প্রিয় মা,
১৮ মাস হতে চললো, আপনি আপনার কলিজার টুকরো, নাড়ি ছেড়া ধন প্রিয় সাংবাদিক সাগর সারোয়ারের মুখে আম্মা ডাক শুনতে পাননি। একজন মমতাময়ী মায়ের জন্য এযে কতো বড় কষ্টের, কতো বড় মর্ম যাতনার, তা কেবল আপনিই জানেন মা। এ কষ্ট, এ যন্ত্রণার দগ্ধ ক্ষত কোনভাবেই তাবৎ বিশ্বের সমস্ত সম্পদ রাশি আর ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েও লাঘব করা যাবেনা।
মাগো,
অন্যায়, অবিচার ও সমাজের দুষ্ট ক্ষত দূর করার মহান ব্রত নিয়ে প্রিয় সন্তান সাগর সারোয়ারকে সাংবাদিকের মতো ঝুঁকি পূর্ণ মহান এক পেশায় নামতে দিয়েছিলেন। বুক ভরা স্বপ্ন আর সাধ ছিলো, সাগর তার লেখনীর মাধ্যমে, সংবাদ চিত্রের মাধ্যমে সমাজের সব অন্যায়, অবিচার আর পাপীদের দুষ্টু চেহারার কালো মুখোশ খুলে দিবে। এক মহান নির্ভীক কলম যোদ্ধার অকুতোভয় সৈনিকের মা হয়ে আপনি বড় গর্ব আর এক রাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রতিদিন, প্রতিরাত নীল আকাশের ঐ তারার সাথে মিতালী করে কতো রাত, কতো নিশীথ রজনীই না আপনি পার করে দিয়েছেন। ২০১২র ১১ই ফেব্রুয়ারির পর মাগো আপনার চোখের জলে পদ্মা-যমুনার ঐ কালো জল কানায় কানায় পূর্ণ করেছে, কিন্তু আকাশের ঐ নীল তারকারাশী সাগর-রুনি প্রিয়তমা মমতাময়ী আম্মা ডাক নিয়ে আর কখনো ফিরে আসেনি। দরজার চৌকাঠে গভীর রাতে কতো কড়াই নেড়ে চলে, মমতাময়ী মা তখনো বিছানা থেকে হাপিশ-হিপিস করে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে জেগে উঠো আর এদিক ওদিক করে তাকিয়ে থাকো এই বুঝি কলিজার নাড়িছেঁড়া ধন সাগর-রুনি মোটর বাইক চালিয়ে হুম হুম শব্দে ঘরে এসে ডুকে জড়িয়ে ধরে বললো, মাগো কেমন আছো মা, আমি তোমার সাগর তোমার কোলে ফিরে এসেছি। পরক্ষনেই জলে ভিজে চলে আপনার চোখ, বুক খানি বড় ছিম-ছাম করে শূন্যে বয়ে চলে, আকাশের দিকে এক পলক উদাস নয়নে তখনো চেয়ে থাকো, ঐ বুঝি সাগরের মুখখানি ক্ষণিকের জন্যে হলেও দেখা দিবে।
মা আমার মা,
জীবনের মূল্য নাই- আগে জানলে সাগরকে সাংবাদিক হতে দিতেনা- এমন বক্তব্য পত্রিকায় দেখেছি মা। বড় কষ্ট আর যত্ন নিয়ে ভেজা চোখে ছাপার অক্ষরের ঐ শব্দগুলো বারে বার পড়ার চেষ্টা করেছি। পারিনি মা। বড় হেরে গেলাম আমরা। সাগরকে ফিরিয়ে দেয়াতো সম্ভব নয়, অন্তত সাগর-রুনির হত্যার বিচারের কাজও শুরু করা গেলোনা। কতোখানি ব্যর্থ আর অপদার্থ হলে এমন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডে জেগে উঠা প্রিয় সাংবাদিকদের ঐক্য আজ এমন জবু তবু, বহু খণ্ডেই শুধু বিভক্তিই নয়, প্রিয় সহকর্মীদের এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচারের দাবীতে ও স্মৃতি রক্ষার্থে নেই কোন মহতী উদ্যোগ। এ যে কতোবড় দীনতা, কতো বড় পাষণ্ড আর পাপিষ্ঠদের সহযোগী আমরা, কি করে বুঝাই বলো মা।
