সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ। বর্তমান পৃথিবী যখন টাল মাটাল অবস্থায় করোনা মহামারীতে, তখনও যে দেশ সব আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে, সেদেশ হচ্ছে চীন। প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্প বরাবরই বলে আসছেন করোনা ভাইরাসের জন্য চীন দায়ী। যদিও ট্র্যাম্পের এই সরাসরি বক্তব্য বিজ্ঞানীদের দ্বারা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কিন্তু বিতর্ক থামছেইনা। বিশ্বের কোন কোন এক্সপার্ট করোনা ভাইরাসের আসল তথ্য লুকানোর জন্য ট্র্যাম্পের সাথে চীন এবং উহানের ল্যাবকেই দুষছেন। তাদের সেই বক্তব্যের সাথে এভিডেন্স নির্ভর রিপোর্ট সম্প্রতি সানডে টাইমস প্রকাশ করেছে। এমনি অবস্থার মধ্যে সেই চীন ভারত, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একযোগে বিশ্ব ট্রাম কার্ড নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে যেভাবে বিতর্ক সমানতালে চলছে, যেভাবে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমন ২০১২ সালে চীনের খনিতে পাওয়া গেলেও চীন অত্যন্ত কৌশলে বিশ্বকে চেপে যেতে সক্ষম হয়, তেমনি বিশ্ব বাণিজ্যে, অর্থনীতিতে, সমরনীতিতে, কূটনীতিতে নিজেদের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের জন্য সুদূঢ় প্রসারী এক পরিকল্পণা নিয়ে এগিয়েছে সেই বহু বহু কাল আগে থেকেই-যা আজকের ২০২০ সালে বিশ্ব মহামারীর সময়কালীন সময়ে চীন ত্রাতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জানান দিচ্ছে। শুধু জানান দিলে বললেই ভুল হবে, বরং দাপুটে খেলোয়াড়ের মতোই বিশ্বের তাবদ বড় বড় শক্তিগুলোকে এক ধরনের ভদ্র বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার শক্তিমত্তার প্রকাশ দিচ্ছে।
০১) ওবামা উত্তর মার্কিন প্রশাসনে চীন-রাশিয়ার যোগসাজসে এবং প্রযুক্তি দক্ষতা ও কৌশল খাটিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে ট্রাম্পের মতো এমন একজন বড় ধরনের ব্যবসায়ীকে তারা হোয়াইট হাউজের ক্ষমতায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলো-যা তারা ষোলআনাই সফল বলা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা, ক্লিনটন কিংবা হিলারীর মতো চৌকস ও দাপুটে রাজনীতিককে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন করে চীন রাশার মতো শি জিন ও পুতিনের পক্ষে মার্কিনীদের সাথে দক্ষতার সাথে খেলা অনেকটাই দুষ্কর-যা একজন ব্যবসায়ী ট্র্যাম্পের সাথে শি জিন ও পুতিন বেশ মুন্সিয়ানা ও ঠান্ডা মাথায় দাবার খেলা খেলতে সচেষ্ট।
০২) ট্র্যাম্পের সাথে বাণিজ্য সংঘাত প্রকাশ্যে যখন চলছিলো তখনি করোনার মহামারী বিশ্বকে আঘাত করে-যা থেকে নাটকীয়ভাবে বেইজিং থাকে অনেকটাই সুরক্ষিত, অথচ হোয়াইট হাউজ সহ বরিস জনসন ও ১০ নং ডাউনিং ষ্ট্রীট হয়ে পরে সংক্রমিত। করোনা নিয়ে বিশ্বের যখন ত্রাহি অবস্থা, ঠিক তখনি চীন ভারত লাদাখে বেশ নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের খেলার আয়োজনে জড়িয়ে পরে। লাদাখে জড়িয়ে পরার আগেই নেপাল টাইম বোমার মতোই ভারতের সীমানা নিজেদের মানচিত্রে নিয়ে সংসদে বিল পাশ করে একতরফাভাবে সেটাও বিশ্ব মানচিত্রে একে দেয়। এমনি চমক আর উত্তেজনা যখন তুঙ্গে ঠিক তখনি লন্ডনে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি ঝাওমিং লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গত সপ্তাহেই ব্রিটেনকেহুশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে দেন, ফাইভ জী প্রযুক্তি চুক্তি থেকে ব্রিটেন সরে গেলে এর প্রসার যেমন থামবেনা, তেমনি ব্রিটেনকে সেজন্যে পরিণতি ভোগ করতে হবে।প্রথমবারের মতো চীনা এক দূত ব্রিটেনের মতো মাটিতে দাঁড়িয়ে সদম্ভে কূটনীতির শিষ্ঠাচারের বাইরে গিয়ে এমন বার্তা দিলেন-যা কেবল দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যখন থাকে তলানীর মধ্যে, কেবল তখনি এরকম অকূটনৈতিক সুলভ বক্তব্য প্রচলন রয়েছে। অথচ ব্রিটেন ও চায়নার বর্তমানের সম্পর্ক অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় বলা যায় সোনায় সোহাগা।
০৩) ব্রিটেনের সাথে চীনের যত কূটনৈতিক উন্নতি, বিনিয়োগ, ব্যবসা বাণিজ্য, বলা যায় সব ক্ষেত্রেই কিন্তু এই লি ঝাওমিয়াং দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতার ভুমিকা রাখেন। অনেকেই তাকে সেজন্য সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে অভিহিতও করেন।সেই ঝাওমিং এর জবানীতে এমন হুশিয়ারি কূটনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মহলে যে কড়া বার্তা সেটা বলাই বাহুল্য এবং সেই বার্তার বিশেষ এক মূল্যও রয়েছে।লি ঝাওমিং এর কড়া বার্তার মূল্য বুঝতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে।
ক্লাব ফোরটি এইট– ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাট, হাই প্রোফাইল পলিটিক্যাল লিডার আর উচ্চ পদস্থ এলিটশ্রেণীর লোকদের দ্বারা ব্রিটেনে এক উচুমার্গের এলিট ক্লাব রয়েছে যার নাম ক্লাব ফোরটি এইট। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্টিত হলেও এ ক্লাবের এখন পর্যন্ত সদস্য সংখ্যা ৭০০ ঘর অতিক্রম করেনি। সদস্য আহবান ওপেন থাকলেও যাবতীয় তথ্য প্রোফাইল খুটিনাটি যাচাই করেই এ ক্লাবের মেম্বার হওয়া যায়। এই ক্লাবের মেম্বার সাবেক লিডার ব্রিটেনের ভেটেরান পলিটিশিয়ান হেসেলটাইন এবং পিটার ম্যান্ডেলসনের মতো খ্যাতিমান রাজনীতিক। এই ক্লাবের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক লি ঝাওমিং এর দীর্ঘদিন ধরে। সাবেক চ্যান্সেলর আজকের ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড এর এডিটর জর্জ অসবর্নও এখন লি ঝাওমিং এবং ক্লাব ফোরটি এইট সহ চায়না ব্রিটেন বিনিয়োগ বাণিজ্যের দিকে ঝুকে আছেন বলে সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও অসবর্ন মূলতঃ চ্যান্সেলর থাকাকালীন সময়েই