ঐতিহাসিক হাগিয়া সোফিয়াতে (আয়া সোফিয়া) সাত দিন
আয়া সোফিয়ার ভিতরের অংশ-মসজিদ

ঐতিহাসিক হাগিয়া সোফিয়াতে (আয়া সোফিয়া) সাত দিন

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ, লন্ডন থেকে

 

তুরস্কের ইস্তানবুল- ইউরোপ এশিয়ার সংযোগস্থল যা বসফরাস প্রণালীর পানির তীরে প্রায় ১৫ মিলিয়নেরও অধিক লোকের বসবাস। সারাক্ষণ বলতে গেলেই ব্যস্ত থাকে। এর সব কটা সড়ক, মহাসড়ক, মোটরওয়ে কিংবা ছোট রাস্তা সবই অনবরত মোটরযান ছুটে চলায় সরব থাকে রাত দিন। এ যেন নির্ঘুম এক শহর-যে কখনও ঘুমায়না। রাত তিনটার দিকেও যদি এর সড়ক, মোটরওয়ে কিংবা ছোট অলি গলিতে ঢু মারেন তবে লোকে সরব উপস্থিতি চোখে পরার মতো। সব কটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে নানান পসরার খাবারের দোকানগুলো উপচে পরা ভীড় পরিলক্ষিত হয়। ইস্তানবুল নানা কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। এর আদি নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল, যা থেকে পরবর্তীতে ইস্তানবুল নামে প্রসিদ্ধি লাভ করলেও আজও কনস্টান্টিনোপল নামও সমানভাবে উচ্চারিত হয়।

আয়া সোফিয়া মসজিদের মূল মিম্বরের ভিতরে নামায শেষে

সমগ্র ইস্তানবুলে এতো সুন্দর সুন্দর বিশাল মসজিদ এবং প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইমারত রয়েছে, যা আপনাকে নিয়ে যাবে এর ঐতিহাসিক স্মৃতিমন্থনে এবং গুরুত্বে ভাবনা খোরাক জোগাবে প্রতিনিয়ত। খ্রিস্টান, অর্থোডক্স, বাইজাইন্টান, ব্রিটিশ, স্পেন সাম্রাজের অনেক পুরনো ভবন আদি এবং অকৃত্রিম এবং ভঙ্গুর অবস্থায় এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা দেখলে তুরস্কের নানা পর্যায়ের যুদ্ধ করে জয়ের ইতিহাস অনায়াসে স্মৃতিপটে ভেসে উঠে।

 

ইস্তানবুলের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণ যে কটা ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে হাগিয়া সোফিয়া বা তার্কিশ ভাষায় আয়া সোফিয়া সর্বাধিক খ্যাত। প্রতিদিন আয়া সোফিয়া দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ ভিজিটর সারা বিশ্ব থেকে এখানে এসে জড়ো হন এবং সারাক্ষণ নানান ধর্মের বিশেষ করে অর্থোডক্স এবং মুসলিম দর্শনার্থীদের সমান সরব  উপস্থিতি লক্ষণীয়।

মসজিদের ভিতর নামায শেষে যখন দর্শনার্থীদের জন্য খোলে দেয়া হবে

৩৬০ এডিতে  বাইজাইন্টান সম্রাট কনস্টান্টিনিয়াস ১ এই হাগিয়া সোফিয়া নির্মাণ করেন। শুরুতে এটা কাঠের তৈরি ছিলো। এর আর্কিটেকচারাল ডিজাইন এবং নির্মাণ শৈলি এতো অসাধারণ যা দর্শনার্থী ছাড়াও সারা বিশ্বের স্থাপত্যশৈলিদের বিমুগ্ধ করে। নিজেদের মধ্যেকার মারামারি আর আগুনে ৪০৪ এডিতে ভস্মিভুত হলে হাগিয়া সোফিয়া দ্বিতীয়বার  রাজা থিওডোসিস টু পূণনির্মাণ করেন। এরপরেও হাগিয়া সোফিয়া আরও বেশ কয়েকবার ধ্বংস হওয়ার প্রেক্ষিতে বার বার নতুন করে নির্মাণ করতে হয়েছিলো।

ভিতরের ওয়ালের উপরে ঠিক উল্টোদিকেই আছে অর্থডোক্সদের ক্যালিগ্রাফি

প্রায় ২০০ বছর পর ১৪৫৩ তে অটোমান সাম্রাজ্যের  ফাতিহ সুলতান মেহমুদ যখন কনস্টান্টিনোপল জয় করেন তখন মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র এই হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করেন। পরবর্তীতে সুলতান সোলেইমান  এবং সুলতান মুরাদ টু এর ভিতরের মেহরাব, মিনার নির্মাণ ও সংস্কার করেন।

