সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ। পৃথিবীর নামী দামী যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়(ব্রিটেন, আমেরিকা, ইউরোপ,এশিয়া) যারা পড়ছেন, পড়েছেন- তাদের সকলকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে, যিনি যে বিষয়ে পড়েন বা পড়বেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষণ, নিরীক্ষণ, ফলাফল, যোগাযোগ সকল ক্ষেত্রেই অধ্যাপক, লেকচারার, সেমিস্টারের প্রধান, বিভাগীয় প্রধান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সকলেই সেই বিষয়ের কোড নেইম ব্যবহার করে থাকেন, যেমন ওএমইডি ০১৩৫ ইত্যাদি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোড নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে হয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুটা ভিন্ন ও ব্যতিক্রম ভাবে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই এর ব্যবহ্রত কোড, ব্রিটেনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কোড থেকে ভিন্নতর, ঠিক তেমনি জার্মানি, রাশিয়া, ইসরাইল, ভারত প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কোড ব্যবহার ও আবিষ্কার করে থাকে। প্রচলিত সংস্থাসমূহের কোড থেকে সিআইএ, র, এমআইসিক্স, মোসাদ, কেজেবি, বাংলাদেশের ডিজিএফআই এর কোড ধরন, টেকনিক সম্পূর্ণ আলাদা হওয়াটাই স্বাভাবিক । আমাদের মতো (দেশের) পৃথিবীর কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ের নামানুসারে খুব একটা পরিচিতি ছেলে মেয়েদের থাকেনা, যতটুকু থাকে বিষয়ের কোড নেইম নিয়ে। সেই কোড নেইমের ভিতর আবার অনেক কোড থাকে। সেই অনুসারেই লেকচার, সেমিনার, পরীক্ষা, ফলাফল সবই হয়ে থাকে।
আমার বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন বা পড়েছেন অথবা পড়ছেন তারা সকলেই একমত হবেন।
০২) পৃথিবীর নানাদেশের আইন শৃংখলা বাহিনীর মধ্যেও রাষ্ট্রীয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রেই এই কোড নেইম ব্যবহার করা হয়। মাঝে মাঝে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই ঘটা করে অনেক কোড নেইমের কথা জনসম্মুখে প্রচার করে থাকে। আবার এমন কিছু কোড নেইম আছে, যা অত্যন্ত গোপণীয় এবং খুবই স্পর্শকাতর-যা কেবল অত্যন্ত উচুলেভেলেই সীমাবদ্ধ থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সেই সব কোড নীচের লেভেলের অফিসার এমনকি মিড লেভেল বা উপরের স্থরের অফিসারদের, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে শীর্ষ নির্বাহী(বিভাগের) এবং সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই অজানা থাকে রাষ্ট্রীয় টপ সিক্রেট এজেন্ডা হিসেবে।
০৩) উপসাগরে পশ্চিমাদের সামরিক হস্তক্ষেপের সময়ে বিশ্ব যখন টাল মাটাল এবং নাটকীয়তার পর নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো, পশ্চিমা জোট বাহিনী এই বুঝি ইরাক ঢুকে যায়, বিপরীতে এই বুঝি সাদ্দাম মারমুখী হচ্ছে-এমন সব সাসপেন্স যখন বিশ্বে মঞ্চায়িত হচ্ছিলো, তখন ন্যাটো বাহিনী নানা সামরিক কোড পশ্চিমা সামরিক কমান্ডোদের মধ্যে বিনিময় হচ্ছিলো। এমনি অবস্থায় জাতিসংঘ আণবিক পরিদর্শক টিমের ইরাক পরিদর্শনেও কোড নেইম ব্যবহ্নত হচ্ছিলো-যার ফলে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সাইন্টিস্ট ক্যালি কোড নেইম খোলাসার মধ্য দিয়েই প্রাতঃরাশের সময়ে আচমকা মৃত্যু ব্রিটিশ মিডিয়ায় এবং বিশ্ব মিডিয়ায় কিছুটা উত্তাপ ছড়ালেও উপসাগরীয় যুদ্ধের ডামাঢোলে সাইন্টিস্ট ক্যালির মৃত্যু রহস্য ঢাকা পরে যায়, যা আজও উঘাটিত হয়নি বা হওয়ার প্রয়োজনও খুব একটা কেউ মনে করছেনা। যদিও ব্লেয়ারের ব্রিটেনকে ইরাক যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া নিয়ে কমিশন করে ব্রিটেন এবং রিপোর্টও পাবলিশ করে। যুদ্ধের সেই কোড থাকে রহস্যাবৃত এবং অজানা।
০৪) ড্যান ব্রাউন তার বিখ্যাত দ্য ভিঞ্চি কোড গ্রন্থে বেশ নাটকীয়ভাবে কোড নিয়ে অনেক বিষয় উপভোগ্য বাক্যের উপমায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সফলতা ব্যর্থতা সেটা সমালোচক এবং বুদ্ধারাই বলতে পারেন। জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালে ৩৪/১৬৯ রেজুলুশনে আর্টকল ১ থেকে ৮ পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোড অব কন্ডাক্ট এর নানা আর্টিকল, কমেন্ট বর্ণিত রয়েছে, যা বিশ্বের দেশে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সদস্যভুক্ত দেশগুলোর আইন শৃঙ্খলা সংস্থাসমূহ মেনে চলতে দায়বদ্ধ হলেও কতোটুকু পালিত হচ্ছে সেটা দেখভালের (মনিটরিং) এর জন্য জাতিসংঘের দায়দায়িত্বও বিশ্বের দেশে দেশে স্থান কাল পাত্রভেদে প্রশ্নের উদ্রেক ভিন্ন ভিন্ন মাত্রিক ও আঙ্গিকে উঠছে।
“For security, codenames are generally picked from a list of such ‘good’ words, but avoiding the use of common words which could likely be intended to mean their normal definitions”.
০৫) দেশে দেশে এজেন্সি সমূহ ও আন্তঃদেশীয় এজেন্সি সমূহের মধ্যেও যোগাযোগ যেমন থাকে, তেমনি রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, পলিসি ইত্যাদি নিয়ে থাকে প্রতিযোগীতা এবং একধরনের রেস ও দ্বন্ধ। কখনো কখনো সেই সব দ্বন্ধ, রেস, প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদের অনেককেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলি দিতে হয়। বলিদান বা চৌকসকে হারানোর পরে গল্পের মিথ, ঢালাপালা সঞ্চারিত হয় নানা মাধ্যমে নানা রঙ এ।মানুষ তখন সেই সব গল্প উপভোগ্য করে, পাঠকপ্রিয়তা পায়, তর্ক বিতর্ক হয়। তার আড়ালেই ঢেকে যায় কোড নির্ভর অপারেশন।
০৬) আজকাল ব্রিটেন সহ বিশ্বের দেশে দেশে ফ্রিডম অব ইনফরমেশন এর আওতায় তথ্য প্রচার ও প্রকাশের সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা রয়েছে এবং সংবাদ মাধ্যমের সংবেদনশীল সাংবাদিকে ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক সে সবের ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য প্রচার করে থাকেন। পানামা পেপার্স কিংবা জুলিয়ান এসাঞ্জের তথ্য প্রকাশ সেই সংবিধিবিদ্ধ সতর্কীকরণ মেনেছে কিনা সেটা নিয়ে রয়েছে তর্ক বিতর্ক। কিন্তু ফ্রিডম অব স্পীচের এবং ফ্রিডম অব ইনফরমেশনের আর অবাধ স্বাধীনতার কিছু লিমিটেশনও সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর আজকের মনোবিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান স্বীকার করে এবং নির্দেশও করে লিমিটেশন থাকার।ব্যতিক্রমে এসাঞ্জকে যেমন স্বাধীন জীবনে থাকার জন্য আইনী যুদ্ধের গ্যাড়াকলে পরতে হয় বা চালিয়ে যেতে হয়, তেমনি পানামা পেপার্সও কেলেংকারিতে অংকিত হয়। সংবাদ মাধ্যম (সব শ্রেণীর) তখন পানামা পেপার্সের পর কেলেংকারি শব্দ জুড়ে দেয়।
০৭) হালের প্রচলিত রিপোর্টের এবং সংবাদের সূত্র আর বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চের রেফারেন্সের ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক। সংবাদের রিপোর্টে রেফারেন্স হিসেবে উইকিপিডিয়াকে ব্যবহার করা গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চের পেপারে উইকিপিডিয়া আদৌ কোন রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণযোগ্য তো নয়ই,বাতিল যোগ্য। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ আবার সংবাদের সূত্র উইকিপিডিয়াকে মেনে নিলেও আদালত শেষ পর্যন্ত চাক্ষুস এভিডেন্সের উপরই নির্ভর করেন এবং রেফারেন্স হিসেবে তথ্যসমৃদ্ধ এফিডেন্সের ব্যবহার করেন।
0৮) বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে প্রস্তুত তথ্য সংরক্ষণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, “২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময়, এনকাউন্টার এবং হেফাজত’ মোট ৪৬৬ জন নিহত হন।”আসক বলছে, নিহতদের মধ্যে ৪ মে থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছেন ২৯২ জন।আসকের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময়, এনকাউন্টার এবং হেফাজতে নিহত হয়েছিলেন মোট ১৬২ জন। আর আজকে পর্যন্ত একে একে সব হিসাব সঠিকভাবে নিয়ে আসলে পরিসংখ্যানের কলেবর বৃদ্ধি বৈ কম হবেনা। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ অবস্থা থেকে উত্তরনের নানা দিক ও পথ নিয়ে সরকার ও সংস্থাসমূহ আন্তরিকভাবে কাজ করলেই এই নির্মমতা থেকে সমাজ, রাষ্ট্র বেরিয়ে আসতে পারবে।
চলবে
লন্ডন ৫ আগস্ট, ২০২০।
(সশরীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস পর্যায়ের একটি লেকচারের সারাংশর সূত্র অনুসারে)