ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট-পশ্চিমাদের যা ছিলো ভালো, রাশিয়ার জন্য তা ছিলো খারাপ, আজকে রাশিয়ার জন্য যা ভালো, ন্যাটোর জন্য সেটাই খারাপ
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ । লন্ডন থেকে
সেই অতীতের সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্য আর আজকের রাশিয়ান ফেডারেশন-দুই এর মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। সোভিয়েত সাম্রাজ্য ছিলো সমাজতান্ত্রিক, আজকের রাশিয়ান ফেডারেশন ক্যাপিটালিষ্ট। ভ্লাদিমির পুতিন ছিলেন সাধারণ এক গোয়েন্দা, যে কিনা আজকে সারাবিশ্বের বিশেষ করে ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ও শান্তিকামি জনতার কাছে এক ত্রাসের নাম। পুতিন একজন অলিগার্ক, একজন প্রেসিডেন্ট- সেক্রেটারি জেনারেল নন।
গোড়ার দিকে যখন ফিরে তাকাই, সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙ্গে যায়, পশ্চিমা বিশ্ব সহ সবাই কিন্তু উপকারভোগী, কিন্তু কেউ কখনও রাশিয়ার কথা শুনেনি। বলা যায় পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের আগ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব, ন্যাটো এবং ইউরোপ পুতিনের কথায় কান দেয়নি। বরং আমেরিকার ভাষায় কথা বলেছে সবাই। মার্কিনীরা যেমন পুতিনকে বলে, ইয়েস আমরা তোমার কথা শুনলাম, কিন্তু আমরা যা করার সেটাই করব।
২০০০ সালে পুতিন যখন প্রাইম মিনিস্টার হয়ে ক্ষমতায়, তখন ২০০৭ সালে জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ভাষণে সিকিউরিটি প্যাক্ট নিয়ে তার ধারণা ও পরিকল্পণা তুলে ধরলেও ইইউ ও ন্যাটোর কাছে গুরুত্ববহ ছিলোনা- ন্যাটো ও পশ্চিমাদের জোটে মেশার যথেষ্ট চেষ্টা পরিলক্ষিত হলেও ইইউ-ন্যাটো পুতিন ও রাশিয়ার সৈন্যদের রেখে দেয় এর বাইরে। ২০১৬ সালে ফরেন এফেয়ার্স সংক্রান্ত জার্ণাল- পুতিনস পাওয়ার প্লে ইন সিরিয়া( বইয়ের) তথ্য অনুযায়ী, পুতিন যখন ২০১৫ সালে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে পশ্চিমাদের চাপ অগ্রাহ্য করে আসাদের সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য হস্তক্ষেপ করে ও সফল হয়, তখন থেকে ক্ষীণ করে হলেও পশ্চিমাদের কাছে পুতিনকে নিয়ে কিছুটা ভাবনার উদ্রেক হলেও সেটা ছিলো একেবারে নগন্য।
২০০৩ সালে ইরাক যখন আক্রমণ করা হয় পশ্চিমাদের দ্বারা, তখন মাস উইপনস ধবংসের নামে তথাকথিত ডোসিয়ার ও ইউএন রেজ্যুলেশনের এক বছর আগেই বুশ-ব্লেয়ার ক্রোফোর্ডের মিটিং এ ইরাক আক্রমণের পরিকল্পণা করেছিলেন-বিশ্ব মিডিয়া যুদ্ধের বহু বছর পরে সেটা খোলাসা করে দেয়। আবার চীন যখন তাইওয়ানকে নিজেদের করায়ত্ব রেখে দেয়, কিংবা ভিয়েনায় ইরানের সাথে পারমাণবিক আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বসে ফসল ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়, ২০১৪ সালে পুতিন যখন ক্রাইমিয়া আক্রমণ করেন বা ইউক্রেন বিদ্রোহীদের মদদ দেয়, তারও আগে চেচনিয়া অভিযান (১৯৯৪) পরিচালনা করে, ওয়াশিংটন তখনও পুতিনকে নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। ২০১১ পশ্চিমারা লিবিয়া আক্রমণ করে ২০০৩ এর মতো ইরাকের ক্ষমতাসীন সাদ্দাম সরকার পরিবর্তনের স্টাইলে গাদ্দাফী রেজিম পরিবর্তন করে। বিহাইন্ড দ্য সিনে যে পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেল ও ফ্রিডম অব স্পীচ এর কথা বার বার বলা হয়েছিলো সেটা থাকে অধরা। রেজিম নিষ্টুর পন্থায় পরিবর্তন হয় মাত্র।
ফ্লিপবুক যাদের পছন্দ, তাদের জন্য-
https://designrr.page/?id=175795&token=481143073&type=FP&h=3734