চায়নার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিনিয়োগে আগ্রহী ছিলেন। আবার ম্যান্ডেলসন ও হেসেলটাইন এই ফোরটি এইট ক্লাবের মাধ্যমে ব্রিটেন চায়নার সম্পর্ক স্থাপনে ভুমিকা রাখেন। এই ক্লাবের সাথে জড়িত বড় বড় সব ব্যবসায়ী, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার একাডেমিক ক্লাইভ হ্যামিল্টন, সাবেক কূটনীতিক চার্লস পার্টনও। ব্যবসায়ী স্টিফেন প্যারি, অথর হাইডেন হান্ড, ক্লাইভ হ্যামিল্টন এবং চায়নিজ দূতাবাস মিলে সম্মিলিতভাবে শি জিন পিং এর লন্ডন সফর সফল করে তুলেছিলেন।
০৪) সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ ওয়াশিংটন পোষ্টে খবর বেরিয়েছে চায়না বিশ্বের তাবদ বড় বড় গণমাধ্যমকে- ওয়াশিংটন পোষ্ট সহ, কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়েছে। লিঝাওমিং ব্রিটেনের দূত হয়ে আসার পরেই শি জিন পিং কে ব্রিটেনের রানী ইতিহাসের সর্ব বৃহত রাজকীয় সংবর্ধনা প্রদান করেছেন। ক্যামেরনের সময়ে, টেরেজার সময়ও চায়নার বিনিয়োগ ব্রিটেনে উত্তোরোত্তর বাড়তে থাকে। বাড়ছে এমনভাবে, যা অনেকের কাছে বিশ্ময়ের।
- ওএনএসের হিসেব মতে, ব্রিটেনে চায়নার রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ২০১৭ সালে ৭.৯ বিলিয়ন হলে বর্তমানে সেটা বেড়ে আরো বহুগুণ হয়েছে। এই ডাইরেক্ট বিনিয়োগের চেয়েও আরো কিছু বিনিয়োগ রয়েছে চীনের-যা স্টার্লিং এর হিসেবে বিশাল অংকের। ব্রিটেনের ক্রিটিক্যাল এনার্জি ইনফ্রাস্ট্রাকচারে, সিজিএন, নিউ ক্লিয়ার প্ল্যান্টে(হিংকলে সি নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে) চায়নার বিনিয়োগ ৩৩.৫ শতাংশ- যা সমারসেটে সিজিএন, ফ্রেঞ্চ এবং ইডিএফের যৌথ এই কনস্ট্রাকশনে ২২.৫ বিলিয়ন পাউন্ডের কাজ চায়নার মাধ্যমে চলমান। এছাড়াও সিজিএন, ইডিএফের কনস্ট্রাকশন সি প্ল্যান্টে সোফক্সে ২০ শতাংশ পার্টনারশিপের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ চুক্তিও প্রায় সম্পন্ন। একই সময়ে ব্রিটেনের ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেটরের ৩.৫ বিলিয়নের নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টেও চায়নার বিনিয়োগ।
- ব্রিটেনের উইলটশায়ারের বৃহৎ তথা ইউরোপের বড় ব্যাটারি কোম্পানিতেও চায়নিজ ফান্ডের বিনিয়োগে চলছে-চায়নার হোণসেন গ্রুপ, চায়নার ইউটিলিটি কোম্পানি সবাই সেখানে কর্মরত।
- ব্রিটেনে চায়নার সর্ব বৃহত আরেক বিনিয়োগ চায়নার সাংহাই ভিত্তিক ফোসাম ইন্টারন্যাশনাল উলভারহ্যাম্পটম ফুটবল ক্লাব ক্রয় করা ছাড়াও টমাস কুককে কলাপসের হাত থেকে ব্রিটেনের অনুরোধে রক্ষা করে কিনে নেয় গত নভেম্বরে।
- ২০১৪ সালে হনি ক্যাপিটালের বৃহত পিজ্জা চেইন ইন্ডাস্ট্রি পিজ্জা এক্সপ্রেস ৮৭৩ মিলিয়ন পাউন্ডে চায়না কিনে নেয়
