বাংলাদেশের চলমান সহিংস রাজনৈতিক অবস্থা যেমন করে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে, দিনে দিনে বারুদের গুদাম পরিণত হতে চলেছে, ঠিক তেমনি করে ভারতীয় অন্ধর মহল অপ্রকাশ্য থেকে প্রকাশ্যে এসে সেই বারুদের গুদামে যেন দিয়াশলাইয়ের কাঠি ধরে আছে।ভারতীয় ও মার্কিনীদের অতি উৎসাহ আর দূতিয়ালি, পঙ্কজ মজীনার দৌড় ঝাঁপ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে করে তুলেছে ভয়াবহ এক সংকটময়। যখনি কোন সমঝোতার আলোর রেখার ক্ষীণ আশা দেখা দেয়, তখনি ভারতীয় মিডিয়া, দুই প্রভাবশালী দূত পরিস্থিতির ডামাডোলের সুযোগে লবণের ঝাল লাগিয়ে দিয়ে সেই সম্ভাবনাকে আরো বিষময় করে তুলেন।
বাংলাদেশ এখন উত্তাল-সন্দেহ নাই।আমাদের নেতা-নেত্রীরা সেজন্যে অনেকাংশে দায়ী।আমাদের দুর্ভাগ্য কতিপয় অথর্ব, জেদি, একরোখা নেতৃত্বের খামখেয়ালি আর অদূরদর্শিতার ফলে অমিত সম্ভাবনায় এই বাংলাদেশ আজ সিকিম, ইথিওপিয়া, ঘানা, সেনেগাল, পাকিস্তান, সিরিয়া, বৈরুতের মতো প্রতিনিয়ত বোমা, ককটেলের ভয়াবহ কম্পনে সারাদেশ আজ প্রকম্পিত। প্রতিদিন পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো কেউ কেউ না কেউ দগ্ধ কিংবা প্রাণ হারাচ্ছে।
আর এই সুযোগে আনন্দ বাজার ৪ঠা ডিসেম্বর সেই ক্ষতের মধ্যে আরো আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এবার দেখা যাক আনন্দবাজার পর পর দুইটি রিপোর্ট কি লিখেছে। তার আগে বলে নেই, ৪ ডিসেম্বর আনন্দ বাজার আমাদের এই অগ্নিগর্ভ উত্থাল রাজনৈতিক অবস্থায় সেনা মদদে আবারো অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করে রিপোর্ট করেছে। সুজাতা সিং এর বাংলাদেশ সফরের প্রেক্ষিতে আনন্দ বাজার সংকট নিরসনে ব্যর্থতায় এবং একদিন আগে এরশাদের নির্বাচন থেকে সরে আসায় এই সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করে লিড নিউজ করেছে।
এই আশঙ্কা করার পর পরই আনন্দ বাজার আরো দুটো সংবাদ প্রকাশ করে আমাদের ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে দিলাম এখানে।
অগ্নিগর্ভ রাজনীতির ঢেউ ভারতের সীমান্তে-
বাংলাদেশে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির আঁচ এসে পড়েছে পেট্রাপোলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও৷ বন্ধ আমদানি-রফতানি৷ বন্ধ কলকাতা-ঢাকা বাস চলাচল৷ বাংলাদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ঘিরে অশান্তির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ বিএনপি ও তাদের শরিক জামাতে ইসলামির হিংসাত্মক আন্দোলনে উত্তপ্ত বরিশাল, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া সহ বিভিন্ন এলাকা৷ অশান্তির রেশ এসে পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও৷ বুধবার পেট্রাপোল দিয়ে দু’দেশের মধ্যে পণ্যবাহী মাত্র ৫টি লরি যাতায়াত করেছে৷ সরকারি সূত্র অনুযায়ী, পেট্রাপোল দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে বাংলাদেশে যায় ৩৫০ থেকে ৪০০টি লরি৷ বাংলাদেশ থেকে ২০০-২৫০ টি লরি ভারতে আসে৷
কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশের অশান্তির আঁচ পেট্রাপোলে পাওয়া যাচ্ছিল৷ কিন্তু, বুধবারে সীমান্ত-বাণিজ্য প্রায় বন্ধের মুখে৷ দুই প্রান্তেই সার সার দাঁড়িয়ে লরি৷ সবজি-মাছ লরিতেই পচে যাওয়ার জোগাড়৷ কবে মিটবে সমস্যা, বুঝে উঠতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা৷ ঢাকা থেকে কলকাতাগামী দু’টি বাসে মঙ্গলবার হামলা হয়৷ হমালায় জখম হন এক মহিলা যাত্রী৷ একটি বাসের জানলার কাচ ভাঙে৷ অন্যটির কাচে চিড় ধরে৷ এই ঘটনার জেরে মঙ্গলবার রাত থেকেই দুই দেশের মধ্যে বাস চলাচলও বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷
তৃতীয় রিপোর্টে আনন্দ বাজার লিখেছে-
বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির আঁচ ছড়াল আন্তর্জাতিক আঙিনায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আওয়ামী লিগ ও বিএনপি-কে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিশা দেশাই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলকে তাতে অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে তারা।
এ দিকে নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টির সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পরেই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়ল আওয়ামী লিগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। মঙ্গলবার রাত দশটা নাগাদ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গণভবনে আলোচনায় বসেন মহাজোটের নেতারা। সূত্রের খবর, বৈঠকে নির্বাচন থেকে সরে না আসার বিষয়ে একমত হয়েছেন জোটের নেতারা। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অচলাবস্থা কাটাতে প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন ও জরুরি অবস্থা জারি করার বিযয়েও আলোচনা হয় এই বৈঠকে।
এরই মধ্যে হিংসা অব্যাহত বাংলাদেশে। মঙ্গলবার গভীর রাতে কিশোরগঞ্জে একটি ট্রাকে এক দল দুষ্কৃতী হামলা করলে মৃত্যু হয় চালকের, আহত হন আরও সাত জন। বুধবার সকালে বিএনপি সভাপতি আব্দুল হাই-এর নেতৃত্বে গজারিয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন কয়েক হাজার বিএনপি কর্মী। দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরোধ তুলে দেয় পুলিশ। এ দিকে বাসে পেট্রোল বোমা মারার ঘটনায় গ্রেফতার বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর জামিনের আবেদন নাকচ করল ঢাকার একটি আদালত। গত ২৮ নভেম্বর বাসে বোমা মারার ঘটনায় গ্রেফতার হন তিনি। ঘটনায় নিহত হন তিন জন।
দু’দিনের বাংলাদেশ সফরে বুধবার সকালে ঢাকায় পৌঁছলেন ভারতের বিদেশ সচিব সুজাতা সিংহ। অচলাবস্থা নিরসনে ও আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য খালেদা ও এরশাদের কাছে আর্জি জানাতে পারেন সুজাতা।
সুজাতা সিং এর সফর এবং জরুরী আইনের আশঙ্কা –
হাই প্রোফাইল ভারতীয় এই স্বরাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এর তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ সফর বলা যায় অনেকটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে বলে ঢাকার রাজনৈতিক মহল দেখছেন।যদিও ডিপ্লোম্যাটরা মন্দের ভালো হিসেবে কিছু একটার সূচনা বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু হাই প্রোফাইল এই সফর যে উদ্দেশ্যে ঢাকা নিয়ে এসেছিলো, তার গুড়ে বালি এখন দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। কেননা, সুজাতা সিং হাসিনা, খালেদা, এরশাদ সহ অনেকের সাথেই সাক্ষাত করেছেন। কিন্তু বরফ গলার কোন লক্ষণ দেখাতে পারেননি। উপরন্তু সুজাতা প্রেস কনফারেন্সে ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধিক সংখ্যক দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচনের কথা বলে স্পষ্টতই বিএনপি এবং আজকের এরশাদের ডিগবাজীর সরে আসায় বাইরে রেখে হলেও নির্বাচনে তারা তাদের মিত্র আওয়ামীলীগের প্রতি অনেকটাই প্রকাশ্যে অবস্থান খোলাসা করায় বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক সহিংসতায় আরো উস্কানি দিয়ে গেছেন- এখন সেটাও স্বচ্ছ হয়ে গেছে।