সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
আমার ছেলে মেয়েরা ২০২৩ সালের শেষের দিকে আমাকে বেশ সারপ্রাইজ দিলো অত্যন্ত সুন্দরভাবে, যা আমার কল্পনারও বাইরে। ভাবতেও পারিনি আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে এভাবে, এতো সুন্দরভাবে এক সারপ্রাইজ দিবে। তদের এই আয়োজনের সঙ্গী তাদের খালাতো ভাই এবং বোন-যাও আমার সারপ্রাইজ মেলা পর্যন্ত অজানা ছিল। ছোট ছেলে রাইয়ান আমাকে শুধু জানিয়েছিল অক্টোবরের দিকে হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে রাখতে, বড় ছেলে রাইম বলেছিল যখন ছুটি মঞ্জুর হবে তখন যেন তাদেরকে জানাই। ব্যস ওয়ার্ডের ম্যানেজারও সদয়ের সাথে তড়িৎ গতিতে ছুটি মঞ্জুর করে দেন। যথারীতি আমি ছেলে মেয়েদের জানিয়ে দেই। এই পর্যন্তই। ছুটির আগের দিনও কাজ ছিলো, দীর্ঘ শিফট । এনএইচএসে এটাকে বলে লং ডে শিফট-১৪ ঘন্টার শিফট। শিফট শেষ করে বাসায় যখন ফিরি তখন মধ্যরাতের কাছাকাছি। ছেলে মেয়েরা জানিয়ে রাখে ভোরের দিকে উবার আসবে, আমি যেন তৈরি থাকি। আমিও উপভোগ করছিলাম, বেশ ভালোই লাগছিল, কোন কিছু জানতে চাইনি। শুধু তাদের ফলো করছিলাম। রাইম রাইয়ান জানালো সঙ্গে পাসপোর্ট নিতে। উবার এসে নক করলে পরিবারের সাথে ট্যাক্সিতে রওয়ানা দেই।
ট্যাক্সি এসে থামে স্ট্যান্সট্যাড এয়ারপোর্টে। পেগাসাস বিমানের কাউন্টারে লাইন দিয়ে চেকিং শেষে আমি যখন বললাম, চলো এখানে কোথাও নামাযের জায়গা আছে কিনা খুজে দেখি, তাহলে আসরের নামায জামায়াতের সাথে পড়ে ইমিগ্রেশনে ঢুকব।
আমার ছেলে মেয়েরা বলে ঠিক আছে তাই হবে। এরই মধ্যে রাইয়ানের মোবাইলে রিং বেজে উঠে। রাইয়ানের খালাত বোন ডা শুরভীর ফোন। ভাবলাম হয়ত স্বাভাবিক ফোন কল। আমাকে কিছু না বলে রাইয়ান ফের পেগাসাস এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের দিকে যেতে থাকে। কিছু পরেই দেখি রাইয়ানের পিছু পিছু শুরভী, তায়েফ এবং তাদের পিতা মাতা ও তুষার। প্রথমে ভাবলাম আমাদেরকে সী অফ করার জন্য হয়তো। কিন্তু না, কিছু পরে দেখি তুষার বলে, খালু আমি এখন চলে যাই, আপনাদের হলিডে শুভ হউক ইনশাআল্লাহ। তুষার চলে যেতেই শুরভী রাইয়ান তায়েফ রাইয়ান রাইসা পল্লভী বলতে লাগল আপনাদেরকে মূলত সারপ্রাইজ ইস্তানবুল ট্যুর করানোর জন্য আমাদের এই আয়োজন। সেজন্য আমরা কাউকেই কিছুই জানাইনি।
আমার বিস্ময়ের সীমা শুধু বাড়তেই লাগল। প্রথম বিষ্ময় কল্পণারও বাইরে তুরস্ক সফর, দ্বিতীয় বিষ্ময় তাদের খালাত ভাই বোন পরিবার এক সাথে সবাই মিলে ট্যুরের আয়োজন, উভয় পরিবারের একে অন্যের জন্য এক বিস্ময়। উনারাও জানেন না আমিও সঙ্গী।
যাই হউক বিস্ময়ের ঘোর কাঠিয়ে কিছু পরে নামাজের জায়গায় জামায়াতের সাথে নামায আদায় করলাম। আল্লাহর দরবারের রাইম রাইয়ান তায়েফ শুরভী রাইসা পল্লভীর জন্য কায়মনোবাক্যে দোয়া করলাম আর আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। মহান আল্লাহর এতো দয়া আর মায়া বার বার শোকরিয়া আদায় করেও শেষ হওয়ার নয়।