- ব্রিটেনের ক্রস রেইল, সাউথ ওয়েস্টার্ন রেইলওয়ে, ট্রান্সপোর্ট সেক্টরের গেলি, অটোমোটিভে হ্যাঙ্গহো, এলইভিসি, লন্ডনের ব্ল্যাক ক্যাবস, কভেন্ট্রি এবং লন্ডনের লোটাস, স্পোর্টস কার, নোরফোকে এমটিআর, হিথরো সব ক্ষেত্রে চায়নার বিনিয়োগ ও আধিপত্য- চায়না ইনভেস্টম্যান্ট কর্পোরেশন(সিআইসি) এবং চায়নিজ সভরিন ওয়েলথ ফান্ড জড়িত।
- ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান-জিঙ্গে, স্টীল মেকার, ব্রিটিশ স্টিল, স্কানথ্রপ প্ল্যান্ট, এমনকি হাউজিং বিল্ডিং যেমন ক্যানারি ওয়ার্ফ, লন্ডন চিজগ্রাটার বিল্ডিং সব কিছুতেই চায়নিজ ফান্ডিং
- গ্যাস ইন্ডাস্ট্রি-নর্থ সীতে ওয়েল এবং গ্যাস, নেপচুন এনার্জি – যা ব্রিটেনের ২৫ পার্সেন্ট তেল এবং গ্যাস চায়নার বিনিয়োগ
- স্টক মার্কেটে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে হংকং স্টক এক্সচেঞ্জ, লন্ডন মেটাল এক্সচেঞ্জ চীনের বিনিয়োগ ৩২ বিলিয়ন, সুপার ড্রাগ, ওয়েলস এন্ড ওয়েস্ট ইউটিলিটিজ- সোয়াপ কিং সব এখন চায়নিজ ফান্ডিং, গ্রিন কিং- পাব জায়ান্টে ৪.৬ বিলিয়ন বিনিয়োগ সম্প্রতি করেছে।
- টেরেজার সময়ে সিল্ক রোডের আওতায় রেল বাণিজ্য সরাসরি চালু হয়-যা উভয় দেশের বাণিজ্যে এক বিশাল মেইল ফলক হয়ে আছে।
০৫) সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের মহামারীর সময়ে ব্রিটেনের লিভারপুল, লন্ডন ও আশে পাশে ব্যাপক রিউমার ছড়িয়ে পরেছিল-ফাইভ জি প্রযুক্তি টাওয়ার করোনা ছড়াচ্ছে। অনেক ব্রিটিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টাওয়ারের কারনে নিজেদের শারিরীক সমস্যা, মাথাব্যাথা, যন্ত্রণা, করোনা উপসর্গ এমন সব বক্তব্য ভাইরাল হলে রাতের অন্ধকারে এক সাথে ব্রিটেনের মার্সে সাইড সহ বিভিন্ন সিটিতে ফাইভ জি টাওয়ারে আগুন দিয়ে ভস্মিভুত করা হয়। যা পরবরতীতে কেবল গুজবে কান না দেয়ার জন্য সরকারি নির্দেশনায় বলা হলেও ফাইভ জি প্রযুক্তি এবং করোনা ভাইরাস সহ হালের নিরাপত্তা ইস্যু বিতর্ক থামছেইনা। গত সপ্তাহে ফরেন সেক্রেটারি ডোমিনিক র্যাব মানবাধিকার লংঘন ও হংকং এর নিরাপত্তা বিলের ইস্যুতে বেশ কিছু ব্যক্তি ওপ্রতিষ্ঠান(৪৯) এর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার আগের দিন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হংকং নিরাপত্তা আইনের ইস্যুতে ৩ মিলিয়ন হংকংবাসীদের জন্য ব্রিটেনের দরজা খোলার ঘোষণা দিলে ব্রিটেনে নিযুক্ত চায়নার দূত নড়ে চড়ে বসেন। তারই অংশ হিসেবে লি ঝাওমিং সংবাদ সম্মেলন করে ব্রিটেনকে হংকং ইস্যুতে নাক না গলাতে এবং ফাইভ জি প্রযুক্তি ইস্যুতে চুক্তি থেকে সরে না যেতেই হুশিয়ারি দিলেন। স্বাভাবিকিভাবে অন্য যেকোন রাষ্ট্রের মতোই ব্রিটেন এর জবাব আশা করলেও রহস্যজনক কারণে ব্রিটেন দূতের এই বক্তব্যের জবাব কিংবা প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। ব্রিটিশ মিডিয়াও নাটকীয়ভাবে এনিয়ে তেমন উচ্চ বাচ্চ করেনি-যা ব্রিটিশ মিডিয়ার স্বভাবিক চরিত্রের বিপরীত আচরণ বলেই অনেকের দৃষ্টিগোচর এড়িয়ে যায়নি।
চলবে।।
#salimlondon
8th July 2020, update 10 July 2020