সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
কোন প্রকারের ভনিতা না করে সরাসরি যে কথাটা না বললেই নয়, আমি বড় সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন, যে সৈয়দপুর হাইস্কুলে লেখাপড়া করার বিরল এক গৌরবের অধিকারি। বিরল এই গৌরব এই কারণে যে, আমাদের সময়ে, যখন লেখাপড়ার প্রতি সমাজে জোক ছিল খুব নগন্য, গোষ্টী, দলবাজী, লাঠিবাজী, আর বিদেশ গিয়ে উপার্জন করাটাই ছিল প্রাধান্য। আজকের মত যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়ন তেমন কিছুই ছিলনা। ছিলনা কম্পিউটর, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, আইপ্যাড, মোবাইল, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব-এসবের বালাই ছিলনা।মানুষের মধ্যে আজকের মত যান্ত্রিকতার প্রাধান্য ছিল নগন্য। বলা যায় ছিলইনা। টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল বেশ কষ্টসাধ্য।তখন কেবল টেলিগ্রাম(সাদা একখান কাগজে ছোট্র দু হরফ, আর ডাক যোগে চিঠির আধিক্য ছিল প্রচুর। ডাক বিভাগই ছিল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। আর এখনকার মত গুগলে এক ক্লিকে সারা বিশ্বের সর্বশেষ খবর যেভাবে জানা যায়, তথ্যের আদান প্রদান যেভাবে সহজে করা যায়, নোটস, ফুট নোটস, রেফারেন্স, জার্ণাল, বুক যেভাবে সহজে পাওয়া যায় ক্লিকের নাগালে, সেরকম কোন কিছু ছিলনা আমার সৈয়দপুর হাই স্কুলে।
তবে সে সময়ে যা ছিল, আমার ছোট্র মনে সেদিন যা দাগ কেটেছিল, যাদের সাহচর্যে জ্ঞান বিজ্ঞানের দার আমাদের দারগোড়ায় এসে পৌছেছিল অবলীলায় এবং সহজে, যাদের কথা না বললেই নয়, তাদের মধ্যে হেড মাস্টার আব্দুল মতিন স্যার, মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, নজমুল হোসেন চৌধুরী মাস্টার, জসীম উদ্দীন, মোহাম্মদ জহীরুল হক, মোহাম্মদ মমতাজ, শামসুল ইসলাম, মুনীর হোসেন, সিরাজ উদ্দীন, আব্দুস সামাদ, বশীর আহমেদ বিএসসি, এস এম সোলায়মান, সুখেন কুমার সাহা, আব্দুল হক, মাওলানা আমীরুল ইসলাম অন্যতম। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিরলস প্রচেষ্টার ফলে তখনকার সময়ে সৈয়দপুর হাই স্কুল জ্ঞান গরিমা, খেলা ধুলা, শরীর চর্চা, সর্বক্ষেত্রে অভাববনীয় সাফল্য সৃষ্টি করে সমগ্র থানা জেলা ও মহকুমার মধ্যে এক ব্যতিক্রমধর্মী গৌরবের অধিকারি হয়ে উঠেছিল। আমাদের সময়ে স্কুলের পরীক্ষা ও বোর্ড পরীক্ষায় একটি গ্রামীণ পরিবেশের স্কুল রেকর্ড সৃষ্টি করে তাক লাগিয়ে দেয়ার মত ঘটনাগুলো ছিল মুখে মুখে। ছাত্র ছাত্রীদের গ্রামের সকল লোকজন এবং গ্রাম ছাড়িয়ে আশে পাশের সকলেই অত্যন্ত স্নেহ এবং সমীহের চোখে দেখতেন, যা ছিল আমাদের সময়ে এক শ্রেষ্ট পাওনা।
(চ্যানেল আই ইউকে ইউরোপের আমার এক্সক্লূসিভ অনুষ্ঠানে তখনকার প্রেস মিনিস্টার নাদিম কাদির)
আমার স্ক্ল সৈয়দপুর হাই স্কুলে ম্যানেজম্যান্ট কমিটির সকলেই ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক এবং ছাত্র ছাত্রীদের জ্ঞান বিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য সহায়ক এক শক্তি। ম্যানেজম্যান্ট কমিটির প্রয়াত সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ফখরুল, প্রয়াত সৈয়দ আর্জুমান্দ আলী, প্রয়াত সৈয়দ আব্দুল মান্নান মাষ্টার, প্রয়াত আমার পিতা সৈয়দ জাহাদার মিয়া, খালিক মিয়া চেয়ারম্যান, প্রয়াত মল্লিক সিদ্দেক আহমদ সকলেই ছিলেন স্কুলের লেখা পড়া এবং স্কুল সুষ্টুভাবে পরিচালনায় অত্যন্ত আন্তরিক। সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ফখরুল মাঝে মধ্যে স্কুল ক্লাস চলাকালীন সময়ে হাজির হয়ে ছাত্র ছাত্রীদের সমসাময়িক বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতেন, যা অনেককেই জ্ঞান আহরনে অনুপ্রাণীত করতো।