বিরাজমান সংকটের প্রেক্ষিতে ভারতীয় অবস্থান আরো অন্তরালে থাকা জরুরী ছিলো। ভারত নিজেদের স্বার্থে এবং সীমান্ত সমস্যার অজুহাতে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ ও ভারতীয় পরিস্থিতি আরো জটিল করার যে আশঙ্কার ধুয়া তুলে আওয়ামীলীগের প্রতি একক সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে বরং আরো অশান্ত ও উত্থাল করে তুলেছে।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, দু চারদিনের মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে জরুরী আইনের প্রয়োগ ছাড়া সরকারের হাতে দ্বিতীয় আর কোন করনীয় আছে বলে মনে হচ্ছেনা। সরকার এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কি তাহলে নিরবচ্ছিন্ন স্বার্থপরতার সাথে সেই পথের দিকেই দেশকে নিয়ে গেছেন।যদি তাই হয়, তবে এর ভিতরে গভীর কোন বিষয় জড়িত-যা জনগণকে ঘুমের মধ্যে রেখে এরা সেই কিন্তু র কাজটাই সম্পন্ন করতে চাচ্ছে।
তারানকো ও সাঈদা ওয়ার্সী-
জরুরী আইন তারানকো ও সাঈদা ওয়ার্সীর সফরের প্রেক্ষিতে আটকে আছে, অবস্থা দৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। তবে আনন্দবাজারের সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কার প্রতিবেদন মূলত: জরুরী আইন জারীর পরিকল্পনাকে সামনে এগিয়ে বিয়ে আসার ক্ষেত্র হিসেবেই কূটনীতিকেরা দেখছেন।তবে জাতি সংঘ এই রকম পরিস্থিতির সুযোগে যেখানে গেছে, সেখানে আরো আগুন ছড়িয়েছে। আর বিশ্বের বিরাজমান কূটনৈতিক অবস্থায় সাঈদা ওয়ার্সীদের দুতিয়ালি এখন আগের মতো প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে অনেক আগেই। সেজন্যে সন্দেহ হয় জাতিসংঘ মিশনকে সামনে রেখেই কিনা জরুরী আইনের প্লটের ছক কষা হয়েছে, অন্ততঃ আনন্দ বাজার কিন্তু সে ধারণা আরো একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে জাতীয় সংলাপ-
এই মুহূর্তে একমাত্র বিকল্প ও সহজীয় পন্থা সরকারের হাতে এখনো রয়ে গেছে। যদি সরকার আন্তরিক হয়, দেশকে এই ভয়াবহ সংকট থেকে উত্তরণ করতে চায়, তবে জরুরী আইনের বিকল্প হিসেবে এখনি রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সকল রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক পেশাজীবীদের সাথে জাতীয় সংলাপের ডাক দিতে পারে।তার প্রাথমিক বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কমিশনকে জাতির মুরুব্বী হিসেবে নির্বাচনী সকল কার্যক্রম পরবর্তী অনুরোধ না করা পর্যন্ত স্থগিত রাখার আহবান রেডিও টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালিন সরকারকে নিজের সচিবালয়ের অধীন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জারী করে সাময়িক সময়ের জন্য অর্থাৎ সংলাপ চলাকালীন সময়ের জন্য নিতে পারেন। আর এ সবের প্রেক্ষিতে আমার বিশ্বাস সকল পক্ষের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্র যেমন প্রস্তুত হবে, একই সাথে সহিংসতাও বন্ধ হবে।
সরকার কি সে পথে যাবে, নাকি জরুরী আইন কিংবা সেনা অভ্যুত্থানের দিকে দেশকে নিয়ে যাবে- সরকারকেই এখন সেটা পরিষ্কার করতে হবে। কেননা, দায়িত্ব যখন কাঁধে নিয়েছেন, যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দায় ও ভবিষ্যতের ইতিহাসের দায়বদ্ধতা এড়াতে পারেন না ।
Salim932@googlemail.com
5th December 2013, London.