মাগো,
স্নেহময়ী মায়ের করুন আর্তি, আর নিষ্পাপ মেঘের সকরুণ আর্তনাদ যাদের বুক ফেটে চৌচির হওয়ার কথা, তারাতো আজ বড় দিব্যি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা আর এসির ঠাণ্ডা মাথাল হাওয়ায় বিবেক, বিচার, বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা আর পেশী শক্তি ও টাকার কাছে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছে। বিচারের ভার যাদের উপর তারাইতো আজ হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সাগর-রুনীর বিচার করবে কে মা? বিচারের নামে এক মমতাময়ী, এক প্রেয়সী মায়ের কোমল হ্রদয়কে ওরা টুকরো টুকরো করেই ক্ষান্ত হবেনা, মাগো আপনাকে আরো এক রাশ কষ্ট আর যাতনার মধ্যে ফেলে দিবে, তবুও পাপিষ্ঠদের মন-দেহ তৃপ্তি মিলবেনা।সাড়ে তিন হাত কবরের অন্ধ প্রকোষ্ঠে না যাওয়া পর্যন্ত পাপিষ্ঠ আর দুষ্টু বিষাক্ত বিষধর ঐ সর্পদেবী-দেবতাদের থাবার হাত থেকে সাগর-রুনীর রেহাই মিলবেনা।
মাগো,
১৮টি মাস অনেক দীর্ঘ সময়। একমাত্র সন্তান ও প্রিয়তমা বৌমার হত্যার বিচার পাওয়া এ আপনার সাংবিধানিক নৈতিক অধিকার। কিন্তু অধিকার যে রাষ্ট্র করে রেখেছে, এ অধিকার যারা সুরক্ষা করবে বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে, তাদের সাথেতো ঐ হত্যাকারীর দহরমমহরম। দীর্ঘ ১৮টি মাসের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত আপনি চেয়েছেন হত্যাকারীর শাস্তি হউক। মাটি খুড়ে এরা প্রমাণ বের করতে পারে, অথচ সাগর-রুনির হত্যাকারীর কোন কল কিনারা করতেই পারলোনা। এটা রীতি-মতো একজন মমতাময়ী মায়ের সাথে এই রাষ্ট্রের বড় রকমের এক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সাগরের আম্মা মরিয়ম সালেহা- বাংলাদেশের অগণিত মরিয়ম সালেহা আর তাদের মমতাময়ী, স্নেহময়ী কলিজার নাড়িছেঁড়া টুকরোদের কাছ থেকে সকল ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে আপনার মোনাজাতে একাত্ম হয়ে বলতে চাই, মা আমরা সাগর-রুনীর হত্যার বিচার চাই।এই রাষ্ট্র সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ব্যর্থ হলেও কাল কেয়ামতের ময়দানে মহান আল্লাহ পাকের দরবারে ঐ খুনি আর লুটেরাদের মুখোশ পিঞ্জর দিয়ে পিচমোড়া করে বেঁধে ওদের সহযোগীদের সাথে আল্লাহর আদালতে যেন তোলা হয়, যাতে আমাদের মমতাময়ী মা সালেহা মরিয়মের দরদ মাখানো আত্মা তৃপ্ত হয়। আমীন। মা-এই আমাদের মিলিত প্রার্থনা, শত ঘৃণা, শত ধিক্কার ঐ খুনি হায়েনাদের যারা নৃশংসভাবে খুন করেছে সাগর রুনিকে, এতিম করে দিয়েছে ছোট্র মণি মেঘকে।
২৫ আগস্ট ২০১৩ .