বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের নাড়ির টানের সম্পর্ক। যে সম্পর্কের জের গ্রোথিত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক আরো গভীরতা লাভ করে। তবে প্রতিবেশী বড় দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশ ও তার আশে পাশের ছোট দেশগুলোর সাথে সমান সুসম্পর্ক বজায় রেখে কূটনীতি চালনার ক্ষেত্রে খুব একটা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে-এমন কোন ট্র্যাক রেকর্ড হলফ করে সহজেই বলা মুস্কিল। এক্ষেত্রে ভারতের আশে পাশের ছোট ছোট দেশগুলর রয়েছে তীক্ত অভিজ্ঞতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুহাত ঢেলে বিশ্বাসের ভরা বুক নিয়ে ভারতকে যেভাবে ঢেলে দিয়েছেন সব কিছু, বিনিময়ে ভারত সেভাবে বাংলাদেশের সাহায্যে সহযোগীতায় এগিয়ে আসেনি, যদিও কাগজে কলমে ভারত অনেক কিছুই বাংলাদেশকে দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সেটা দুই দেশের শীর্ষ নেতারাও মনে করেন। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা, দুই দেশের মধ্যে বিশাল ব্যবধান।
০২) হালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার কূটনীতি ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই পূর্বদিকের দেশ চীনের দিকে প্রসারিত করেন। শেখ হাসিনার চীন কূটনীতির ধারাবাহিকতায় প্যানডেমিকের সময়ে বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায়। লাদাখে চীন-ভারত উত্তেজনা যেমন বৃদ্ধি পায়, অপরদিকে নেপাল-ভারত তীক্ততাও বৃদ্ধি পায় নাটকীয়ভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রিন সিগন্যালে সবার অগোচরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন ও পাকিস্তানের কূটনীতিকের মধ্যে আচমকা এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যেকার যোগাযোগের ঐক্যমত্য হওয়ার সাথে সাথেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্বল্প সময়ের মধ্যে দুইবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার আহবান জানান।
০৩) এরই মধ্যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের স্পর্শকাতর ও উত্তরাঞ্চলের বাচা মরার প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে পানির ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে বিগত ১২ বছরের মধ্যে ভারত দিবে দিবে করে কোন সদিচ্ছাই দেখায়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও ভারত বাংলাদেশকে কোন সহযোগিতা করেনি, আশ্বাস দেয়া ছাড়া। এতোবড় মহামারী সারা বিশ্বের আঘাত করছে, যার ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পরেছে, অথচ নয়াদিল্লি প্যানডেমিকের বিপদের সময়ে কোন সাহায্যের হাত নিতে এগিয়ে আসেনি-যদিও শেখ হাসিনার হয়ে তার ফরেন মিনিস্টার প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তের সকল কাউন্টার ও নেতাদের কাছে ঢাকার জন্য লবিং এবং দেন দরবার করছেন প্রতিদিন বিরামহীনভাবে। বাংলাদেশের লাখো প্রবাসী যখন প্রায় ফেরত আসার উপক্রম এবং নানা প্রান্তে আটকে মানবেতর জীপন যাপন করছে, নয়াদিল্লি সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী ঘনিষ্ট দেশ হিসেবে বিমান সহযোগিতা দিয়েও এগিয়ে আসেনি। এমনি এক ত্রাহি অবস্থায় চীন দ্রুততম সময়ের ভিতরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহবানে শুধু সাড়া দেয়নি-বিশাল সাহায্যের প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে আসে। বাণিজ্যের ক্ষত্রে যেমন যুগান্তকারি এক প্যাকেজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধের মাত্র দুদিনেরও কম সময়ের ভিতরে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে ঘোষণা দেয়, তেমনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বাচা মরার প্রকল্প তিস্তা প্রকল্পে মিলিয়ন ডলারের সাহায্য দেয়ার ঘোষণাও দেয়। সেটাও প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের মাত্র চারদিনের মাথায় চীন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। চীন এখানেই থেমে থাকেনি। বিশ্ব যখন করোনার ভ্যাকসিনের দৌড়ে প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত, আস্ট্রাজেনের সহায়তায় ভারতের সেরেম ইনস্টিটিউট যখন মিলিয়ন ডোজ নিশ্চিত করে ফেলেছে, তখন বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ব্যাপারে ব্রিটেন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই যখন ইতিবাচক কোন মন্তব্যও করেনি, তখনি চীন তার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল নিয়ে শুধু এগিয়ে আসেনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধের ৩ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে সব চাইতে শক্তিশালী এবং উচ্চ ক্ষ্মতাসম্পন্ন চীন সরকারের হেলথ ভিজিটরস টেকনিক্যাল টিম বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয় এবং ভ্যাকসিন বাংলাদেশ প্রথম দেয়ার কথাও ঘোষণা দেয়। ঠিক একই সময়ে নেপালের এবং ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করলে জলবিদ্যুত প্রকল্প প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুক্তি সম্পন্নের তাগিদ দেন।ইতোমধ্যেই জলবিদ্যুত প্রকল্প আলাপ তুঙ্গে উঠে, ঠিক সেই সময়েই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। চীন যখন তিস্তায় ১০০ হাজার মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়, ভুটান নেপালের সাথে জলবিদ্যুত প্রকল্প যখন চূড়ান্ত লাভ করে, ইসলামাবাদ-ঢাকা যখন সম্পর্ক উন্নয়নে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করে, নয়াদিল্লি তখন নড়ে চড়ে উঠে।ইতোমধ্যে শ্রিলংকার ভারত নীতিতেও পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে যায়।
০৪) ওয়াশিংটনের অভাল অফিসেও ঢাকার কূটনীতি ও অর্থনৈতিক কূটনীতির নয়া দর্শন নিয়ে হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে যায়। দ্রুততম সময়ের ভিতরে সিগন্যাল চলে আসে নয়াদিল্লিতে। নেপাল, চায়না, পাকিস্তানের পর ঢাকাও নয়াদিল্লির জন্য হয়ে উঠছে অনুর্বর এক স্থান যা দিল্লির জন্য অশনি সংকেত। নয়াদিল্লি তখন সব কিছু পেছনে ফেলে অর্থনৈতিক সাহায্য, বাণিজ্যের ভারসাম্য, আর করোনা ভ্যাকসিনের বিশ্বের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য অক্সফোর্ড আস্ট্রাজেনেকার সেরেমের ভ্যাকসিনের লোভনীয় অফার নিয়ে ঢাকায় প্রেরণ করে তার বিদেশ সচিব শ্রিংলাকে। নয়াদিল্লি সম্পর্ক বাণিজ্যের উন্নয়নের রোড ম্যাপ শ্রিংলার হাতে দিয়ে একদিকে বিশেষ বিমানে পাঠিয়ে দেয়, অপরদিকে শ্রিংলার বার্তা ঢাকায় যাতে গ্রহণযোগ্যতা পায় সেজন্য ঢাকার ভারতীয় ও মার্কিন দূতাবাসকে দৌড় ঝাপে কাজে লাগায়। নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের চিন্তার রেখা তখনও দূর হয়নি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতর থেকে ক্লিয়ারেন্স বা সাক্ষাতের নিশ্চয়তা ভারতীয় দূতাবাস শ্রিংলার ফ্লাই কালিন সময় পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে শ্রিংলা যখন প্লেনে, দূতাবাস ও নয়াদিল্লি তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতর থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে যায় শ্রিংলার সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত হচ্ছে, তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত হচ্ছেনা। শেখ হাসিনা এবার এক তাসে দুই চাল দিয়ে রাখলেন। সচিব পর্যায়ের বৈঠকের শীর্ষ আলোচনার ফলাফল দেখা যেমন জরুরী, তেমনি শেখ হাসিনার হয়ে মোমেন কূটনীতির অর্থনৈতিক কূটনীতির শীর্ষে চায়নাকে সামনে রেখে কূটনীতির সূক্ষ্ম এক চাল চাললেন, যা ওয়াশিংটন খুব তীক্ষ্ম নজরে রাখছে। ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতি যিনি বিশ্লেষণ করেন সীমা গুহ এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিশ্লেষক সহ ওয়াশিংটন নয়াদিল্লির শীর্ষ বিশ্লেষকেরাও এই মতের অনুসারী। বিপরীতে আরও কিছু কারণ এবং মতও রয়েছে, যা এই মুহুর্তে খুব একটা প্রযোজ্য নয় বলে মনে হয়। যদিও শ্রিংলার ঢাকা সফরের পর ভারতের সব কটা পত্র পত্রিকা ও মিডিয়া ঢাকা নয়াদিল্লির সম্পর্ক উচ্চমাত্রায় বুঝাতে গিয়ে ঢাকাকে ভাগে রাখতে চীনের ভ্যাকসিন কাজে লাগেনি বলে রিপোর্ট প্রকাশ করে উল্লাস প্রকাশ করেছে। ঢাকা কিন্তু প্রতিক্রিয়ার মাত্রায় বরাবরের মতোও সেই আগের মতোই আছে। কোন ছন্দ পতন কিংবা অতি উচ্ছাসা প্রকাশ করেনি যেমনটা ভারত করছে। কারণ ভারতের প্রকাশ করা দরকার। এখন ঢাকার করা দরকার নেই। কারণ ঢাকার জন্য এখন অনেক দরজা খোলা। যে দরজা দিয়েই ঢাকা যাবে, সেই দরজা দিয়েই সফলতা।
০৫) প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে শ্রিংলা সম্পর্কের উন্নয়নের ও বাণিজ্যের সহযোগিতার ও ভারসাম্যের এবং ভ্যাকসিন কূটনীতির প্যাকেজের বাইরেও আরো দুটি প্যাকেজ রেখেছেন। যার একটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের ৮০টিরও দেশের কূটনীতিকদের প্রতি সহযোগিতার আহবানের প্রেক্ষিতে চীনের আগেই নয়াদিল্লি ও ওয়াশিং টনের হয়ে নয়াদিল্লি সাড়া দিতে চায়। প্রয়োজনে একজন থেকে দুজনকে শীগ্রই ঢাকার কাছে হস্তান্তরের ব্যাপারেও ছক পরিকল্পনা ঢাকার টেবিলে ছোট্র সেই বিশেষ বাক্সের মধ্যে রেখে গেছেন। দ্বিতীয় কারণটি এখনো খোলাসা করার মতো যথেষ্ট প্রয়োজনীয় সময় হয়নি, যা ঢাকা-নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটনের জন্য বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ । এর বাইরেও আরো একটি স্ট্র্যাটেজী রয়েছে-যা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ওয়াশিংটনের জন্য ঢাকা খুবই জরুরী। ভারত হয়তো সম্পর্ক ঝালাই করেই সেটা সামনে আনবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দক্ষ নাবিক। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তড়িৎ সঠিক চাল এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ এক রাষ্ট্রনায়োকোচিত ক্ষমতার অধিকারী-যা বিশ্ব দরবারে তাকে করে তুলেছে আরো সম্ভাবনাময়ী এবং করিৎকর্মা এক সরকার প্রধান হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনীতির চালের ও নয়া অর্থনৈতিক দর্শনের অগ্রভাগে রয়েছেন আবদুল মোমেন ও তার টিম। ঢাকা এখন আগের যেকোন সময়ের তুলনায় কূটনীতি ও বার্গেইনিং পয়েন্টে খুব দক্ষ এবং শক্তিশালী। নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটন সেটা খুব ভালো করেই অবগত। সেজন্য আধুনিক উন্নত যোগাযোগের সকল মাধ্যম সত্যেও তড়িঘড়ি করে শ্রিংলাকে ঢাকায় প্রেরণ করে ঢাকার কূটনীতির কৌশলে শুধু জানানই দিলোনা, গুরুত্ব ও ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ঢাকার ভুমিকা যে অনস্বীকার্য সেটাও বুঝিয়ে দিলো।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টিমও পোড় খাওয়া দক্ষ নাবিক। কথার মারপ্যাচে ঢাকা মজতে চায়না। ঢাকার টেবিলে সম্পর্ক ও সহযোগিতার চালে নয়াদিল্লির সাথে চায়না পাকিস্তান রাশিয়া ইরান তুরষ্ক ওয়াশিংটন ব্রিটেন ইইউ, সৌদি আরব, আমিরাত, এমনকি ইসরাইলকেও সমানবভাবে রেখে দিলো।
চলবে
লন্ডন, ২১ আগস্ট ২০২০।