এলএসই`র সাবেক অধ্যাপকের প্রশ্নঃস্যুট-টাই পড়াদের এরেস্ট আর এলিটশ্রেণীর নেতাদের দ্বারা কি বিএনপি আন্দোলনের সফলতা পাবে ?

এলএসই`র সাবেক অধ্যাপকের প্রশ্নঃস্যুট-টাই পড়াদের এরেস্ট আর এলিটশ্রেণীর নেতাদের দ্বারা কি বিএনপি আন্দোলনের সফলতা পাবে ?

দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট বেড়েই চলছে। সরকারও অবস্থার প্রেক্ষিতে ধর-পাকড় শুরু করে দিয়েছে। বিএনপি এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে বা যাদের প্ররোচনায় এই অবস্থানে এসেছে, সেখান থেকে কোন অবস্থাতেই বিএনপির পক্ষে পেছনে ফেরা কতোটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে-সেটাই এখন ভবিষ্যতের বিচার্য বিষয় হয়ে আছে।

আবার উভয় পক্ষের অনড় অবস্থানের ফলে দেশে আরো কতো যে প্রাণহানি ও সম্পদহানি হবে, সেটা আল্লাহপাকই ভালো জানেন। দেশের আপামর জনগণ, প্রবাসী সচেতন নাগরিক সকলেই চান সুন্দর সুষ্ঠু সমাধান, আলোচনার মাধ্যমে অচলাবস্থার নিরসন।

সারা বিশ্বের চোখ এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে কেন্দ্র করে ঘুর পাক খাচ্ছে। সবারই একটাই কথা কি হতে যাচ্ছে ?

সৌদি গ্যাজেট, খালিজ টাইমস, দ্য ডন ১০ নভেম্বরের আর্লি ইস্যুতে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে এরেস্ট করা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ্যে মুখ খুলে এখনো কিছুই প্রকাশ করেনি। যদিও হাসানুল হক ইনু, দীপু মণি, কামরুল ইসলাম এই তিনজন আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন, খালেদা জিয়া গ্রেপ্তারের পর্যায়েই আছেন। সৌদি গ্যাজেট, ডন, খালিজ টাইমস এই প্রথম দুজনের সহ ওবায়দুল কাদেরের উদ্ধৃতি দিয়ে রিপোর্ট করেছে।

এদিকে বিশ্ব রাজনীতির মোড়েল আমেরিকা তাদের ষ্টেট ডিপার্টম্যান্টকে সামনে নিয়ে এসে ৮ নভেম্বর ” হাইড এন্ড ওপেন “ আধুনিক প্রযুক্তি মাধ্যমের নয়া কূটনীতির আরো এক সংস্করণ সার্থক ভাবে মঞ্চস্থ করেছে খোদ ভারতের মাটিতে, সেন্টার ফর ডেভেলপম্যান্ট স্টাডিজের নামে-বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে। প্রকাশ্যে পাকিস্তান, সৌদি আরব আর আমেরিকান তাদের স্বার্থের অনুকূলে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য রেখেছে, আবার একইদিন মার্কিন কূটনীতিক নয়াদিল্লীর সাথে একান্তে বৈঠকও করেছে। আমেরিকা ও ভারত হাইড এন্ড ওপেন ডিপ্লোমেসি এখন সর্বত্রই সমানতালে শুরু করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়ে নয়াদিল্লী-আমেরিকা লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, প্যালেস্টাইন স্টাইল ডিপ্লোমেসি খেলছেনা, তারা উভয়েই খেলছে সিরিয়া, ইরানের মতো কূটনীতির খুব মসৃণ অথচ ধারালো এক “ ডিপ-সী ডিপ্লোমেসি “ নিয়ে । আর এই ডিপ-সী ডিপ্লোমেসি বিএনপির স্যূটেট টাই পড়া এলিট নেতৃবৃন্দ কোন এক অদৃশ্য সূতার ইন্ধনে খালেদা জিয়ার সাথে খেলেই চলেছেন। খালেদা জিয়াকে এখন দলের ভিতর ও বাইরের এই অতি সূক্ষ্ম ও ডিপ-সী ডিপ্লোমেসি মোকাবেলা সতর্কতার সাথে করে এগিয়ে যেতে হবে।

