সানডে টাইমস অবলম্বনে সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ। করোনা ভাইরাস-৩১ ডিসেম্বর থেকে বিশ্বব্যাপী যার মেডিক্যাল নেইম কোভিড-নাইন্টিন হিসেবে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব হিসেবে ছড়িয়ে পরে সব কিছু তছ নছ করে ফেলে, সেই করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি ও ছড়ানো নিয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী রয়েছে নানা মত ও থিওরী। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এটা নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌছতে পারেননি। তারা বলছেন এখনো অনেক গবেষণা বাকী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে, ট্র্যাম্পের মতো তারাও এলমেলো। সেপ্রেক্ষিতে তাবদ বিশ্বের সাধারণ জনগন অন্যান্য মাহামারীর মতো করোনা ভাইরাস নিয়ে কোন বিজ্ঞানসম্মত ঐক্যমত্যের এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত জানতে পারছেননা।
এই যখন অবস্থা ঠিক তখনি সানডে টাইমস রোববারের প্রিন্ট ও অনলাইন রেস্ট্রিকডেট এডিশনে (শুধুমাত্র রেজিস্ট্রার্ড,রোববার আর্লি এডিশনে) তাদের অনুসন্ধানী এক দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশ করে। ইনসাইট অনুসন্ধানী রিপোর্টটি সানডে টাইমসের ইনসাইটের তিন সাংবাদিক জর্জ আর্বাথনাট, জনাথান কালভার্ট এবং ফিলিপ শেরওয়েল যৌথভাবে করেছেন।
https://londontimesnews.com/archives/1399
সানডে টাইমস দাবী করছে, করোনা ভাইরাসের সাথে সংশ্লিষ্ট এরকম অজানা এক রোগের উপসর্গ শ্বাসকষ্টে ২০১২ সালের আগস্টে ইউনাইন প্রভিন্সের কোপার খনির কাছে ৬জন খনি শ্রমিককে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে দেখেছিলেন, যাদের মধ্যে ৩ জন মৃত্যু বরন করেছিলেন এর প্রদাহ নিয়ে। সানডে টাইমস জানিয়েছে, এরকম ভাইরাসে মৃত্যুবরন ও তাদের আক্রমনের ফলে ল্যাবরেটরীতে ফ্রুজেন রাখা এবং যা চীনের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষা করার জন্য-সেই এভিডেন্স তারা দেখতে সক্ষম হয়েছেন, অথচ পরবর্তীতে চীন সেই ৩ জনের মৃত্য এক রহস্যজনক কারণে এড়িয়ে যায়। চীনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, উহানের ল্যাবরেটরি কোথাও সেই ৬ জনের মধ্যে বেচে উঠা ৩ জনের তথ্য থাকলেও মৃত ৩ জনের সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। এমনকি তারা মৃত সেই তথ্যও অনুপস্থিত।
সানডে টাইমস তাদের অনুসন্ধানে উল্লেখ করেছে, চীনের ছয়জন গবেষক সারস ভাইরাসের শ্বাসতন্ত্রে কষ্টজনিত উপসর্গ নিয়ে অনেক গবেষণা করে সার্স ভাইরাসের উতপত্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেও ১০ বছর মেয়াদী তাদের গবেষণায় চীনের খনিতে মৃত ৩ জনের করোনা উপসর্গ-যা সার্স ভাইরাসের সাথে সংশ্লিষ্ট, গবেষণায় নিজেরাও সার্সের সাথে করোনার লিংক খুজে পেলেও ৩ খনি শ্রমিকের করোনায় মৃত্যুর সাথে সার্সের লিংকের কোন তথ্য নেই, সেখানেই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্নের উদ্রেক করে। সেই সাহসী বিজ্ঞানীদের গবেষণার সাফল্য ও উপকারীতা নিয়ে বিশ্বে কেউ কোন প্রশ্ন করেনি বরং প্রশ্ন দাঁড়ায় তাদের সাহসিকতা বিশ্বে মহামারি সংক্রমনের তথ্য গোপণের রহস্য নিয়ে।
২৪ এপ্রিল ২০১২-ইউনান প্রদেশঃ (অজানা করোনার)ঘটনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা-
