সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ । লন্ডন থেকে । ০৭ মে ২০২২ ।
৫ই মে হয়ে গেলো যুক্তরাজ্যের কাউন্সিলের নির্বাচন। এ নির্বাচনে মোটাদাগের হরফে বলা যায়, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ বেশ বড় ধরনের ধাক্কা খেলেও ওয়াইপআউট হয়নি, আবার বিরোধীদল লেবার পার্টি বেশ ভালো করলেও আশানুরূপ ফলাফল ঘরে তুলতে পারেনি। বটমলাইনে যে কথাটি না বললেই নয়, লিবডেম, গ্রিন পার্টি, শিনফেন অভাবনীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনে ভালো ফলাফল করেছে, যা ব্রিটেনের জনগনকে যেমন তাক লাগিয়ে দিয়েছে, তেমনি আগামীর জাতীয় নির্বাচনের আগাম হিসেব নিকেস নতুন করে ভাবতে হচ্ছে সব দলকেই।
বড় বড় রাজনৈতিক দলের চুলচেড়া বিশ্লেষণ আর বড় বড় কাউন্সিলের ধাক্কা, অভাবনীয় ফলাফলের বিপরীতে পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত তথা তৃতীয় বাংলা খ্যাত টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচনের ফলাফল ঘিরে লন্ডন সহ বাংলাদেশ ও সমগ্র বিশ্বে প্রবাসি বাংলাদেশিদের মধ্যে ছিলো টান টান এক উত্তেজনা। শ্বাসরুদ্ধকর ৩৬ ঘন্টার নির্বাচনী ফলাফলের সময়ে ঢাকা, সিলেট, নিউইয়র্ক, ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে অগণিত ফোন কল বোধগম্য হয়-সবাই কেমন অধীর অপেক্ষায় ছিলেন ফলাফল কী হয়।
ঢাকা থেকে কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জানতে চেয়েছিলেন, গণতন্ত্রের সূতিকাগার লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলে মেয়র নির্বাচনে কীভাবে অগণতান্ত্রিক বা সরাসরি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক ধারাটি সংযোজিত ও এক্সারসাইজ হয়? সেই প্রশ্নের মূল্যায়ন আজ নয়, আজ মোটাদাগে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচনে জন বিগসের পরাজয়, আর লুতফুর রহমানের ফিরে আসা যে কারণে-সেই বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
জনবিগস, লুতফুর রহমান, রাবিনা খান, উইভার, হুগো, অ্যানের অফিসিয়াল পেইজে তাদের নির্বাচনী লক্ষ্য কর্মসূচী পরিকল্পণা, প্রচার, বক্তব্য, ক্যাম্পেইন মূলত এই আলোচনার প্রতিপাদ্য বা ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুটনোটে রাখতে চাই।
নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে জনবিগস ওয়ান ইষ্ট অ্যান্ড-ডিভাইড নয়, ইউনাইটেড এর মতো জনপ্রিয় ও চমকপ্রদ এক শ্লোগান নিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেন।যা তার পুরো টিম তাদের ক্যাম্পেইনে এই শ্লোগানকেই সোশ্যাল মিডিয়া সহ নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করেছেন ফলাও করে। ওয়ান ইষ্ট এন্ড শ্লোগান সুন্দর এবং মানানসই হলেও পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনোজগত, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, শিক্ষা সারণী যখন আমরা দেখি বা এসব তথ্যগুলো যখন সামনে নিয়ে আসি তখন দেখি, বাস্তবে এমন বিশাল এক বড় থিম ও শ্লোগান জাতীয়ভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও স্থানীয় পর্যায়ে এমন থিম, শ্লোগান, ক্যাম্পেইন ছিলো সম্পূর্ণ বাস্তবতার সাথে বিপরীত। কারণ এতোবড় এক শ্লোগান এর জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলোনা বা উপযোগী অথবা প্রস্তুত করা হয়নাই।
বিপরীতে লুতফুর রহমান এবং তার টিম শুরুতে ট্যাক্স, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, হাউজিং- যা এই বারার মানুষের জন্য সবচাইতে বড় জরুরী বিষয়গুলো মোটাদাগের হরফে তুলে ধরে জনগনের হ্নদয়ে খুব দক্ষতার সাথে পৌছে যান। যদিও বিগসের টিমও হাউজিং ইস্যুতে তাদের বক্তব্যে নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু লুতফুর টিমের কাছে সেই ক্যাম্পেইন ছিলো ম্রিয়মান ও অগোছালো এবং দিকনির্দেশনাহীন।