তবে আমেরিকা তার স্নায়ূযুদ্ধ সময়কালিন অথবা উত্তর কূটনীতি যদি এখনো অব্যাহত রাখে, তাহলে হাসিনা-খালেদা দুজনের জন্যই ভয়াবহ বিপদ বৈ অন্য কিছু আশা করা দূরহ হবে।কেননা,” আপনাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছন থেকে সরে যাওয়া “- স্নায়ূযুদ্ধের সময়ের আমেরিকান সেই কূটনীতির ভয়াবহতায় বিশ্বের বহু রাজনৈতিক নেতা বিপর্যস্ত যেমন হয়ে গেছেন, সেই সব দেশও ভয়ানক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে বহু দশক পার করে দিয়েছে। তাই এখন নয়াদিল্লীর সাথে থেকে পেছন থেকে সরে যেতে আমেরিকার যে মুহুর্ত সময় নিবেনা-এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেননা- এখানে থেমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আরো যোগ করলেন।

 

বাংলাদেশ এমন এক দেশ যেখানে সহজে জনগণকে উস্কে যেমন দেয়া যায়, একইভাবে হুজুগ তৈরি করে জনগণকে হিপনোটাইজও করে রাখা যায়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস এর প্রভাবশালী সাবেক অধ্যাপক ও আজকের পশ্চিমা বিশ্ব বিষয়ক ডেস্কের কর্ণধার আড়ালে আবডালে এমন কথা অফ দ্য রেকর্ডে বললেও সে মূলত আমাদের জনগণ নিয়ে অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে সে সরেজমিনে গবেষণা করেছে ১৬ বছর, যার ১১ বছর সে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছে, মিশেছে সাধারণ মানুষের মতো। মানুষকে সে দেখেছে একেবারে খুব কাছে থেকে। এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শ্রেণী বিন্যাস সম্পর্কে সে খুব ধারণা রাখে। সে আরো বলেছে, বিএনপির স্যুট পার্টি নির্ভর নেতাদের দ্বারা এই মুহূর্তে আন্দোলন করে বেগম খালেদা জিয়া সাফল্য পাবেননা। কেননা, তৃণমূলের নেতা-কর্মী ছাড়া এবং তাদের মূল্যায়ন ছাড়া কেবল মাত্র এই সব এলিট নেতাদের দ্বারা মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে কিছুতেই আন্দোলন চাঙা করা যাবেনা। মাঝখানে কিছু লোক অহেতুক নিহত হবে, দেশের সম্পদের ক্ষতি সাধিত হবে। তার মতে, বিএনপি এবং বিএনপির হাই কমান্ডকে গুলশান নির্ভর না হয়ে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের কাছে ডেকে নিয়ে এই সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের কাছে গেলে আন্দোলন আপনা আপনিই বিএনপির হাতে চলে আসতো। কারণ তার ধারণা, গতকাল যে এরেস্ট নামক ড্রামা(তার ভাষায়) সংগঠিত হয়ে গেলো, তাকে সে দেখছে, সরকারের এক ঢিলে দুই পাখি মারার ষড়যন্ত্র বা লাভ হিসেবে। তার কাছে নিশ্চিত তথ্য আছে,

 

বিএনপির দুইজন নেতা স্বেচ্ছায় দেন-দরবার করে(আমাদের ভাষায় তদবির) জেলে গিয়েছেন। এটাকে সে সমঝোতার জেল হিসেবেই দেখছে। এই সব নেতাদের জেলে নিয়ে সরকার হয় সমঝোতার নির্বাচনের ফায়সালা এদের সাথে করবে, নতুবা বিএনপিকে ভেঙ্গে খালেদা জিয়ার জন্য আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পথে কাঁটা বিছিয়ে দেবে। একান্ত যদি এদেরকে জেলে নিয়ে সমঝোতা ব্যর্থ হয়, তবে সরকার হার্ড লাইনে যেতে বাধ্য হবে, যাতে এই সব এলিট শ্রেণীর নেতাদের পক্ষে আর আন্দোলন সংগ্রাম করা সম্ভব হবেনা। কারণ সরকারের পেছনে এখন শুধুমাত্র সরকারী গুরুত্বপূর্ণ এজেন্সি সমূহকে দেখলে চলবেনা, এদের সাথে এখন রয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশের লজিস্টিক সাপোর্ট গ্রুপ। যা এখনকার জেলের ভাত যারা খাবেন বা স্বেচ্ছায় আন্দোলনের ভয় থেকে বাচার জন্য জেলে যাবেন, তাদের জন্য বুমেরাং হতে বাধ্য। একের পর এক গ্রেপ্তারে সারা দেশ যে ভাবে ফুঁসে উঠার কথা, বিএনপির নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে অর্থাৎ বিএনপির অগণিত-লাখো মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত নেতাদের হাইকমান্ড দূরে সরিয়ে রেখে শুধু মাত্র কতিপয় এলিট শ্রেণীর নেতা আর ব্যক্তিগত স্টাফ নির্ভর হয়ে পড়াতে, সেরকম স্ফুলিঙ্গ দেশের মধ্যে গড়ে উঠছেনা। সরকার যদি বিদেশী লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে জামায়াত-হেফাজত বিরোধী একশনে চলে আসে, তাহলে মাঠ থেকে জামায়াত উধাও হয়ে গেলে বিএনপি আর কিছুতেই দাঁড়াতে পারবেনা বলে এই অভিজ্ঞ ব্রিটিশ কূটনীতিকের অভিমত। তার মতে, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত স্টাফ শিমূল বিশ্বাসকে এরেস্ট- তার ভাষায় আই ওয়াশ মাত্র। সরকার গ্রেপ্তার আতংকে ব্যালেন্স সৃষ্টি করার জন্য, একই সাথে পরবর্তীতে অন্যদের সাথে জেলের মধ্যে সমঝোতার পরিবেশে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত স্টাফকে জড়িত রেখে একধরনের মিথ-বিএনপির ভিতর ও বাইরে সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।

