ্ব মুসলমানেরা করতে পারেননি-ইতিহাসের এই সব নানা দুর্যোগ দুর্বিপাকে।

(ছবিঃ এপি, ১৯৫৪ সালের হজ্বের সময়ে কাবা)

আরবের প্রখ্যাত লেখক, গবেষক, সাংবাদিক মোহাম্মদ আল কিনানি সহ বিশ্বের ইতিহাস  এই বক্তব্যের এভিডেন্স হিসেবে অনেকেই অবগত।

ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র যেমন, মাদ্রাসা এবং আম জনতাও জানেন, হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ পরিস্থিতি অনুকুলে থাকা সত্যেও আরব মুশরিকদের কঠিণ শর্তগুলো মেনে নিয়ে মক্কা নগরীর উপকন্ঠ থেকে হজ্ব না করেও মদীনায় ফেরত গিয়েছিলেন।

প্রথম বাধা- ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দেঃ

বাগদাদের আব্বাসীয় খেলাফতের সময়ে ইসমাইল বিন ইউসূফ যিনি আল-সাফাক নামে ইতিহাসে খ্যাত, তার সময়ে আরাফাতের ময়দানে ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো, যার ফলে সেই রক্তগঙ্গা পেরিয়ে হজ্ব আর সম্পন্ন হয়নি। প্রথমবারের মতো মুসলিম ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে কলংকময় এক শতাব্দি হিসেবে।

দ্বিতীয় ঐতিহাসিক বাধা-৯৩০ খ্রিষ্ঠাব্দঃ ১০ বছর হজ্ব বন্ধ ছিলো

এই ঐতিহাসিক সত্য ছাড়াও ৯৩০খ্রীষ্ঠাব্দে  আব্বাসীয় খেলাফতের সময়কালীন বাহরাইনের কারমাটিয়ানদের ( বাহরাইন ভিত্তিক ইসমাইলি শিয়া) নেতা আবু তাহের আল জানাবি দ্বারা বিদ্রোহ্রের ফলে হজ্বের ৮ম দিনে সেদিন ইসলামের নামধারী ঐ সব পথভ্রষ্টরা তান্ডব চালিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীর জমজমের পানিতে তাদের উঠের পদচিহ্নে মাড়িয়ে শুধু ক্ষান্ত হয়নি, সেদিনের আক্রমণে ৩০ হাজার হাজী মুসলমানের রক্তে আরবের জমজম রঞ্জিত হয়েছিলো, তারা কাবা ঘরের পবিত্র সেই পাথর পর্যন্ত খুলে তাদের রাজধানী আরাবিয়ান গালফে নিয়ে গিয়েছিলো, যা পরবর্তীতে আবার ফিরিয়ে এনে হাজর যা আজকের কাতিফে স্থাপন করা হয়েছিলো। দারা রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, দুঃখজনকভাবে সেদিন থেকে পরবর্তী ১০ বছর মুসলমানেরা হজ্ব করতে সক্ষম হননি।

তৃতীয় বাধা-৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ-মক্কায় মহামারীর প্রাদুর্ভাব

বিখ্যাত ইবনে খতিরের বই আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া এবং দারা রিপোর্ট উভয় থেকে জানা যায়, ৯৬০ খ্রীষ্ঠাব্দে মক্কাতে এমন মহামারী দেখা দিয়েছিলো, যাতে হাজীগন উঠ নিয়ে কষ্ঠের সাথে মক্কায় পৌছলেও হজ্ব শেষে কেউই সুস্থ্যভাবে অথবা হজ্বে আসার পথে প্ল্যাগের কবলে পরে অসুস্থ্য হয়ে পরেন, যার ফলে হাজীগন কোনভাবে মক্কায় পৌছে হজ্ব করার পরেও বাচতে পারেননি। কেউই মহামারীর কবল থেকে বাচতে পারেননি ঐ সময়। মিসর থেকে অল্প সংখ্যক হাজি আসলেও ফিরে যেতে পারেননি(দারা রিপোর্ট)

৯৬৮ খ্রিস্টাব্দেও মহামারীর প্রাদুর্ভাবে হজ্ব বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো।

৯৮৩ খ্রিস্টাব্দঃ

ইরাক সিরিয়ার আব্বাসীয় ও ফাতিমিদ খেলাফতের যুদ্ধ বিগ্রহের প্রেক্ষিতে কেউই নিরাপদে মক্কা পৌছা সম্ভব ছিলোনা বিধায় হজ্বও অনুষ্ঠিত হয়নি- ৯৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

১০০০ খ্রীষ্টাব্দঃ

এই শতাব্দীতে মুসলিম হাজিগন জীবন জীবীকা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনভাবে আর মক্কায় পৌছতে ব্যর্থ হন। মিশরের মুসলমানগন মক্কায় পৌছা এফর্ডের বাইরের ছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।শুধু তাই নয় পরবর্তী ২৯ বছর মিশর থেকে কেউ হজ্বের জন্য মক্কায় আসতে পারেননি। এখানে ঐতিহাসিক বেশ কিছু তথ্য অনুহ্য রয়ে গেছে, যা এখনো গবেষণার দাবী রাখে।

The Prophet Muhammad said, ‘If you hear of an outbreak of a plague in a land, do not enter it.’

