নড়াইল সাভার কিংবা দেশের অন্যত্র সব খানেই একই চিত্র আজ। কেন কেন?
নড়াইলের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মোবাইল আনা বন্ধে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও কোনো শিক্ষার্থীর কাছে মোবাইল পাওয়া গেলে, তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ছায়েদুর রহমান জেলার সব স্কুল-কলেজের প্রধানদের এমন নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।
চিঠিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহারে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবহার বাড়ায় উদ্বেগ জানানো হয়। একই সঙ্গে ঈদুল আজহার ছুটির পর নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবক সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে যারা শিক্ষকতা করেন তারাই জানেন বর্তমানে শিক্ষকতা কতটা চ্যালেঞ্জিং পেশায় পরিণত হয়েছে এবং কতটা চাপে তাদের কাজ করতে হয়। শিক্ষকদের আর্থিক চাপতো লেগেই থাকে, এখন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে শিক্ষক লাঞ্ছনা এবং নির্যাতন। তুচ্ছ এবং সাজানো ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের লাঞ্ছনার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শিক্ষকদের এই অপমান কি জাতির জন্য লজ্জা নয়? যে শিক্ষক দেশ ও নাগরিক গঠনে কাজ করে চলেছেন তার এ অপমান পাওনা?
কোন মানুষ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কোন শিক্ষক যদি অন্যায় করে থাকেন তবে আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে; কিন্তু শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা, অপমান করা কি রাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর নয়? নড়াইলে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো কি সমগ্র জাতির জন্য লজ্জার নয়? কেউ যদি অন্যায় করে সেটা তদন্তসাপেক্ষে বিচার হবে; কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রতো কাউকে দেয়নি।
শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর সেই দৃশ্য মানুষ ভুলেনি। ২০১৩ সালে পাবনায় একজন ছাত্র তথাকথিত অভিযোগে শিক্ষককে দুই হাতে ইট দিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সাভারে কলেজ শিক্ষককে এক বখাটে ছাত্র পেটালো। হাসপাতালে তার মৃত্যু হলো। ওই শিক্ষক ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করেছিলেন।
শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে মারধর করা হলো। আশালতা নামের আরেকজন শিক্ষিকাকে মিথ্যা অভিযোগে সাম্প্রদায়িকতার তকমা লাগানোর চেষ্টা করা হলো। বাংলাদেশের শিক্ষকরা আর্থ- সামাজিকভাবে কতটা ভালো থাকেন তা সবাই জানে। কৃমিকীটে খাওয়া দগ্ধ লাশের চেহারা তাদের বেতন কাঠামোর। শিক্ষকরা আর্থিক বঞ্চনার শিকার। তবুও জাতি গঠনে তারা কাজ করে চলেছেন। কিন্তু তাদের প্রাপ্তি কি এই অপমান? সামান্য বেতনের দাবিতে প্রেসক্লাবে এসে শিক্ষককে মরিচের গুঁড়ার নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছে। শিক্ষকদের এ ধরনের লাঞ্ছনা কি জাতির বিবেককে নাড়া দেয় না।
আসলে শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষায় সেই ধরনের কোন প্লাটফর্ম এখনো গড়ে ওঠেনি। শিক্ষক সমিতির নামে যে সংগঠনগুলো কাজ করছে তারাও তেমন কিছু করতে পারছে না। কেননা এই সমিতিগুলো লেজুড়বৃত্তি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ আর অপরাজনীতির জালে আটকা পড়ে আছে। শিক্ষকদের হয়রানি করা হয় বিভিন্নভাবে। সেগুলোর মধ্যে আর্থ-সামাজিক নির্যাতন এবং মনো-দৈহিক নির্যাতন অন্যতম। জরিমানা, বেতন না দেয়া, অপমান, বরখাস্তকরণ, হামলা-মামলাসহ নানাভাবে তাদের অপদস্ত করা হয়।
শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলছেন সব ক্ষেত্রে সহনশীলতা আর নৈতিক মূল্যবোধের অভাব বড় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“তবে এই টানাপোড়েনের জন্য কোন এক পক্ষকে দায়ী করা ঠিক হবে না। এখানে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক দরকার যারা শিক্ষার্থীদের সামনে রোল মডেল হয়ে উঠবেন। শিক্ষকদেরও যেমন শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম ভালোবাসতে হবে তেমনি ছাত্রদেরও তাদের শিক্ষকদের মানতে হবে
পত্রিকায় মাঝে-মধ্যেই শিক্ষকদের অপমান করার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। শিক্ষককে মেরে শিক্ষা কায়েম করার অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদেরও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কেরও দিনে দিনে অবনতি হচ্ছে। এটা মোটেও ভালো দিক নয়। একটি বন্ধুসুলভ বন্ধন তাদের মধ্যে কাম্য। শিক্ষককে অপমান করার অর্থ পুরো জাতিকে অপমান করা। তাই শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। শিক্ষকেরা যেন স্বস্তিতে এবং নিরাপদে শিক্ষকতা করতে পারেন- সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়(সংকলিত) ।