আবার প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, ইয়েমেনের জনগন যখন নিষ্টুর ও অমানবিকভাবে গুলি, বেয়নেট খায়, পশ্চিমা গণতন্ত্র থাকে নিশ্চুপ, যেমন দেখা যায় ভেনিজুয়েলার বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিবাদ, সেটা সৌদি আরব কিংবা ইসরাইলের মানবাধিকার লংঘনের ক্ষেত্রে কন্ঠ থাকে নিচু স্তরে।
ফিরে যাই সোভিয়েতের ভাঙ্গনের পরবর্তী সিনারীওতে। সাম্রাজ্য ভাঙ্গনের পর পশ্চিমা গণতন্ত্র ও ইউরোপের উচিৎ ছিলো রাশিয়ার বিশাল সেনাবাহিনীকে পশ্চিমাদের সাথে সংযুক্তির (যোগাযোগ) মাধ্যমে আধুনিক(বিহেভ) ও উন্নত(পশ্চিমা স্টাইল) করা। ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখা। সেটা না করে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে শুধু, বিপরীতে পুতিন নিজের এনার্জি সাম্রাজ্যকে পূঁজি করে একের পর এক এনার্জি বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছে এক দুর্ভেদ্য বাহিনীতে। পুতিনের নিজেরও সম্পদ বলা যায় পশ্চিমাদুনিয়ার যেকোন সম্পদ শালী ব্যক্তির চাইতেও বহুগুণ। ব্রিটেন কিংবা ওয়াশিংটন ও ন্যাটোর জেনারেলরা বরাবরই রাশিয়ান সৈন্যদের নিয়ে ঝোঁক ছড়িয়েছে বেশী- যা তাদের গুরুত্ব দেয়া যখন বেশী প্রয়োজন ছিলো।
২০১৫তে সিরিয়া ইনভেইডের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পুতিন, ইরান, সিরিয়া, চায়না, নিকারাগুয়া, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, বেলারুশ নিয়ে নিজের অলিগার্কি বাস্তবায়নের দিকেই এগিয়ে যাননি, বিশ্বকেও জানিয়ে দেন রাশিয়ান ফেডারেশন তার কট্রর জাতীয়তাবাদী নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে পরিকল্পণা সুদূঢ় পর্যন্ত, যা আজকে এক সময়ের পশ্চিমারা যে থিওরী, যে ভাষায় বিশ্বের নানা প্রান্তে হস্তক্ষেপ ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিলো, সেই একই কায়দায়, একই স্টাইলে, একই থিওরীতে পুতিন আজ স্বাধীন ইউক্রেন অভিযান পরিচালনা করছেন এবং প্রকাশ্যেই পশ্চিমাদের শেখানো সেই বুলি তিনি আওড়াচ্ছেন।
গত বছর যখন হঠাৎ করে কাবুলে মার্কিনীদের পতন হয়ে যায়, তড়িঘড়ি করে কাবুল ত্যাগ করে, মার্কিনীরা জানতো এভাবে কাবুল ত্যাগের ফলে সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানে তালেবান ফিরবে, জেনে শুনেই সেখান থেকে ত্যাগ করে কাবুল সরকারকে চরম বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে আসে , তখনো কিন্তু ইরান ইন্টেলিজেন্স ছাড়া কাবুল গ্রাউন্ডে কারও উপস্থিতি ছিলোনা, যারা সব সময় তালেবানের পক্ষে কাজ করছে।
পরিবর্তীত বিশ্বে একদিকে আছে রাশিয়ান ফেডারেশন, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব ন্যাটো, বিপরীতে আছে চায়না। বছর খানেক আগেও বিশ্ব সিনারীও দুই শিবিরে ভাগ হয়ে পরেছিল, সেটা এখন তিন শিবিরে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। তিন শিবিরের এক ডেড এন্ডে রাশিয়ার পুতিন আজ ইউক্রেন রেজিম পরিবর্তনের অভিযানে নিউক্লিয়ার পাওয়ার ব্যবহারের প্রচ্ছন্ন হুমকী দিয়েছেন। কারণ পুতিন জানেন, নিউক্লিয়ার পাওয়ার ছাড়া ন্যাটো যুদ্ধে জড়াবেনা। সেই হুমকীতে পুতিন পশ্চিমাদের সেই ইনভেইডের থিওরী সফলভাবেই বলা যায় সেই সব রিভার্স থিওরীই সামনে নিয়ে এগুচ্ছেন- সোভিয়েত সাম্রাজ্যে যা ছিলো রাশিয়ার জন্য ভালো, সেটা ছিলো পশ্চিমাদের জন্য খারাপ, আর আজকে যা রাশিয়ার জন্য যা ভালো, সেটাই ন্যাটোর জন্য খারাপ। বিশ্বের তিন শিবিরের রাজনৈতিক যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক কূটকৌশল আর রেজিম চেইঞ্জের খেলায় পৃথিবীর সব প্রান্তকেই ছুবে, ভোক্তভোগী কমবেশী সবাই হবেন। ইউক্রেন অভিযানে অর্জনের চেয়ে ক্ষতি ও বিশ্ব মানবতার হত দরিদ্র দশাই খোলাসা হবে বৈ কিছু হবেনা।
এডিটর, দ্য লন্ডন টাইমস
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, লন্ডন ।