দারা রিপোর্ট অনুসারে ১০৩০ সালে ইরাকীরা হজ্ব করতে সক্ষম হলেও  নয় বছর পরে ইরাকী, ইরানি, মিশরীয়, সেন্ট্রাল এশিয়া, নর্থ আরাবিয়ান মুসলিম কেউই হজ্ব করতে পারেননি।

অবশ্য ঐ সময়ের অবস্থাকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও ধর্মীয় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে হজ্ব করতে না পারার কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাদশা আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ ইমাদ তাহের।

১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দঃ   

যুদ্ধের ভয়াবহতার ফলে এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতা, উম্মাদনা উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ঐ সময় মুসলিম বিশের কেউই হজ্ব করতে পারেননি।

১১৬৮ খ্রিস্টাব্দে মিশরের কার্দিশ কমান্ডার আসাদুদ্দিন শিকরোহ যিনি জানগিদ ডাইন্যাস্টি এক্সটেনশনের জন্য সংগ্রাম করছিলেন, সে সময় পরিস্থিতি মিশরীয়দের অনুকুলে না থাকায় সেখানকার ও সে অঞ্চলের কারও পক্ষে হজ্ব করা সম্ভব হয়নি।

১৩শ শতাব্দীতে হজ্ব আবারও বাধার মুখে পরে।  দারা রিপোর্ট অনুযায়ী সে সময় ১২৫৬ থেকে ১২৬০ পর্যন্ত হিজাজ অঞ্চলের বাইরের কেউই  হজ্ব সম্পন্ন করতে পারেননি।

১৭৯৮-১৮০১ খ্রিস্টাব্দঃ নেপোলিয়ন বেনাপোর্টের আর্মি-

ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বেনাপোর্টে মিশরীয়-তার্কিশ-সিরিয় রাজ্যের অটোম্যান সাম্রাজ্যে নেপোলিয়নের আর্মির ক্যাম্পেইনে কেউই মক্কায় নিরাপদে পৌছা অসম্ভব ছিলো-ফলে তখনও হজ্ব কেউ করতে পারেননি।

১৮৩১ মহামারীঃ

১৮৩১ এর ভারতীয় মহামারী ভাইরাসে মক্কায় হজ্বে তিন চতুর্থাংশ লোক মারা যাওয়ার প্রেক্ষিতে হজ্বও বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো।

১৮৩৭-১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দঃ

এসময় ১৮৩৭ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত মহামারীর প্রেক্ষিতে তিনবার হজ্ব বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো। পরবর্তীতে ১৮৪৬ সালে কলেরার প্রাদুর্ভাবে মক্কায় ১৫০০ লোক মারা গিয়েছিলেন। কলেরার প্রাদুর্ভাব ১৮৫০ পর্যন্ত ছিলো। কিন্তু কলেরা আবার ফিরে এসেছিলো ১৮৬৫তে।

১৮৫৮ সালে কলেরার প্রাদুর্ভাবে মিশরীয় অঞ্চলের লোকদের রেড সি উপকূলীয় অঞ্চলে কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়েছিলো।

হজ্ব ২০২০ঃ

মিশরীয় অ্যাকাডেমিক হানি নাসিরা এবারের কোভিড-নাইন্টিন প্যানডেমিক করোনা ভাইরাসের প্রেক্ষিতে হজ্ব ফের ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে বাধা গ্রস্থের আশঙ্কা করছেন। আরব নিউজে তিনি এ বিষয়ে তার মতামত ও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

সৌদি গেজেটে ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চার আহমেদ আলগামদি  মুসলমান সাবালকের লাইফটাইম হজ্ব সম্পন্নের আবশ্যিকতা ইসলামিক স্তম্ভের কথা স্মরণ করে দিয়ে এ ব্যাপারে এ বছরের মহামারীর প্রেক্ষিতে হজ্ব বাধা গ্রস্থের আশঙ্কা ও উদবেগ প্রকাশ করেছেন।

এ দুজনের মতে, জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও ঝুকির কথা বিবেচনায় নিয়ে এ বছর হজ্ব কোনভাবে শেষ পর্যন্ত সাসপেন্ডের ব্যাপারে বলেন, ইসলাম এতে কোন কন্ট্রাডিকশন রাখেনাই, এতে শরীয়তের কোন বাঁধা নেই-অবস্থার প্রেক্ষিতে।তার বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনস্ট্যান্টলি প্রথম বছরই হজ্ব করেননাই, যা তিনি পরের বছর হজ্ব করেছিলেন। তাদের মতে, এতে কোন অন্যায়ও হবেনা বলে মত প্রকাশ করেছেন।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের মহামারী এখন পর্যন্ত যেভাবে বিস্তার লাভ করছে, তাতে এ বছর মুসলমানরা নিরাপদে পবিত্র হজ্ব সম্পন্ন করার ব্যাপারে বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সময় পর্যন্ত করোনা ভাইরাস সৌদি আরব সহ সারা বিশ্বের মহামারীর প্রকোপ কেমন থাকে, কোন পর্যায়ে যায়-সেটাও বিরাট এক প্রশ্ন।

 

সূত্রঃ দারাহ রিপোর্ট, কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন

২. বাদশাহ আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, ডিপার্টম্যান্ট অব হিস্ট্রি

৩। আলসিয়াসট ডেইলি

৪। আরব নিউজ

৫। সৌদি গেজেট

৬। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি বাদশা আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন দারাহ

৭। গার্ডিয়ান

৮। মোহাম্মদ আল কিনানি- লেখক, সাংবাদিক, গবেষক

 

 

20 April 2020