এর ভিতরে ছাদের উপরে এখনো খ্রিস্টান অর্থোডক্স চারটি ক্যালিগ্রাফি রয়ে গেছে, যার পাশে চার মিনারে রয়েছে আল্লাহ, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম বড় বড় করে স্বর্ণখচিত খোদাই করে লেখা রয়েছে।

 

ভিতরে আযানের সময় হলে পাচ ওয়াক্ত নামায জামায়াতের সাথে পড়া হয়। আযান যখন পড়ে তখন অন্য ধর্মের পর্যটক নারী পুরুষদের জন্য গেইট নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা বন্ধ করে দেন। তখন কেবল মাত্র মুসলমানেরা যাতায়াত করতে পারেন নামাযের জামায়াতের জন্য।

নবীজীর সেই হাদীস আয়া সোফিয়ার প্রধান প্রবেশ পথের পিলারে, ছবি সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

আয়া সোফিয়ার প্রধান ফটকের পিলারের নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের বাণী খোদাই করে লেখা রয়েছে, যেখানে নবীজী বলেছেন, কনস্টান্টিনোপল জয়ের অধিনায়ক,সেনাপতি সে কতোইনা সৌভাগ্যবান হবে যে এই কনস্টান্টিনোপল জয় করবে।

 

আয়া সোফিয়ায় একেবারের উপরে বাইরের অংশে রাতের বেলা অন্ধকার চাদের রস্মিভেদ করে ইলেক্ট্রিক ব্যবস্থায় রাতের সময়ে জ্বলে উঠে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, যা পর্যটকদের বিমোহিত করে।

আয়া সোফিয়ায় রাতের বেলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

আয়া সোফিয়া ঘিরে নানা পদের খাবারের দোকান আশে পাশে এবং আয়া সোফিয়া ও ঐতিহাসিক ব্লু মস্কের মাঝামাঝি সুন্দর পরিপাঠি করে সাজানো মনোরম বাগান ও পার্কের মধ্যে সারাক্ষন পর্যটকদের ভীড় লেগেই থাকে। ঐতিহাসিক ব্লু মস্কে আয়া সোফিয়ার ঠিক বিপরীত দিকে হওয়ায় রাতের বেলা পার্ক থেকে জনসাধারণের উপভোগের জন্য রয়েছে লাইট এন্ড সাউন্ড সিস্টেম যা ব্লু মস্কের অসাধারণ সৌন্দর্যকে নানান রঙের আলোয় সাজিয়ে পর্যটকদের কাছে আকর্ষিত করা হয়। ২০২০ সালে তার্কিশ স্টেট কাউন্সিল এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগান আয়া সোফিয়াকে পূণরায় মসজিদ হিসেবে রিক্লাসিফাইড করেন। এখানে কো্ন ডোনেশন প্রদানের ব্যবস্থা নেই, তবে সাহাবী আইয়ূব আল আনসারির রওজা ও মসজিদে ডোনেশন গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে অফিসিয়ালভাবে।

ব্লু মস্ক এবং পার্ক, আয়া সোফিয়া থেকে, ছবি সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

আয়া সোফিয়া থেকে আরেক ঐতিহাসিক তাকসীম স্কোয়ারের দূরত্ব খুব বেশী নয়। সেখানে সব কটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারারাত পর্যটকদের উপচে পরা ভীড়, লোকে লোকারন্য থাকে।

 

আয়া সোফিয়া থেকে কিছু দূরেই সুলতান আইয়ূপ তথা রসূলের সাহাবী হযরত আইয়ূব আল আনসারীর রওজা এবং মসজিদ রয়েছে। সেখানেও পর্যটকদের ভীড় সব সময় লেগে থাকে।

তাকসীম স্কোয়ারে পেছেনে জামে মসজিদ

আয়া সোফিয়া থেকে ইস্তানবুলের আধুনিক এবং সব চাইতে বৃহৎ নির্মাণশৈলির বড় মসজিদ, যা ইস্তানবুলের যেকোন জায়গা থেকে দেখা যায় মসজিদটি যেন ঠিক আকাশের মধ্যে লেগে আছে। যার নির্মাণশৈলি, স্থাপত্য এবং এর ভিতরের কারুকাজ আপনাকে বিমোহিত করবেই। মসজিদের প্রবেশ পথে যখন দাড়াবেন তখন ডানে বামে সামনে পেছনে যেদিকেই তাকাবেন পুরো ব্যস্ত ইস্তানবুল সিটি আপনার নজর কাড়বে।