তার মতে, নয়াদিল্লীর কূটনীতি ভারতের প্রখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসায়ও সমানভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলে। র এবং দিল্লীর ইন্টেলিজেন্স এর বাইরে ভারতীয় দেওবন্দের স্বনামধন্য আলেম সাহেবরা কখনো যাননা বলে এই ব্রিটিশ কূটনীতিকের অভিমত। সে আরো বলেছে, ব্রিটিশ শাসনের সময় মুসলমানদের খুশী করতে গিয়ে ব্রিটিশদের দ্বারাই এই দেওবন্দ এর সুযোগ। সুতরাং দেওবন্দ আলেম সাহেবরা যেমন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, তেমনি প্রভাব রাখেন যথেষ্ট এবং সেটা ভারত ছাড়িয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ প্রাচ্য, প্রতীচ্য ও পাশ্চাত্যেও সমানভাবে প্রভাব রাখেন, অন্তত মুসলমানরা যেসব স্থানে বসবাস করেন। নয়াদিল্লী জানে, এবং সেটা আমেরিকাও ভালো করে জানে, ব্রিটিশেরাও অবগত, র-এর মাধ্যমে ভারতীয় দেওবন্দের প্রভাবে বাংলাদেশের দেওবন্দীরা প্রভাবান্বিত হবেন-সরকারের কাছেও সেই তথ্য আছে। সুতরাং বিএনপি আন্দোলনের যে তুফান মেইলে ছিলো, নিজেদের অজ্ঞতায় আর স্যূটেড এই সব এলিট নেতাদের ভয়, সমঝোতা আর মার্কা মারা ছবি প্রদর্শনীর রাজনীতির কারণে হেফাজত নির্ভরতা না বাড়িয়ে অতি জামায়াত নির্ভর হয়ে মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের হাতে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে নিজেদের পরীক্ষিত অগণিত নেতা-কর্মীদের খোজ খবর না নিয়ে, নির্ভর না হয়ে বরং মারাত্মক ভুল করে বসে আছে। বিএনপিকে এই অবস্থাকে থেকে আগে বেরিয়ে আসতে হবে। মাঠের নেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। নতুবা এই সব এলিট শ্রেণীর নেতারা খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে আওয়ামীলীগকে এক ধরনের বিনা বাধায়, শুধু মাত্র হরতাল নির্ভর রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নির্বাচনে জয়ী করে দিয়ে দেবে।

মওদূদ আহমদ , এম কে আনোয়ার যখন এরেস্ট হন তখন তার কিছুক্ষণও আগে মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ফারুক খান, এ কে আজাদ এর সাথে সহাস্যে আলোচনা ও করমর্দন করেছেন, যা উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিলো। এমনকি প্রথম আলোর ঐ অনুষ্ঠানে আরো যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের অনেকেই বলেছেন মওদুদ ও আনোয়ারের মন্ত্রী ইনুর সাথে চুপসে একান্তে আলাপ অনেককেই বিস্মিত করেছিলো। সেদিনের একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির আরো এক সদস্য ডঃ মোশাররফ হোসেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় মোশাররফ সহ আরো অনেকেই মন্ত্রীদের সাথে করমর্দন করলেও যথারীতি একই রাস্তায় দিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে বেরিয়ে গাড়ীতে করে বাড়ীতে যেতে পারলেন। পারলেন না শুধু এই দুজন।কোথায় যেন একটা অন্য রকমের আলামত স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে।

( আগামী কাল থাকছে নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে খালেদা জিয়া কেমন করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, খালেদা জিয়া ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প… ! ) ।
Salim932@googlemail.com
১১ নভেম্বর ২০১৩

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *