জর্ডান ভ্যালী- মৃত্যু উপত্যকা, যাদের কথা কেউ বলেনা

জর্ডান ভ্যালী- মৃত্যু উপত্যকা, যাদের কথা কেউ বলেনা

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ ।

 

জর্ডান ভ্যালী, আমাদের আধুনিক সভ্যতার পীঠে ছুরিকাঘাত করে চলেছে প্রতিনিয়ত, সভ্যতার অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হয়ে চলছে, সভ্যতার বুকে ঘা হয়ে জ্বলে-পুড়ে ছার-খার করে দিতেছে, কিন্ত আমাদের বিশ্ব সভ্যতা যেন বড় আথুর, অন্ধ, বধির হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।যেখানকার মনুষ্য সম্প্রদায়কে সামরিক ট্রেনিং এর শিকারে পরিণত করা হয়েছে, নিজেদের বেচে থাকার ন্যূনতম সম্পদ ও চাহিদা প্রকৃতির অপার দান পানি পান করার নৈতিক এবং বৈধ দাবী থেকেই শুধু বঞ্চিত করা হচ্ছেনা, যুগের পর যুগ ধরে তাদেরকে দিনে মাত্র ১০-১৫ লিটার পানি নিয়ে বেচে থাকার উদগ্র এক অস্বাভাবিক লড়াই করে জীবন-যাপণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।যখন তখন নিজেদের বসত-বাড়ী বোল্ডোজারের হিংস্রতা দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, বাজার, কিন্ডারগার্ডেন সবই একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।ইচ্ছে করলেও বিনা অনুমতিতে জর্ডান ভ্যালীর কেউই এরিয়ার বাইরে কোথাও যেতে পারবেননা, অথচ সেই অনুমতি নিতে হবে বাইরের অথরিটি থেকে-যারা জোর করে জর্ডান ভ্যালীতে একের পর এক সামরিক ঘাটি স্থাপণ করে চলছে।নিজেদের জমিতে বপন করা সব্জি,ফল-ফ্রুট সবই জবর দখলকারীদের ছাড়া আর কারো কাছে দেওয়া বা বিক্রী করা যাবেনা, জবরদখলকারীরা চাইলেই যখন তখন সব ফল-ফসলী কেটে নিয়ে যাবে কিংবা সব একেবারে নষ্ট করে দিয়ে যাবে, প্রতিবাদ করা যাবেনা, করলেই গুলি করে পঙ্গু কিংবা হত্যা করে ফেলবে।প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখুন কি রকম এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যুগের পর যুগ এই জর্ডান ভ্যালীর মানুষ সকল নাগরিক ও মানবিক অধিকারহীনভাবে বেচে আছে।

প্যালেষ্টাইনের পশ্চিম তীরের উত্তরের এবং ইসরাইলের বর্ডার সন্নিকটের এই গ্রামীণ উপত্যকার নাম জর্ডান ভ্যালী,যে এলাকার প্রায় সকল অধিবাসীর একমাত্র পেশা কৃষি কাজ।৬৩ শতাংশেরও অধিক এই জর্ডান ভ্যালীর নাগরিকদের বসবাসের ও ফসলী জায়গা-জমি জাতিসংঘের অসলো ডিক্লারেশন এর সি-এরিয়ার অনর্গত, যার অধিকাংশ এরিয়াই ইসরাইলের মিলিটারীর কন্ট্রোল করে থাকে।শুধু কি তাই, জর্ডান ভ্যালীর জনগণের জীবন-ধারনের জন্য পানীয়-জলের প্রায় সকল নিয়ন্ত্রণ ইসরাইল কর্তৃপক্ষই করে থাকে, যদিও এই সুপেয় পানীয়-জলের রিজার্ভার এবং উৎসের মালিক জর্ডান ভ্যালী তথা প্যালেষ্টাইনের অথরিটির, অথচ ইসরাঈল জোর করে এই সুপেয় পানির উৎসস্থল এবং সংরক্ষণাগার সব কিছুই নিজেদের দখলে নিয়েছে, পানির জন্য রিজার্ভার থেকে বা নিজেদের ট্যাংক থেকে পানি আনার জন্য সেখানে যাতায়াত তথা গমনের জন্য ও জর্ডানভ্যালীর জনগণের ইসরাইলের অথরিটির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এখানেই কষ্টের শেষ নয়, এই অনুমতি পাওয়াটা খুবই কষ্ট সাধ্য এক ব্যাপার, যদিও সেখানে যাওয়ার অনুমতি মিলে, কিংবা নিজেদের এলাকায় নতুন করে পানির ট্যাংকি বসানোর অনুমতি মিলে, তারপরের অবস্থা আরো ভয়াবহ।পানির ট্যাংকী বসানোর পর, ইসরাঈলের সৈন্যরা পরে এসে ট্যাংক-কামানের সাহায্যে সেই পানির রিজার্ভার বা ট্যাংক মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে যায়।এমতাঅবস্থায়, বিকল্প হিসেবে নিজেদের পানি জীবন-জীবিকার জন্য ইসারাঈলের কাছ থেকে সেই রিজার্ভারের পানিই জর্ডান ভ্যালীর জনগনকে কিনে পান করতে হয়, জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, আর সেই পানির মূল্য জর্ডান ভ্যালীর মানুষের জন্য তিনগুণ বেশী দিয়ে কিনতে হয়, এতে তাদের সারা মাসের সব আয়ই চলে যায় এই পানির খরচে।আর এই হিসেব খোদ ঈসরাইলের হিউম্যান রাইটস গ্রুপ বিটিসেলেম-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।