প্যানডেমিকে যুক্তরাজ্য বিশেষকরে টাওয়ার হ্যামলেটসের দল মত নির্বিশেষে এই বারার জনগন দেখেছে মৃত্যুর ও জনজীবনের কষ্টের বাস্তব নির্মমতা। এই বারাতে অনেক পরিবার অসহায়ভাবে দিনের পর দিন যাপন করেছেন। এই বাস্তবতায় লুতফুর রহমান যখন কাউন্সিল ট্যাক্স না বৃদ্ধির কথা বলেন, বারার অধিকাংশ জনগন তখন আশ্বস্থ ও আস্থায় নেন। কারণ এতে লুতফুরের অতীত রেকর্ড তারা বিবেচনায় নিয়েছিলেন। বিপরীতে একই সময়ে কাউন্সিল থেকে কাউন্সিল ট্যাক্স পরিশোধের রেড নোটিশ, হাউজিং বেনিফিট রিভিউয়ের নামে ঐ সময়ে কর্তনের নোটিশ ছিলো বিগসের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সব চাইতে বড় ভুল ডেলিভারি। যে কারণে আমরা দেখি, টাওয়ার হ্যামলেটস বারার কোন মসজিদ, ষ্টেশনে নির্বাচন কেন্দ্রিক কোন ফ্রি পত্রিকা একজন লোকও হাত দেয়নি গত ৩ সপ্তাহ। প্রতিটি জায়গায় ফ্রি পত্রিকাগুলো স্তুপের পর স্তুপ সপ্তাহের পর সপ্তাহ পরে থাকতে দেখেছি, যা পরে ডাস্টবিনে(মাপ করবেন শুধু মাত্র প্রকৃত তথ্য উপস্থাপনের স্বার্থে লিখতে হচ্ছে) ফেলে দেয়া হয়েছিলো। অর্থাৎ এই বারার মানুষ নির্বাচনের সময় জানতে চেয়েছে, কে কাউন্সিল ট্যাক্স বাড়াবেনা আর, কে হাউজিং সমস্যার সমাধান করবে, কে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করবে-এই তিন মেজর ইস্যুতে লুতফুর শুরুতে বাজিমাত করে ফেলেন, যা বিগসের টিম পুরো নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অ্যাড্রেস করতে ব্যর্থ হয়। তারা যতটা না ছিলো লুতফুরকে ব্যক্তিগত আক্রমন করতে ব্যস্ত, লুতফুর টিম ততোটা ছিল কাউন্সিল ট্যাক্স, হাউজিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইস্যুতে মারমুখী ও ব্যস্ত।
জনবিগসের টিমের লিবডেমের সাথে নির্বাচনী সমঝোতা দুষের নয়, অপরাধও নয়। কিন্তু যখন একজন বাঙালি লিবডেমের প্রার্থী হয়ে যান, আর জনবিগস টিম বাঙালি লিবডেম প্রার্থীর টিমের সাথে সমঝোতা করে ফেলেন, ভোটারদের তখন সেটা সহজেই ধরে ফেলেন সেই কৌশল-যা তাদেরকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেখার দরকার পরেনি। জন বিগসের টিমের নির্বাচনী এই স্ট্রাটেজি আপাতঃ দৃষ্ঠিতে দক্ষ কৌশল মনে হলেও বাস্তবে এই বারার নতুন প্রজন্মের ব্রিটিশ বাংলাদেশি তরুন-তরুনীদের বুঝতে এরা ততোটাই ব্যর্থ। কারণ তরুন ভোটাররা এই কৌশল ভালোভাবে নেয়নি। তাদের কাছে নবাব সিরাজের ঘষেটি বেগম উপাখ্যান গুগল মারফত সহজেই আত্মস্থ হয়ে যায়, যা বিগসের পরাজয়কে তরুন ভোটারদের কাছে করে তোলে অবশ্যম্ভাবী।
জনবিগসের প্রেস টিম শুরু থেকেই বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে এবং জনগনের সাথে সম্পর্কহীন। স্ট্র্যাটেজি ও কৌশল এবং নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে পারফর্ম্যান্স খুবই পুয়র। মজার ব্যাপার হলো, নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে কোন প্রেস টিম দ্য, অ্যান, অ্যা এসব ব্যবহারে ব্যতিব্যস্ত-আমার দেখা এটাই প্রথম। বিপরীতে লুতফুরের প্রেস টিম জন সম্পৃক্ততাকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে জনগনের সাথে মিশে যায়, যা লুতফুরের বিজয়কে করে তুলে অবশ্যম্ভাবি।
জনবিগসের টিম লুতফুরকে রাজনৈতিক আক্রমন না করে ব্যক্তিগতভাবে যখন নানা মাধ্যমে আক্রমন ও প্রচারের কৌশলে সময় ক্ষেপণ করে, লুতফুর টিম তখন অত্যন্ত কৌশলে বিশেষ করে তরুন ক্যাম্পেইন টিম বরিস জনসনের লকডাউন নীতিমালা ভঙ্গ, স্টারমারের ডারহাম যাত্রা, আল আকসায় ইসরায়েলি অভিযানে বিশ্ব চুপ, ইউক্রেন রাশিয়ায় সরব-এমন বাস্তব তথ্য ও চিত্র ও পয়েন্ট দক্ষতার সাথে তুলে ধরে ক্যাম্পেইন চালিয়ে যায়।
টাওয়ার হ্যামলেটস বারার সাধারণ ভোটার ছাড়াও বিগসের টিমের ক্যাম্পেইনরদের অনেকেরই কোন স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না ওয়ান ইষ্ট এন্ডের মতো অতি বৈজ্ঞানিক ও অতি আধুনিক ক্যাম্পেইনের। আমি যাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের কারও কোন ধারণাই ছিলোনা। ছিলো দলীয় কোন্দল, রেশারেশি আর চিরাচরিত দোষারোপের রাজনীতি। তার মানেই বিগসের টিম এই মূল ফোকাস করা ক্যাম্পেইন জনগনের কাছে পৌছাতে পুরোপুরি ব্যর্থ, অথচ তৃণমূল পর্যন্ত এতো বিশাল এক জনপ্রিয় দল বিগসের।
এই বারার অলিতে গলিতে কতো অসহায় মানুষ হাউজিং, জব, ইয়থ ফ্রন্টলাইন সার্ভিস, স্বাস্থ্য, বেনিফিট-এসব সমস্যায় নিদারুণ কষ্টের মধ্যে আছেন। তাদের সকলের সম্মিলিত ক্ষোভ, হতাশা তারা নির্বাচনী ব্যালটযুদ্ধে দেখিয়েছেন।সে হিসেব কি কেউ রাখেন। রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড মানুষকে ঘিরেই হওয়া উচিত। মানবতার কল্যাণে সব কর্মকান্ড আবর্তীত হউক, জয় হউক মানুষের।