আমেনা মহসিন একাধারে বিশ্লেষক এবং শিক্ষক।রাজনীতিকে নিরেট এক সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপনে এবং সঠিক বক্তব্য প্রদানে সচেষ্ট থাকেন। সেকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমি অবাক হইনি। রাজনৈতিক যে ধারাবাহিকতা ছিল তাতে এই বক্তব্য প্রত্যাশিত। তবে সর্বদলীয় সরকারের যে প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন তার মধ্যে দুইটি সমস্যা রয়ে গেছে। বিরোধী দল যে নির্দলীয় সরকারের দাবিটি করছে এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য আসেনি। দ্বিতীয়ত, সরকারের নির্বাহী প্রধান কে হবেন বা তার ক্ষমতা কি হবে তা স্পষ্ট হয়নি। এতে নতুন কিছু নেই।
আলোচনার বিষয়ে আওয়ামী লীগের আগ্রহ আছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এটা বাইরের দেশকে দেখানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ঠিক একই সুরে বলেছেন, এখনকার বাংলাদেশে সবচাইতে বিতর্কিত বঙ্গবন্ধুর সৈনিক আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। তিনি বলেছেন,প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেশবাসীকে হতাশ করেছে। মানুষ উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিল একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের। কিন্তু মানুষ চরমভাবে হতাশ হয়েছে। মানুষ তার কাছে সর্বদলীয় সরকার চায়নি, চেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রধানমন্ত্রীকে রেফারি হিসেবে দেশবাসী দেখতে চায় না।
আর এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার নেতৃত্বে থাকবেন আর আমাদের কাছে নাম চাইবেন- সেটা তো হতে পারে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য ব্রি. জে. (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এতদিন যে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। আমরা আশা করবো, জনগণ ও বিরোধী দলের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নেবেন। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএনপি কোন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।
আর আওয়ামীলীগ বলেছে বাহবা, বাহবা, ধন্য নেত্রী, ধন্য তোমায়, জাতিকে তুমি ধন্য করেছে এমন সুন্দর ভাষণে।
আসলে সবাই ভুলে ভরা। যারা বিরোধিতা করছে, যারা পক্ষ নিয়েছে- কারণ ভুল ভুলই, একটি ভুল হাজারো ভুলের জন্ম দেয়।এই আমাদের গণতন্ত্রের জন্মই যার ভুলের মধ্যে (এরশাদ ভালো করেই বলতে পারতেন, যদি সৎ হতেন), তাকে স্বচ্ছ ও পরিশুদ্ধ না করে চর্চা না করলে আরো ভুলের পরিমাণ বাড়বে বৈ কমবেনা। কথায় আছেনা, আমজনতা ভালো করেই জানেন-জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরার মোহনীয় ও মিষ্টি মধুর কণ্ঠে নজরুলের একটা গান খুব সুন্দর ও মানানসই লাগে। নজরুলগীতির ঐ জনপ্রিয় গান-ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা আছে, সবই ভুল…।ঠিক তাই যেন আমাদের আতুর গণতন্ত্র আর সর্বাধিক ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দলগুলোর নেত্রীদের বক্তব্য, বিবৃতি ও কর্মকাণ্ড-প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক-উভয় ক্ষেত্রেই।ভুল আর ভুলে ভরা আমাদের গণতন্ত্র আজ নিজেই যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর বিদ্রূপ করছে। গণতন্ত্রের লেবাসে যে রাজকীয় পোশাক তাকে পড়ানো হয়েছে, তাও তার গায়ে বেমানান। কারণ আমাদের এই নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রের কথা বলে, গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না করে, গণতন্ত্রের জন্য খৈ ফুটিয়ে চলে, জাতিকে উদভ্রান্ত ও বিভ্রান্ত এবং পাগলের মতো অখাদ্য, কুখাদ্যের মতো মদ-গাজা-আফিমের সীসারূপী নানান মত, তত্ব,তথ্য যখন তখন দিয়ে চলেছে। এ যেন কোরআনের মতো বেধ বাক্য হয়ে আছে, হুকুম নড়েতো হাকিম নড়েনা। দেশ জাহান্নামে যাক, তবুও নেতা-নেত্রী তাদের ইগো আর তথাকথিত রাজনীতির আড়ালে অরাজনৈতিক পশুসুলভ আচরণ থেকে সরে আসবেনা। দেশের সম্পদ জ্বলে-পুড়ে ছার-খার হয়ে যাক, জনগণের বারোটা বেজে চলুক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা দিনের পর দিন গণতন্ত্রের জন্য সেক্রিফাইস করুক, বন্ধ হয়ে থাকুক, ব্যাংক, বীমা লুটে পুটে খাক, তাতে কী ? ধন্য জাতি তোমাদের-কারণ এই নেতা-নেত্রী জান বাজী রেখে, কেউ কেউ বুকের রক্ত ঢেলে দিবে-তবুও তাদের মতো তাদের গণতন্ত্র থেকে তারা পিছু হটবেনা। গণতন্ত্রের শ্বাসত যে সুন্দর রূপ, সকলের মত-দল-ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সমাজ পরিচালনা করা, আব্রাহাম লিংকন নামক গণতন্ত্রের ঐ বাবাজীকেও এই বাংলার নেতা-নেত্রীর কাছে এসে গণতন্ত্রের পাঠ নিতে হবে, নাহলে লিংকন বাবাজীর গণতন্ত্রের ঐ সংজ্ঞা গভঃ অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল-তাও দুষিত হয়ে যাবে, কারণ আমাদের অতি ক্ষমতাধর নেতা-নেত্রীরা সেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে সার্টিফাই দিবেনা। কি সাংঘাতিক ক্ষমতা!