সানডে টাইমস জানিয়েছেন, ২৪ এপ্রিল ২০১২ ইউনান প্রদেশের কুনমিনের হাসপাতালে গু সারনেইমের ৪৫ বছর বয়সী একজন নিউমেনিয়ার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হন। একই বছরে পরের দিনই ৪২ বছর বয়সী এলভি সারনেইমের আরেকজন একই হাসপাতালে ভর্তি হন-জীবন মৃত্যুর সন্নিকটে উপসর্গ নিয়ে। পরেরদিন বৃহষ্পতিবারে আরও ৩ জন জো-৬৩, লিউ ৪২ এবং লি -৩২ বছর বয়সী, একই হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি হন। এই ৫ জনের সাথে পরের সপ্তাহে বুধবারে উ সারনেমের ৩০ বছর বয়সী একই উপসর্গ নিয়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হন।
এই ৬ জনই টংগুয়ানের মজাং অঞ্চলের পাহাড়ী খনি এলাকার কাছের বাসিন্দা-যারা খনিতে দুই সপ্তাহ কাজের পর এরকম অসুখের মধ্যে পরেছিলেন এবং কারও কারও কয়েকদিনের মধ্যেই।
এই ৬ জনের কাশি ও ৩৯ডিগ্রির উপরে জ্বর ছিলো ও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। হাসপাতালে ভর্তি প্রথম দুজনের মৃত্যু হলে বাকীদের সবধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা সহ চায়নিজ, জাপানিজ ফ্লু, ডেঙ্গু সহ সার্স সব টেস্ট করা হলে রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছিলো।
এরফলে চিকিৎসকেরা সার্স ভাইরাসের নেতৃত্বদানকারী, চায়নিজ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ব্রিটিশ শ্বাস প্রশ্বাসের এক্সপার্ট চিকিৎসক প্রফেসর জং নানশানের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। প্রফেসর নানশান তাদের এন্টিবডি পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু বেচে যাওয়া ৪ জনকে পরীক্ষা করার জন্য চীনের ভাইরোলজি ইন্সটিটিউট উহানের সেই বিখ্যাত ল্যাবে পাঠানো হয়েছিলো এবং সেখানে ফলাফল নেগেটিভ এসেছিলো এবং করোনার সাথে যুক্ত এন্টিবডি চারজনের মধ্যে উপস্থিতি ছিল। এই এন্টিবডির ফলে দুজন হাসপাতাল থেকে সুস্থ্য হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন এবং এদের একজন পরে মৃত্যু বরন করেছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো হাসপাতাল্বে মৃত্যুবরনকারী এবং খনিতে ৩ জনের মৃত্যু ও আক্রান্তদের নিয়ে মাস্টার্সের থিসিস পেপারে লি জু নামের তরুণ গবেষক জমা দিলে সেখান থেকে অধ্যাপক কুইন চুনইয়ান জানতে পারেন। তবে তরুণ লি ঝু তার গবেষনায় তারা কিভাবে মৃত্যু হলো সেসম্পর্কে তার পিএইচডি পেপারে কিছু বলতে না পারলেও সে ইঙ্গিত দেয় যে তার ধারণা খনিতে ও হাসপাতালে মৃত্যুবরণকারী সার্সের সাথে সম্পৃক্ত করোনার ভাইরাসে তারা মৃত্যু বরন করেছেন। কারণ লি খনিতে বাদুড়ের সার্স নিয়ে তার গবেষণার বিষয় ছিল।
উহান ল্যাবরেটরিজের ভাইরোলজিস্ট যিনি ব্যাট ওম্যান নামে সমধিক পরিচিত তার নেতৃত্বে এখন সেই গবেষণা কার্যক্রম চলছে, যা নিয়েই মূলত সানডে টাইমস লিখছে রহস্য এখানেই।
বাদুড়ের করোনা ভাইরাস সার্স বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে উহানের সেই ল্যাবের ব্যাট ওম্যান শি ঝেংলি মূলত এক পরিচিত নাম।
করোনা ভাইরাস মূলত একধরনের জীবাণু যা প্রাণীদেহে থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে এবং অণুবীক্ষণের নীচে কেবল এর স্পাইকগুলি-মুকুলগুলি দেখা যায়।সার্সের প্রাদুর্ভাবে কোভ-২ থেকে বর্তমানে কোভ-১ নামে পরিচিত করোনা ভাইরাস।