আমার তথ্যের মধ্যে যদি কোন অতিরঞ্জিত না হয়ে থাকে এবং আমি যদি ভুল না করে থাকি, তবে যতটুকু মনে পড়ে, ষষ্ট শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাসে ১ অথবা ২ নম্বর আমি এবং আমার প্রয়াত বন্ধু আব্দুস সবুরের মধ্যে হতো। শিক্ষকবৃন্দও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতেন কিভাবে আমাদের দুজনের একজনকে সামান্য কম নম্বরে হলেও রেজাল্টে প্রথম স্থান আটকে দেয়া যায়-উত্তরপত্র অত্যন্ত নিখুতভাবে দেখার কথা বার বার আমাদের দুজনকে এমনভাবে ক্লাসে জানিয়ে দিতেন, যেন সারা বছরই আমরা দুজন লিপ্ত থাকতাম, কিভাবে ভুল ভ্রান্তি এড়িয়ে গিয়ে কত বেশী নতুন তথ্যের সমারোহ উত্তরপত্রে করা যায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের ইংরেজির শিক্ষক হেড টিচার প্রয়াত মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং ভুগোলের শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন স্যার অসাধারণভাবে ছাত্র ছাত্রীদের প্রেষিত করতেন দারুণভাবে। খেলাধুলার ক্ষেত্রে জসীম উদ্দীন স্যারের প্রচেষ্টায় থানা ও জেলা ব্যাপী বেডমিন্টন প্রতিযোগিতায় সৈয়দপুর হাইস্কুল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারাটাও ছিল আমার স্কুল সৈয়দপুর হাই স্কুলের আরো এক গৌরবের উপাখ্যান মাত্র।
আবহাওয়া এখনকার মত এতো দরদী ছিলনা। শীতকালে যেমন প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল, গরমে তখন অসম্ভব গরম পরত। টিনের স্কুলের ক্লাস্রুম গরমে তখন আমরা অতীষ্ট হতাম। প্রচন্ড গরমে টিউবওয়ে্লের পানি পান করা ছাড়া সেসময় ব্রেক টাইমে কোন কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা স্কুলে ছিলনা। আবার খাওয়ার জন্য বাড়ি কিংবা বাজারে গেলে নামাজের সময় চলে যেত, যা ইসলামী শিক্ষার স্যার পরের ক্লাসে কৈফিয়ত চাইতেন, শাস্তিও পেতে হত। এমনি সময়ে আমার স্কুলে বেড়াতে এলেন লন্ডন প্রবাসি সৈয়দ খালেদ মিয়া অলিদ। ম্যানেজম্যান্ট কমিটির অন্য সদস্যদের ফাঁকে হেড টিচারের সামনে লন্ডন প্রবাসি সৈয়দ খালেদ মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি নিজ উদ্যোগে গ্রামেরই রজব আলীকে স্থানীয় ফান্ড সরবরাহ করে ছোট খাটো দোকানের ব্যবস্থা করে দিলেন, যাতে স্কুল ব্রেকের সময়ে ছাত্র ছাত্রীরা চা বিস্কিট এবং সেই সাথে শিক্ষকদের জন্যো চায়ের সুন্দর এক ব্যবস্থা চালু হল। সেজন্য ধন্যবাদ দিয়ে সৈয়দ খালেদ মিয়া অলিদকে খাটো করতে চাইনা।
(নানা বাড়িতে মামা প্রয়াত সৈয়দ শাহ কামাল চৌধুরীর সাথে)