এই যখন অবস্থা, তখন ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী কেমন করে গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলবে, গণতন্ত্রের শিক্ষায় নিজেকে পরিচালিত করবে, দল চালাবে, দেশ চালাবে ? এরকম ভাবাটাওতো বোকামি। গণতন্ত্রের নামে তিনি যে দলের প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলের নেত্রী-ভুল করে হলেও তিনি কখনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হননা। গোড়াতেই যখন গলদ-তখন সেই গলদ শুধু গলদেরই জন্ম দেবে। তাকে কেন্দ্র করে যে দল, সেই দলের ভিতরে কখনো গণতন্ত্রের ছিটে-ফোটাও নেই, তারপরেও আমরা মহান গণতন্ত্রী।
বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের মুহূর্তে গোটা জাতির জনগণ, আমজনতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সকলেই যখন উৎকণ্ঠিত এবং সেই সাথে গোটা বিশ্বের গনতন্ত্রকামি বন্ধু ও জনতা যখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকার নিয়ে উদ্বিগ্ন-ঠিক তখনি গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী নেত্রী ও সরকারের প্রধানের জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্যে গোটা জাতি ও বিশ্ববাসী ভাবছিলো, অবশ্যই সরকার প্রধান তার বক্তব্যে কোন না কোনভাবে সেই রাজনৈতিক সংকটের নতুন ও সম্ভাবনাময় এক দিক নির্দেশনা দিবেন। সেই নতুন দোয়ার খোলার পরিবর্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির সম্মুখে বার-বার সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজের অজান্তে কিংবা ইচ্ছে করেই ভুল ব্যাখ্যা কি করে দিলেন বা এমন ভুল ব্যাখ্যা কেমন করে তিনি দুইবার উচ্চারণ করতে পারলেন-রাজনৈতিক বোদ্ধা ও বিশ্লেষকদের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা। আসলে নজরুল গীতির ঐ গানের কলির ন্যায়-ভুল সবই ভুল…আর ভুলে ভরা জীবন ও রাজনীতির খেড়োখাতা নিয়ে গণতন্ত্র নামক সুন্দর ব্যবস্থায় আত্মস্থ করে জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়- আমাদের ভুলে ভরা ঐ নেতৃত্ব ও নেত্রীরা তাই বারে বারে বুঝিয়ে দিলেও এই অধম বাঙালি ও তাবৎ বাঙালির ঘুম আর ভাঙ্গেনা। কুম্ভকর্ণের ন্যায় ঘুমিয়ে আছে আর ঐ ফলোয়ারদের সাথে তাল মিলিয়ে জানবাজী রেখে চলেছে, জোরছে বলছে, শ্লোগান ধরছে, নেত্রী তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে।
সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহবান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন এবং সংসদ আহবান কালে রাষ্ট্রপতি প্রথম বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণ করিবেন। কিন্তু সংসদ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদে দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে দুইবার যেরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেরকম বলাছিলো ১৯৭২-৭৩ সালের স্কুল, কলেজের জন্য পঠিতব্য পৌরনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামক পুস্তকে। আবার সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন ও ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার ক্ষমতা, দায়িত্ব কেবল নির্বাচন কমিশনের, এখানে প্রেসিডেন্টের বা প্রধানমন্ত্রীর করার কিছুই নেই। তাহলে প্রধানমন্ত্রী তার কাটা-ছেড়া সংবিধানের দোহাই দিয়ে কী করে এমন ভুল ব্যাখ্যা জাতিকে দিলেন ? আসলে শেখ হাসিনা জানেন, ভুলে ভরা আমাদের এই রাজনীতি ও রাজনৈতিক পঙ্গপালের জনগণ- তার এই ভুল ব্যাখ্যা নিয়েই সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর এক কোনা থেকে মিছিল মিটিং আর টিভি ক্যামেরার সামনে তার কথিত সমর্থক আর মন্ত্রী ও হোমরা-চুমরারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে বলবে নেত্রী ঠিক বলেছেন, কতো উদার মনোভাব নিয়ে সংবিধানের সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে বিরোধীদলকে আহবান জানিয়েছেন।এদের এই সমর্থনের ব্যাখ্যা কোন কোন টিভি-ক্যামেরাও ভেঙ্গে যাবে, তবুও এরা থামবেনা। কারণ ভুলে ভরা রাজনীতির পাঠশালার শিক্ষক, সাগরেদ আর ভক্তরা কখনো থামতে চায়না। কারণ থামলেইতো সব শেষ। ভুলের রাজনীতি থেকে যারা শিক্ষা নেয়না, জাতিকে তারা ক্রান্তিকাল থেকে উদ্ধার করতে পারেনা। অতীতেও তাই হয়েছে, এবারও তাই হতে চলেছে। কেননা, একটি ভুল থেকে হাজারো ভুলের যে জন্ম হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের সঠিক পন্থা বেছে না নিলে, বাঙালি জাতিকে আরো মাশুল গুণতে হবে, হয়তো সেটা হবে ভুলে ভরা জরুরী আইনরূপী দানবীয় শাসন কিংবা ওয়ান-ইলেভেনের চাইতে তথাকথিত গণতান্ত্রিক নয়া লেবাসরূপী কৃষ্ণ কোহরে কিংবা অন্ধকারের সুড়ঙ্গের না দেখা ঐ প্রান্তের আজব-দানবীয় শাসন। আমরা কী সেদিকেই চলেছি। ভুল আর ভুলের রাজা-রাণী-মহারাণীরা কি বলবেন?
Salim932@googlemail.com
18th October 2013