পরের বছর বিজ্ঞানীরা ২৭৬টি বাদুড়ের মলদ্বার থেকে নমুনা নিয়ে উহানের ল্যাবে ৮০সে বিশেষ সলিউশনে রেখেছিলেন। আণবিক বিশ্লেষণ ও পরীক্ষার জন্য ।এতে দেখা যায় অর্ধেক বাদুড় করোনা ভাইরাস বহন করে এবং অর্ধেক বাদুড় এক সাথে একাধিক ভাইরাস বহন করে-যার ফলে রোগজীবাণুর বিপদজনক এক সংমিশ্রণের সম্ভাবনা থাকে। তবে অন্যান্য থিসিস পেপারের ন্যায় এই গবেষনাটি কেন করা হয়েছিলো-খনিতে ৩ জনের মৃত্য- সেসবের কোন উল্লেখ ঐ পেপারে নেই।
তবে পেপারে নির্দেশ করা হয়েছে, ছয় প্রজাতির বাদুড়ের করোনা ভাইরাসের ১৫২ টি জিনগত অনুক্রমের মধ্যে দুটিতে সার্সের মতো নতুন এক স্ট্রেন এবং RaBtCoV/4991 শ্রেণীগত।এটি একটি রাইনোলোফাস অ্যাফিনিস-এ পাওয়া গিয়েছিল, যা সাধারণত হর্সোয়া ব্যাট নামে পরিচিত- যা ৭ বছরের মধ্যে RaBtCoV/4991 সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া দুষ্কর।
উহানের সেই ল্যাব-
২০১৭ সালে উম্মোচিত হয়েছিল অত্যাধুনিক এই উহানের ল্যাব। এতে ৩১টি ল্যাবরেটরি-যা চীনে এই প্রথম এবং এটা “biosafety level 4”, or BSL-4 দ্বারা শীর্ষ সুরক্ষা দ্বারা ছিলো তথাপি বিশ্বের তাবদ বিজ্ঞানী এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনে এমন ল্যাবরেটরীতে উদবিগ্ন ছিলো বলাই যায়।
উহানের ল্যাবরেটরিতে অনেক তথ্য লিকআউট হয়েছিলো-২০০৪ সালে ল্যাবরেটরিতে এক দুর্ঘটনার ফলে বেশ কিছু লোক সার্স ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন।শি এবং তার দল ইতোমধ্যে ইউনান প্রদেশ জুড়ে ব্যাট তৈরির কাজ থেকে RaBtCoV/4991 সহ করোনভাইরাসটির কয়েকশ নমুনা সংগ্রহ করেছিল এবং তারা কীভাবে মানুষের মধ্যে আরও সংক্রামক হতে পারে তা আবিষ্কার করতে বিতর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই বিতর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে প্রাণী থেকে মানুষের দেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ঝুকি ও বিপদজনক মহামারীর প্রাদুর্ভাবের ঝুকির প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ল্যাবে অর্থ ব্যয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
শির দলটি যুক্তি দেখালো সাধারণ একটি করোনাভাইরাস কিভাবে একদিন সার্সের মতো হত্যাকারিতে রূপান্তরিত হতে পারে-সেটা বুঝাপড়ার জন্য তাদের কাজ। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব কলেজ লন্ডনের ভাইরোলজির অধ্যাপক দীনান পিলাই দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন এতে অত্যধিক ঝুকি ছিলো।
ঘটনা ডিপ্লোম্যাটিক পর্যায়েও গড়ায়। ওয়াশিংটন পোষ্ট ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায় উহানে মার্কিন দূতাবাসের সাথে শি ও তার দল সাক্ষাত করেছিলেন, সেখানে ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল সার্সের ভাইরাস করোনা ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমন হতে পারে। সেকারণেই আমেরিকানরা স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন ছিলো এবং এর নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিবিদদের প্রশিক্ষণ, তদন্ত ইত্যাদি ঘাটতির উল্লেখ করা হয়েছিলো ল্যাবরেটরি ও বিজ্ঞানীদের সাথে সেদিনের ইন্টারেকশনের পর ওয়াশিংটনে রিপোর্ট করেছিলেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
২০১৯ এর ৩০ ডিসেম্বরে শি একটি কনফারেন্সে থাকা অবস্থাতেই ফোন কল পান উহানে একটি নতুন ভাইরাস পাওয়া গেছে এবং সেটা সমগ্র উহানে ছড়িয়ে পড়েছে।
আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব।।
@salim1689
London, July 05, 2020.