চলমান রাজনৈতিক সংকটে এবং একের পর এক হরতালের প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ পুলিশী ব্যারিকেড দিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এক ঘরে করে রাখে। উদ্দেশ্য নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, মনোবল ভেঙ্গে দেয়া।আন্দোলন দমিয়ে রাখার জন্য সরকার বিরোধী নেতা-কর্মীদের নিপীড়ন করবে, অবরুদ্ধ করে রাখবে-এটা যুগে যুগে চলেই এসেছে।আওয়ামীলীগ পুলিশী ব্যারিকেড বসিয়ে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখলেও সুশীল সমাজের বেশ কিছু লোকজন খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করেছেন, তাদের মাধ্যমে গণ মাধ্যমে খালেদা জিয়ার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে।
বিগত পাঁচটি বছর খালেদা জিয়া ও বিএনপির রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপির অগণিত মাঠ পর্যায়ের কোন নেতা-কর্মী কিংবা বিএনপির প্রাণ শক্তি মধ্য পর্যায়ের কোন নেতাই খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির হাই কমান্ডের সান্নিধ্যে আসা দূরে থাকুক, কখনো কেউ ভুলেও সালাম পর্যন্ত করার সৎ সাহসও দেখানোর সুযোগ হয়নি। খালেদা জিয়া কোন কর্মীসভায় বা দলীয় ফোরামে বক্তব্য রাখেননি-এমন নয়, বরং সেই সব সভা বা ফোরামের আলোচনা সভায় কখনো কোন সাধারণ মাঠ পর্যায়ের কর্মী বা মধ্যম কিংবা আন্দোলনের সঞ্জীবনী শক্তি যারা বইয়ে দিতে পারে, এমন নেতাদের কখনো খালেদা জিয়ার কাছাকাছি বা সাধারণ সৌজন্যবোধ জিজ্ঞাসা করার মতো সুযোগ কখনো হয়েছিলো-এমন কথা হলফ করে বলতে পারবেননা।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা মরহুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতাযুদ্ধের অমিত সাহসী সৈনিক মরহুম জিয়াউর রহমান, মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, কমরেড ফরহাদ, মণি সিং, সহ এই সব নেতাদের সান্নিধ্যে যে বা যারাই এসেছিলেন, তারা আজো শ্রদ্ধার সাথে তাদের সেই দুর্লভ স্মৃতির কথা অকপটে স্বীকার করেন। এদের কেউই একবার একজন কর্মীকে দেখেছেন বা কথা বলার পর সারা জীবন সেই কর্মীর নামটি পর্যন্ত মনে রাখতেন।যখনই দেখা হতো, তখনি আগ বাড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতেন।এরকম একবারের জিজ্ঞাসা বা সালামের জবাব সেই রাজনৈতিক কর্মীর কাছে তার জন্য হতো আশীর্বাদস্বরূপ, যা দলের জন্য সে আরো নিবেদিত হতো। খালেদা কিংবা হাসিনার এমন গুণ নেই তা বলছিনা। বিগত পাঁচটি বছরে সীমাহীন ব্যস্ততার মাঝেও হাসিনা তার সাধারণ গ্রামের তরুণ কর্মীকেও ভুলেননি, অথচ খালেদা জিয়া তার আন্দোলনের জন্য সবচাইতে ডেডিকেটেড নেতা-কর্মীকেও গুলশানের কার্যালয় কিংবা খালেদা জিয়ার সার্কেলের বাইরে রেখে দেন।
বিএনপির মধ্যে এখনো লাখো মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মী এবং অগণিত সমর্থক রয়েছেন। আন্দোলনের মাঠে সরকারের ভীতকে নড়িয়ে দিয়ে সফলতা নিয়ে আসার মতো অসংখ্য পরীক্ষিত নেতা-কর্মী রয়েছেন। ৯০ এর আন্দোলনের সময় আমান, খোকন, দুদু, নাজিম উদ্দিন আলম, জহীর উদ্দিন স্বপন, ফজলুল হক মিলন, আসাদুজ্জামান রিপণ, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এনী, হাবিব উন নবী সোহেল সহ সারা দেশের অসংখ্য অগণিত নেতা রয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর ভিতরে অসংখ্য তরুণ অফিসার রয়েছেন, যাদের কাছে মরহুম জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। অথচ একদল কায়েমি স্বার্থবাদী আর ব্যক্তিগত কতিপয় স্টাফ বেগম জিয়াকে সুকৌশলে বিগত পাঁচটি বছর মাঠ পর্যায়ের লাখো তরুণ নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।তারা বিএনপি নেত্রীকে এমনভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, মাঠ পর্যায়ের কোন কর্মীর পক্ষে ম্যাডামের সাক্ষাত পাওয়া শুধু দূরহই নয়, অসম্ভব এক কাজ। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা লাখো জাতীয়তাবাদী তরুণ নেতা-কর্মীদের নেতৃত্ব পর্যায়ের কারো নাম-ধাম পর্যন্ত অবহিত নন।
