যেভাবে ফিরে পেলাম বসে যাওয়া কন্ঠস্বর- (মনে পরে, ফিরে দেখা-১৪)

যেভাবে ফিরে পেলাম বসে যাওয়া কন্ঠস্বর- (মনে পরে, ফিরে দেখা-১৪)

বয়ঃসন্ধির এক পর্যায়ে ( তখন খুব ছাত্ররাজনীতিতে সারাক্ষণ মিছিল শ্লোগানে উত্তপ্ত থাকত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রাজপথ) আমার গলার সাউন্ড ধীরে ধীরে বসে যেতে থাকল। পরিস্থিতি এমন হলো, এক পর্যায়ে কথা বলা, অন্যকে গুছিয়ে বলাটা যেন হিমালয় পর্বতের মতো কষ্টকর হলো। একটু দূরত্বের কাউকেই কিছু বুঝাতে পারতাম না। কথা বলতে গেলেই মনে হলো সমস্ত পৃথিবী গলার স্বরের মধ্যে চেপে বসেছে, আমি পাগলের মতো আপ্রাণ চেষ্টা করছি কিছু একটা বলতে স্পষ্টভাবে কিন্তু পারছিনা। এভাবে আমাকে ১৯টি বছর কষ্টকর এক সময় অতিবাহিত করতে হয়েছিলো। এক পর্যায়ে ধরেই নিয়েছিলাম এটাই আমার নিয়তি। সেজন্য কথা বলার পরিমাণ একান্ত জরুরী না হলে বন্ধ করেই দিয়েছিলাম।

 

আজ মনে পরে, আল্লাহর পাকের এক অপরিসীম রহমত, নেয়ামত আর রাব্বুল আলামীনের মিরাকল দ্বারা ১৯ বছর ধরে গলার সাউন্ডের কষ্ট ভোগের পর স্বাভাবিক সাউন্ড ফিরে পাওয়ার এক বিরল সৌভাগ্যের অধিকারি লাভ হওয়ার। শোকর আলহামদুল্লিল্লাহ। আল্লাহপাকের শোকরিয়া যত আদায় করব, শেষ করা যাবেনা। ১৯ বছর ধরে বিশ্বের নামকরা ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, মেন্টর কতো চেষ্টা করেছেন, কতো উপদেশ মেনে চললাম, চিকিৎসা নিলাম কিন্তু গলার সাউন্ড আগের অবস্থায়(স্বাভাবিক সাউন্ডে) ফিরে পাওয়াতো দূরে থাকুক, দিন দিন অসহ্য যন্ত্রণা ও কষ্ট নিয়ে প্রতিটি মুহুর্ত প্রতিটি ক্ষণ পার করেছিলাম। অনেকেই সেই সময় আমার কথাগুলো ভালো করে বুঝতে পারতেননা-সাউন্ড জটিলতার জন্য।আর অত্যধিক কষ্টের জন্য আমিও তখন অনেক বিষয় এড়িয়ে যেতাম।

শেষ পর্যন্ত অপারেশন টেবিল-সান্ডারল্যান্ড রয়াল হাসপাতাল(তখন সদ্য আসা)। সব কিছু রেডি। কনসাল্ট্যান্ট সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সম্মতি ফর্মে স্বাক্ষরও হয়ে গেছে। রিস্কের বিষয়টিও বুঝিয়ে বলেছেন দক্ষ সার্জন। সফল হলে তাদের জার্ণালে প্রকাশের অনুমতি নিয়ে রেখেছেন। বিফলে ক্ষতিপূরণ দাবী করা যাবেনা, যেহেতু সব পুরোপুরি বুঝিয়ে বলা হয়েছে। এমতাবস্থায় স্থানীয় প্রিষ্টকে নিয়ে আসা হলো। আমি বললাম আমি মুসলমান। আমার জন্য ইমাম সাহেবই সব চাইতে উত্তম ব্যক্তি তওবা বা শেষ বাক্য পড়ানোর জন্য। এই ফাকে হঠাত মনে হলো, অপারেশন না করে মেশিন বক্স ফিট না করে, একবার আল্লাহর দরবারে সেজদাহ পরে শেষ চেষ্টা করি। যেই চিন্তা সেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা জানালে ডাক্তার নার্স সবাই হতভম্ব হয়ে পরেন। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তাই তারা সম্মতি দিতে বাধ্য হলেন।

 

ফিরে এসে নামাজ পরে কোরান তেলাওয়াত করে কায়মনোবাক্যে সেজদাহ গিয়ে আল্লাহর দরবারে কৃতকর্মের জন্য কান্নাকাটি করে শিফা চাইলাম। এভাবে দিনের পর রাতেও একইভাবে চাইলাম সেজদাহ গিয়ে। আল্লাহপাকের কী অপরিসীম রহমত আর কুদরত, আল্লাহর কসম, অসম্ভব এক শিহরণ সারা শরীরে অনুভুত হলো। আমি সেজদাহ থেকে যখন উঠলাম, তখন মনে হলো অসম্ভব এক হালকা পুরো গলার মধ্যে অনুভূত হলো। এতো হালকা মনে হলো ১৯ বছর আগে ঠিক যেভাবে ছিলো, সেভাবে। আমি আবারও শোকর গুজার আদায় করলাম মহান আল্লাহর। স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলা আমার আবার শুরু হলো। এ যে কী আনন্দের এক মাহেন্দ্রক্ষণ ছিলো সেটা বুঝাতে পারবনা।

 

মজার ব্যাপার হলো, আমার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের(স্কুলের নয়)বন্ধুদের কারও সাথে ফোনে কথা হলে, বার বার নাম বলার পরেও চিনতে তাদের কষ্ট হলো। কারণ তারা আমার ভঙ্গুর স্বরের সাথে অভ্যস্থ।

আল্লাহপাকের হাজারও শোকর, অসম্ভব এক মিরাকল দ্বারা আমাকে আমার জন্মের সেই কন্ঠস্বর ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে এখনো কিছুটা প্রেসার মাঝে মধ্যে অনুভূত হয়-যখন অতিমাত্রায় কোন প্রেসার এসে পরে। আলহামদুলিল্লাহ।

 

 

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

২০ জানুয়ারি ২০২১, লন্ডন।