আল্লামা খলিলুর রহমান বর্ণভীর সাথে আমার স্মৃতিঃ (০১)

আল্লামা খলিলুর রহমান বর্ণভীর সাথে আমার স্মৃতিঃ (০১)

সিলেট তথা উপমহাদেশের তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এবং বয়োজ্যেষ্ট মুরুব্বী ও ইসলামিক এক বিশাল চিন্তাধারা ও ঐতিহ্যের অধিকারি ছিলেন মরহুম শায়েখ লুতফুর রহমান বর্ণভী। সেসময় সিলেট তথা বৃহত্তর সিলেটের আলেম উলামাদের সকল মিলনস্থলের কেন্দ্রে ছিলেন শায়েখ লুতফুর রহমান বর্ণভী। আপেলের মতো টকটকে লাল এক অসম্ভব সৌম্য  শান্ত ও অনাবিল সুন্দর চেহারার অধিকারি ছিলেন মরহুম শায়েখ। সব সময় মুখে হাসি মেখে রাখতেন, কথা যখন বলতেন তখন পিন পতন নিরবতা পালন করতেন সবাই এবং কথা নয় যেন কোরানের মুক্তো মণি মালা ঝড়ে পরতো চতুর্দিকে। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। আমার আব্বার সাথে বিশেষ এক মহব্বত এবং আত্মিক সম্পর্কের সুবাধে কাছে থেকে শায়েখকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। সৈয়দপুরে আসলেই শায়েখ আমাদের বাড়ির মেহমান হতেন। তখন অসংখ্য আলেম উলামা এবং কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ বৃহত্তর সিলেটের নানা প্রান্ত ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসতেন শায়েখের সান্নিধ্য লাভের জন্য। শায়েখ যখন আমাদের বাড়িতে সবাইকে নিয়ে খেতে বসতেন, সাথে আমাকেও মরহুম লুতফুর রহমান বর্ণভী উনার সাথে একই প্লেটে খেতে বসাতেন। শায়েখের সাথে অসংখ্যদিন একই প্লেটে দুধ ভাত খাওয়ার বিরল এক সৌভাগ্য ও গৌরবের অধিকারী হয়েছিলাম।খাওয়া দাওয়া শেষ হলেই শায়েখ সমস্ত আলেম উলামাদের সামনে আমাকে বলতেন সুরা ফাতেহা শুনাতে। আমিও শায়েখের কথা মতো সুরা ফাতেহা শুনাতাম। আর বলা যায় এভাবেই শায়েখের মুখে মুখ মিলিয়েই আমার কোরান তেলাওয়াতের শিক্ষা শুরু হয়ে যায়। আমার কোরান তেলাওয়াতের শিক্ষা সাহেবজাদা শায়েখ খলিলুর রহমান বর্ণভীর উপর বর্তায়। শায়েখ খলিলুর রহমানের কাছ থেকে শিখে নিয়ে আবার শায়েখ লুতফুর রহমান বর্ণভীকে তেলাওয়াত সবার সম্মুখেই শুনাতে হতো। সে এক অভাবনীয় এক দৃশ্য। শায়েখ এবং সাহেবজাদার বড় শখ ছিলো আমি কোরানের শিক্ষায় শিক্ষিত হব। কিন্তু আমার পরিবার, মামাদের আবদার ছিল আমাকে প্রচলিত শিক্ষাধারায় লেখা পড়া করেই বড় হতে হবে, সেই সাথে ধর্মীয় শিক্ষাও ।

সাহেবজাদা উনার বাবার আদর্শের এক মূর্ত প্রতিক- বলা যায় এক অবিকল কপি। আমাকে উনি ভাই বলেই ডাকতেন। আমিও উনাকে আপন বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধার সাথে এই বুজুর্গ এবং শায়েখকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতাম। সব সময়ই করি। উনি সিলেটে আসলে আমাকে ও আব্বাকে না দেখে যেতেননা। বলা যায় উনার পিতার মতোই। প্রতি ঈদে আমাদের জন্য নতুন কাপড় পাঠাতেন। আমাকে লিখতেন মাঝে মধ্যে, নীচে লেখতেন তোমার ভাই খলিলুর রহমান।

আমার জীবনের কঠিণ দুঃসময়ে আল্লামা খলিলুর রহমান আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম নসিহতের সাথে সবর আর ধৈর্যের কথা শুনাতেন।এমন দরদী আলেম আমি আমার জীবনে কখনো দেখিনি। এতো খ্যাতি, এতো নাম-অথচ মাটির মতো এক সুন্দর মানুষ, শিশুর মতো এক কোমল মন। পিতা যেমন ছিলেন সাম্য সৌম্য ও সুন্দরের এক সমারোহ তেমনি ছেলেও ছিলেন ঠিক সেরকম। এ যেন আল্লাহপাকের এক অনাবিল আনন্দময় সৃষ্টি। পিতা পুত্রকে কখনো সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখিনি।এমন অসাধারণ এক সুন্দর চরিত্রের অধিকারি ছিলেন পিতা ও পুত্র।

প্রচন্ড কষ্ট পেলেই আধ্যাত্মিক ও রুহানি জগতে আল্লামা খলিলুর রহমান বর্ণভী হাজির হয়ে যেতেন আল্লাহপাক এবং রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অমিয় বাণী নিয়ে।

শায়েখ অসুস্থ্য ছিলেন জানতাম, যোগাযোগ ছিলো। আশা ছিলো আল্লাহপাক সিলেটের বৃহত্তর  স্বার্থ এবং  হক্কানি আলেম উলামাদের স্বার্থে শায়েখকে হয়তো আল্লাহপাক আমাদের কাছে আরো কিছুদিন দিবেন। কিন্তু মৃত্যুর স্বাদ প্রত্যেককেই নিতে হয়।

শায়েখের যেদিন জানাজা, গ্রিনিচ মানের সময়ে আমি তখন ঘুমিয়ে পরেছি। সোবহানাল্লাহ, শায়েখ তখন এসে হাজির। আমি বলে উঠলাম আজ আপনার জানাজা… শায়েখ উনার পিতার মতোই স্মিথ হেসে বললেন, আমার ভাইকে না দেখে যাই কি করে….আমি আল্লাহু আকবার বলে উঠলাম।

 

হে আল্লাহ, আমার মালিক এবং খালিক, বরেণ্য আলেম পিতা পুত্রকে আপনি জান্নাতুল ফেরদৌসের  বাসিন্দা করুন । উনাদের প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি প্রতিষ্ঠানসমূহের বুজুর্গী বৃদ্ধি করে দিন।  আমিন।

 

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

১০ জানুয়ারি ২০২০, লন্ডন।