সিলেটের বিএনপির রাজনীতিতে অপরিহার্য যেমন আরিফ, হক, সেলিম,জামান, ঠিক তেমনি সারা বাংলাদেশের এমনি করে বিভিন্ন জেলায়ও অপরিহার্য নেতা রয়েছেন, যাদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। অথচ এই সেলিম, জামান, মেয়র আরিফদের মতো নেতাদেরও খালেদা জিয়ার সাক্ষাত পেতে মাসের পর মাস তদবির করতে হয়।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে যেমন জাঁদরেল সাংবাদিক, শিক্ষিত, পেশাজীবী রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন দেশ-বিদেশের নামকরা কূটনীতিকরাও। অথচ নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, সেই সব খ্যাতিমান উপদেষ্টাদেরও ঐ সব কতিপয় ব্যক্তিগত স্টাফদের ডিঙ্গিয়ে নেত্রীর সাক্ষাত পেতে বেগ পেতে হয়, যা সঠিক তথ্য আদান-প্রদানে ও রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়নে বাধার সৃষ্টি করেছে।
একসময় পাহাড় সমান জনপ্রিয়তার চূড়ায় অবস্থান করে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা উত্তর জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রব এই একই রকম মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, তখনি বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিয়ে তার খেসারত দিতে হয়েছিলো, আর আ স ম আবদুর রবকে ক্ষয়িঞ্চু হতে হতে এখন কেবলমাত্র কাগুজে বাঘ হয়ে একেলা একঘরের নেতা হয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।যা আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের জন্য বিশাল এক ছবক হয়ে আছে। অথচ আমাদের নেতা-নেত্রীদের বোধগম্য হয়না সময় মতো।
আওয়ামীলীগ বিএনপি দুটি দলই নেতা-কর্মী নির্ভর দল।দুটি দলেরই রয়েছে গ্রাম পর্যায়ে অসংখ্য কর্মী, নেতা ও সাপোর্টার।বর্তমান বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগের কতিপয় মন্ত্রী আর নেতা বাদে সিংহভাগ নেতা এখনো কর্মীদের সাথে সম্পর্ক রেখে দলের প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছেন, যা বিপদের সময় তাদের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করছে। বিপরীত পক্ষে কতিপয় স্বার্থান্বেষী খালেদা জিয়াকে নেতা-কর্মী বিচ্ছিন্ন রেখে মাঠ পর্যায়ে জামায়াতকে লাভবান করে দিয়ে বিএনপির তৃণমূলে আঘাত করে যেমন চলেছে, একইসাথে বিএনপির স্থানীয় ভিত্তিমূলেও কুঠারাঘাত করে চলেছে। এরশাদের সময়ে নির্বাচন বয়কট আর আন্দোলন আর আজকে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে বয়কট ও আন্দোলনকে এক করে দেখাটা নিতান্তই রাজনীতির ভুল সমীকরণ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন। তাছাড়া, সেদিন এরশাদের পেছনে মধ্যপ্রাচ্য ভিন্ন অন্য কোন শক্তিশালী দেশের পাকাপোক্ত কোন অবস্থান যেমন ছিলোনা, ঠিক তেমনি আজকে দেশের ভিতরে শত অ-জনপ্রিয় হয়েও হাসিনার সরকারের পেছনে প্রতিবেশী দেশ সহ বৃহৎ শক্তিদের দ্বৈতনীতির অবস্থান রয়েছে। খালেদা জিয়াকে আগে এই স্বার্থান্বেষী অরাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে এসে মাঠ-পর্যায়ের লাখ-লাখ তরুণ জাতীয়তাবাদী নেতা-কর্মীদের কাছে ফিরে আসতে হবে। তাদেরকে চিনতে হবে, জানতে হবে। জাতীয়তাবাদের হাজারো লাখো কর্মীদের চোখ ও মনের ভাষা নেত্রীকে বুঝতে হবে।খালেদা জিয়ার মতো নেত্রী যদি একবার এই সব মাঠ পর্যায়ের নেতাদের হ্যালো, সালাম বিনিময় করেন, সেটাই হবে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিশেষ পাওনা। আন্দোলন, সংগ্রামের প্রাণ বিএনপির তরুণ, ডেডিকেটেড নেতাদের সামনের কাতারে নিয়ে আসতে হবে অথবা বেগম জিয়ার সুনির্দিষ্ট পরিচালনায় নেতৃত্বের পর্যায়ে দিক নির্দেশনা দিতে হবে। খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের ঐ অরাজনৈতিক, অপেশাদার বৃত্তের ফল আজকে আন্দোলনের তুঙ্গের মুহূর্তে বিএনপি অফিসে রিজভী আহমেদের মতো একজন নেতা একাই সবেধন নীলমণি হয়ে দলের হাল ধরে আছেন। বিএনপির লক্ষ লক্ষ ঐ সব নেতারা আজ কোথায়? রিজভী আহমেদের মতো অসুস্থ এক নেতাকে কেন একাই হাল ধরে নিভু নিভু বাতির ন্যায় জ্বালিয়ে রাখতে হবে? খালেদা জিয়াকে এই সব দিক আজ বিবেচনায় নিয়ে দলকে পুনর্গঠিত করতে হবে।আন্দোলনের উন্নত, আধুনিক, গণতান্ত্রিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে আগে ভাগে। আর কেবল তা করার মধ্য দিয়েই খালেদা জিয়া আজকের রাজনীতির চাকাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঘুরিয়ে দিতে পারবেন, ঠিক তেমনি দলকেও তিনি ঘুরে দাড় করাতে পারবেন। খালেদা জিয়া কি ভেবে দেখবেন ?
(আগামী কাল থাকছে ডিপ্লোম্যাটিক আপডেট সহ চায়নার তেল সাম্রাজ্য গড়ে তুলার সাধ ও সিকিমের স্বাধীনতা হারানো আমাদের ভাবনার কারণ )