ইসরাইলের সেটেলররা জর্ডান ভ্যালীর ১,৪৬০ স্কোয়ার কিলোমিটার জমি নিয়ন্ত্রণ ও ভোগ-দখল করে আছে, সেখানে মাত্র ৫০ স্কোয়ার কিলোমিটার জমি জর্ডানভ্যালীর প্যালেষ্টাইনী জনগণ ভোগ-দখল করার সুযোগ পাচ্ছে, অর্থাৎ জমির প্রায় ৯০ শতাংশ সেটেলররা দখল করে রেখেছে বলে বিটিসেলেম তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে।

৫৮ বছর বয়স্ক আব্দেল করিম জিবেইদাত আক্ষেপ করে বলেন, উপায়ান্তর না দেখে তিনি তার জমি সেটেলরদের কাছে রেন্ট দিয়ে দিয়েছেন,যিনি ৭১ সাল থেকে নিজ জমিতে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন, আজকে পানি ও ফসলী শস্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে অনন্যোপায় হয়ে তিনি তাই করতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবী করেন।আব্দেল করিম ব্যাখ্যা করে বলেন, তিনি বছরে ৩,৭৩২ ডলার পানির জন্য, পক্ষান্তরে জমির আক্সেস এর জন্য ১,২৪৪ ডলার ব্যয় করতে হয় ইসরাঈলীদের কাছে।মোটকথা আব্দেল করিমের মতো গ্রামের লোকজন মাত্র ০.৭ স্কোয়ার কিলোমিটার জমিতে কৃষি-কাজ ও ফসলী কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন, যা নেহায়েতই কম।ইসরাঈলের ক্রমবর্ধমান সেটেলরদের কারণে জিবেইদের মতো ১,৮০০ গ্রামীণ জনগণ ০.২৪ স্কোয়ার কিলোমিটার জমিতে চাষা-বাস করার সুযোগ লাভ করেছেন।

বিটিসেলেম এর রিপোর্টে আরো জানা যায়, সেটেলরদের নিকটবর্তী গ্রাম আনগামানের বাসিন্দাদের প্রতিটি হাউসের জন্য ৪১১ লিটার পানি বরাদ্ধ করা হয়, সেখানে জর্ডানভ্যালীর জিবেইদাত বাসীন্দাদের প্রতি হাউসের জন্য মাত্র ৮২ লিটার পানি সরবরাহের ব্যাবস্থা রয়েছে।এমতাবস্থায় আব্দেল করিমের মতো সকলেই প্রতি মাসে কষ্টের মধ্যে অতিবাহিত করেন, কেননা পানির জন্যই তাদের সব আয় খরচ হয়ে যায়।

জর্ডানভ্যালীর অধিবাসীদের মতে, ইসরাইল চাচ্ছে, কৃষি জমির উর্বতা ও ফসলী জমির লোভে তারা প্রতিনিয়ত নানা চাপ ও নির্যাতন দ্বিগুণভাবে বৃদ্ধি করে চলেছে, যাতে জর্ডানভ্যালীর জনগণ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।ইসরাঈল দিন দিন নানা বাধা-বিপত্তি শুরু করেছে, ফসলী পণ্য ইসরাঈলে ন্যায্য দামে বিক্রী করে পাওয়া বড় অসাধ্য এক কাজ, এমতাঅবস্থায়, যখন-তখন বাসা-বাড়ীতে আক্রমণ, এমনকি ফসলী জমিতে কাজ করা অবস্থায় আক্রমণ, বাধা দিলে বিনিময়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া, আবার ফসল ফলানোর পরে কেটে বাজারে নিয়ে যাওয়ার আগেই সেটেলররা কিংবা মিলিটারীর লোকজন গুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে যায় বা জোর করে নিয়ে যায়, এতো সব সমস্যার উপর আছে, নিজেদের জায়গায় যাওয়ার পার্মিশনের অভাব।

জর্ডান ভ্যালীর জনগণ নিজেদের এই সমস্যার কথা প্যালেষ্টাইন কর্তৃপক্ষের সাথে বার বার যোগাযোগ করেও কোন সুরাহা করতে পারেননি।মাত্র কিছুদিন আগে এই রকম অবস্থার সুষ্টু সমাধানের লক্ষ্যে প্যালেষ্টাইন কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন একদল কৃষক, সেখানে বিক্ষোভ শেষে ফিরে আসার তিনদিনের মাথায় সেই কৃষক প্রতিনিধিদলের নেতা দেখলেন তার ভিটে-মাটি ফসলী জমি সব দিনে দুপুরে ইসরাইলের মিলিটারী সাজোয়া ট্যাংক বহর নিয়ে একেবারে গুড়িয়ে দিয়েছে।

জর্ডান ভ্যালীর কৃষক আর অধিবাসীরাই মূলত প্যালেষ্টাইন এবং ইসরাঈলের অধিবাসীদের সিংহভাগ ফসলের যোগানদার এবং অর্থনীতির চাকাকেও সচল রেখে চলেছেন, অথচ তাদের কান্না ও কষ্ট নেভানোর জন্য যেন কেউ নেই।জর্ডানভ্যালীর অধিবাসী ফোকাহা যেমন করে বলেন, “ A farmer in the Jordan Valley is a soldier, bread winner, and the main line of defense, but at the same time, the biggest loser, No one is taking care of us”.

সূত্রঃ আল-জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল

রিপোর্ট- বিটিসেলেম,ইসরাইল

Salim932@googlemail.com

23rd Sept.2012.UK