আমাদের সময়ে স্কুলে পড়া লেখার পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষমূলক কর্মকান্ড ছাত্র ছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ মিলে যৌথভাবে পালিত হত। আমার জানা মতে, আমাদের সময়ে আমরা সাদা কালো বিটিভির বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুসরন করে আমাদের স্কুলে সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। সেজন্য বিজয়ীদল ও দলনেতাকে পুরষ্কৃত করা হত, স্কুলের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতার সময়ে সেরা তার্কিক হিসেবে জাতীয় দিবসের উপর বক্তব্য রাখার সুযোগ জহীরুল হক সরকার স্যার এবং জসীম উদ্দীন স্যার চালু করেছিলেন।
সৈয়দপুর বাজারে তখন বিশাল কাপডের (দোকান) ব্যবসা আমার পিতা মরহুম সৈয়দ জাহাদার মিয়া যেমন করতেন, তখন তেমনি আরো একজন কাপড়ের ব্যবসা করতেন, তিনি হলেন ইলিয়াস দাদা। বাবার ব্যবসায়ের সুবাদে আমাদের দোকানে এবং তৎসংলগ্ন স্থানে, আমাদের স্কুলের গন্ডীর বাইরেও আমাদের সময়ে আমরা বেশ রিচ এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ পেয়েছিলাম। স্কুলের নানান জাতীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও স্কুলের বাইরে ছুটির দিন এবং বিকেল বেলা খেলাধুলার পাশাপাশি ওবায়দুল হক মসনু, আহমদ ময়েজ, রফিকুল বারী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফ আহমেদ, প্রয়াত মল্লিক সিদ্দেক আহমেদ(যিনি বয়সের ব্যবধানে অনেক বড় হয়েও আমাদের সাথে সাহিত্য সংস্কৃতির আড্ডায় মিলিত হয়ে অনুপ্রাণীত করতেন), সৈয়দ রফিকুল হক, সহ বেশ কিছু সংস্কৃতিমনা তরুণ আমাদেরকে ঘিরে সাহিত্য সংস্কৃতি ও কাব্য কবিতা সংস্কৃতির চর্চার বিতর্ক জমিয়ে রাখতেন।
আমার এই স্কুল- স্কুল জীবন থেকেই আমাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। আর সেই প্রেরণায় নিত্য সঙ্গী ছিলেন সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক, সৈয়দ শাহীন আহমেদ, আব্দুল হাই, এডভোকেট শায়েখ আহমেদ, মল্লিক সোহেল আহমেদ, সৈয়দ মোহাদ্দিস আহমেদ, মল্লিক শাকুর ওয়াদুদ, সালেহ আহমেদ রাণু, সহ আরো অনেকেই। সৈয়দ পুর হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে অধ্যয়নের ফলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তেমনি আমিই সৈয়দপুর হাই স্কুল এবং সৈয়দপুর তথা গোটা থানা থেকে প্রথম এবং সম্ভবত এখন পর্যন্ত একমাত্র ছাত্র যে ডাকসুতে সরাসরি নির্বাচনে রেজা আরিফ সেলিম পরিষদে নির্বাচনের গৌরবের অধিকারি। শুধু তাই নয়, এই সৈয়দপুর হাইস্কুলই আমাকে আজকের এই পড়ন্ত বেলায়ও ইংল্যান্ডের বিখ্যাত এবং প্রেস্টিজিয়াস গ্রিনউইচ ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চের সুযোগ এনে দিয়েছে। সেজন্য আমি আমার কৈশোর যৌবনের শিক্ষার নীড় সৈয়দপুর হাই স্কুল আজকে ৫০ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে, আর আমি সেই ৫০ বছরে আমার স্কুলের জীবন্ত স্বাক্ষী হতে পেরে নিজেকে আরো বেশী গৌরবান্বিত মনে করছি। আল্লাহপাকের দরবারে সেজন্য লাখোশুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আমার স্কুল সৈয়দপুর হাই স্কুল আরো সামনে দিকে এগিয়ে যাক, জ্ঞান বিজ্ঞানের শ্রেষ্ট বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়ে সমগ্র এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিক- এই আমার চাওয়া, এই আমার প্রার্থনা।
(লেখকঃ প্রাক্তন ছাত্র, লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, সাবেক নিউজ এডিটর-বেতার বাংলা, সাবেক চীফ রিপোর্টার -চ্যানেল আই,প্রধান সম্পাদক– দ্য লন্ডন টাইমস । এনএইচএস এর পার্মানেন্ট স্টাফ)।