শুরভী পেশায় জিপি। রাইম এনএইচএসে কর্মরত, রাইয়ান আইন পেশায়, পল্লভীও পড়াশুনা এবং চাকরী দুটোই করছে, রাইসা এখনও পড়ছে, তায়েফ একাউন্ট্যান্ট- সব মিলিয়ে এতো সুন্দরের সমারোহ আর অভাবনীয় সফলতা আল্লাহ আমার হাতে দান করেছেন, যেন তার রহমতের অবারিত দরজা আকাশ থেকে সরাসরি খুলে ধরেছেন- শুধু শোকরিয়া জ্ঞাপনে কী চলে, সেজদায় অবনত মস্তকে হ্নদয়ের সবটুকু দরদ দিয়ে রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা করলাম, যে প্রশংসার মালিক শুধু মাত্র একমাত্র আল্লাহ। আমিও দোয়া করেছি, আপনাদের কাছে তাদের সর্বাধিক কল্যাণ ও হেদায়েতের রাস্তায় থেকে সার্বিক সফলতার জন্য দোয়ার দরখাস্ত করছি।
ইস্তানবুল যত দেখি ততোই মুগ্ধ হতে হয়। গভীর রাত যখন ইস্তানবুলের মাটিতে পা রাখি। গাড়ি দ্রুত গতিতে চলছে হোটেলের দিকে। কিন্তু সব কটা রাস্তা যেদিকে চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি, দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। রোববার ছুটির দিন তথাপি মনে হলো এশহর কখনও ঘুমায়না।
ইস্তানবুল সিটি সেন্টার, ঐতিহাসিক গ্র্যান্ডবাজার , আরাস্তা বাজার, হাগিয়া সোফিয়া, ব্লু মস্ক, টপক্যাপি প্যালেস, তাকসিম স্কোয়ার, গেঞ্জি বাজার শপিং মল, গালাটা টাওয়ার কোথাও খালি নেই। ভীড় আর ভীড়। শহরের যে গলিতেই যে রাস্তায় কিংবা যে সড়কে বা মার্কেটে যেখানেই খাবারের দোকান, রেস্তোরা সর্বত্রই ভীড়। সব কটা খাবারের দোকানে উপচে পরা ভীড় এবং সেটা প্রতিদিনই। তার্কিশ খাবারও সুস্বাদু। উবার ছাড়াও গেটায়ার আর মাইক্রোসফট দাপুটে ব্যবসা করে চলেছে ইস্তানবুলে।
তাকসিম স্কোয়ার পর্যটক আর ব্যবসা বাণিজ্য আর বিনোদন প্রেমিদের উপচে পরা ভীড় সারাক্ষণ লেগেই আছে, যেমন আছে হাগিয়া সোফিয়াতেও। সেলিব্রেটি রেস্তোরা নুসরাত কিংবা ইস্তানবুলের বিশ্বখ্যাত শেফ #সল্টবে প্রোডাক্ট ও নুসরাত রেস্টুরেন্ট এবং রেস্তোরার খাবার ও সার্ভিসের মান অসাধারণ। সেই সব রেস্টুরেন্টে খেতে হলে আপনাকে আগে থেকে বুকিং দেয়া লাগবে। তাকসিম স্কোয়ারের মেডিনেটলার সফরাস-আল মদীনা রেস্তোরায় যেখানে রোনালডো, প্রেসিডেন্ট এরদোগান, কাতারের আমীর থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের হেন কোন রাষ্ট্রীয় বা সেলিব্রেটি নেই যে ঢু মারেন নি ও খারের স্বাদ গ্রহণ করেন নি। রেস্তোরায় ঢুকলেই তাদের ভিজিটের বিশাল ক্যানভাসে ছবি চতুর্দিকে লাগানো রয়েছে। অথচ রেস্টুরেন্টের সাজ সজ্জা তেমন কোন আহামরি কিংবা অত্যাধুনিকতার কোন ছোয়া নেই। তবে তাদের খাবারের মান, সার্ভিসের মান অত্যন্ত উন্নত এবং সুস্বাদু, যা সবাইকে এখানে টেনে নিয়ে আসে জাদুর মতো। খাবার পরিবেশনকালিন শেফ নিজেই এসে তদারকি করে যান, অতিথিদের সাথে কুশল বিনিময় করেন।
ইস্তানবুল শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশাল সুন্দর সুন্দর স্থাপত্যের মসজিদ, যা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। ইস্তানবুলের প্রাণকেন্দ্রে ভুমি থেকে উচুতে মেভলিক কান্দিজিস মুবারেক অলসোন মসজিদ ভুমি থেকে এতো উঁচুতে অবস্থিত, ইস্তানবুলের যেকোন স্থান থেকে এ মসজিদ দেখা যায় এমনভাবে যেন আকাশে খুব সুন্দর এক মসজিদ ঝুলে আছে যা ভুমি থেকে গ্রোথিত। এই মসজিদ কমিউনিটি হ্যাব হিসেবেও অনেক সেবা দিয়ে থাকে। ভিতরের নামাজের জন্য বিশাল মসজিদ ছাড়াও নারীদের জন্য দোতলায় পৃথক সুন্দর ব্যবস্থা, প্রবেশ এবং অজু আঙ্গিনা এতো ব্যাপক যা বর্ণনা করা যায়না। মসজিদ কম্পাউন্ড রাতের বেলা আলো আধারির অসম্ভব এক মায়াময় আলোকচ্ছটা চতুর্দিকে ছড়ায় যা পর্যটক এবং ইবাদতকারিদের বিমোহিত করে। এশার নামাজের আগে বিভিন্ন ক্বারিদের সুন্দর এবং সুমিষ্ট কোরআন তেলাওয়াত মনে হয় যেন আকাশ থেকে কোরআন এখনি নাজিল হচ্ছে।
গালাটা টাওয়ারের উপর থেকে সমগ্র সিটি প্যানোরোমা আপনাকে বিমুগ্ধ করবে। গালাটা টাওয়ারের পাশেই রয়েছে গালাটা ইউনিভার্সিটি। তবে হাগিয়া সোফিয়া আশে পাশের মার্কেটের ভিতরে রাতের বেলা অনেক কুকুর ঘুর ঘুর করে বেড়ায়, দেখলে মনে হয় যেন কালো কালো বিশাল কুকুর বুঝি এখনি তেড়ে আসবে। কিন্তু এগুলো রক্ষকের ভক্ত।
গ্র্যান্ড বাজার যেন আমাদের গাওছিয়া নিউমার্কেট। তফাৎ শুধু গ্র্যান্ড বাজার ইস্তানবুলের সবচাইতে পুরনো বাজার, এর সাথে কনস্টান্টিনোপলের বাইজাইন্টাইন সাম্রাজ্যের এবং এর্তোগুল-ওসমান, অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এছাড়া আকারের দিক থেকেও এটা গাওছিয়া-নিউমার্কেটকে ছাড়িয়ে যায় কয়েকগুন। সারাক্ষণ এখানে গাওছিয়ার মতো লোক ভীড় জমে থাকে। সব দোকানেই কাস্টমার পরিলক্ষিত হয়। তবে গাওছিয়ার মতো কাস্টমার ও ভিজিটরদের হেনস্থা গ্র্যান্ড বাজারে নেই।
ইস্তানবুল শহরে আপনি রাত-বিরাত একাকি ঘুরে বেড়ান, নারী পুরুষ সমানতালে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনায়াসে। কোন ভয়ের কিংবা ছিনতাই, রাহাজানি বা বিপথগামী হওয়ার কোন ভয় নেই। এখানেই তার্কিশ শাসকদের সব চাইতে বড় কৃতিত্ব। যদিও এমনও অনেকের সাথে কথা হয়েছে, এরদোগানের দীর্ঘকালিন শাসনে তারা বিরক্ত না হলেও তেমন অপছন্দ নেই, কেননা অনেকের সাক্ষাত পেলাম রাজনৈতিক মতাদর্শে অপছন্দ হলেও এর্দোগানের শাসনামল নিয়ে তেমন কোন বিতর্ক নেই। তার্কিশ সরকার কাজ করছে-ট্যাক্সি, ব্যবসায়ী, প্রযুক্তি, আইন, শৃংখলা, পর্যটনে উপচে পরা ভীড়, বিমান বন্দরে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ও উন্নত সেবা-সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত দক্ষতা এবং পেশাদারিভাবে, কোন ভাওতাবাজি নয়। মানি এক্সচেঞ্জ সেবা অসাধারণ, সৌদি আরব কিংবা আরব দেশগুলোর মতো রুষ্ট-কাষ্ট নয়, কাষ্টমারদের সেবা কিভাবে দিতে হয় এদের বেশ ভালোভাবেই রপ্ত। এক্সচেঞ্জ রেইট যথাযথ আইনিভাবে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। কোন হের ফের নেই।
Pingback: The beautiful way, beyond imagination… – Website