ব্রিটেনের বাংলাদেশী ক্যাটারিং সেক্টর: সফল অথচ ঈদের দিনে স্টাফদের ছুটি নেই

ব্রিটেনের বাংলাদেশী ক্যাটারিং সেক্টর: সফল অথচ ঈদের দিনে স্টাফদের ছুটি নেই

ব্রিটেনের প্রায় ৮০ ভাগ বাংলাদেশী, ভারতীয়, পাকিস্তানী রেস্টুরেন্ট সেক্টরে কাজ করেন। ব্রিটিশ ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে এই সেক্টরে প্রায় ৮০ হাজারের মতো বাংলাদেশী কর্মরত।আর ভিএটি ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেলো প্রায় ১ লক্ষ ২৬ হাজারের মতো বাংলাদেশী-ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
ব্রিটেনের যে কয়টা সেক্টর রয়েছে, তার মধ্যে বলা যায় সব চাইতে নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ এক সফল ব্যবসায়ের সেক্টর এই ক্যাটারিং ইন্ডাস্ট্রি। এখাত থেকে বছরে লক্ষ লক্ষ ভিএটি সরকার পেয়ে থাকে। বিগত লেবার সরকারের সময় থেকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার দখলের সময় প্রায় সকল ক্ষেত্র নানা আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়লেও ক্যাটারিং সেক্টর ( তাও শুধু বাংলাদেশী-ইন্ডিয়ান ) মন্দার কবল থেকে নিজেদেরকে দূরত্বে রাখতে সক্ষম হয়। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরের সকল ক্ষেত্রেই চাকুরী কাট-ছাট ও বাজেট সংকোচন করে চলতে হয়েছে, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ও ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানকে প্রায়ই বিগত কয়েক বছরে বলা নেই কয়া নেই হঠাৎ করে এডমিনিস্ট্রেশনে চলে যাওয়া যেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক খবর ছিলো, যার রেশ এখনো ব্রিটিশ অর্থনীতিতে রয়ে গেছে, সেখানে বাংলাদেশী ক্যাটারিং ইন্ডাস্ট্রি বেশ নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে কোন প্রকারের দেউলিয়া ও দেনার দায় ছাড়া সামান্য কাট-ছাট করে সফলতার সাথে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের ক্যাটারিং সেক্টরের সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা খোদ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে হোম সেক্রেটারি থেরেসা মে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিলিব্যান্ড সহ সকলেই সমানভাবে পঞ্চমুখ। আর বাংলাদেশী শেফ ও ওয়েটারদের সেবার মান ও দক্ষতার কথাতো হর হামেশা ব্রিটিশ মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টের সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ নানা তারকা সম্বলিত খেতাবের কথাতো লেগেই আছে।

রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য করে খ্যাতি অর্জন করে ব্রিটিশ মেইন ষ্ট্রীম মিডিয়া ও মেইন ষ্ট্রীম রাজনীতিতে ঝড় তুলেছেন আমাদের রেড ফোর্টের আমিন আলী, লি-রাজের এনাম আলী এমবিই, ব্রিটানিয়া স্পাইসের সাবেক কন্সাল জেনারেল ওয়ালী তছর উদ্দিন এমবিই, শাহগীর বখত ফারুক, বজলুর রশীদ, পাশা খন্দকার, ভোজনের মাহতাব মিয়া, বিসিসির মুকিম চৌধুরী সহ হালের তরুণ ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের সাফল্য এক্ষেত্রে আরো অগ্রগামী। তরুণদের ক্যাটারিং সেক্টরের নানা ও নিত্য নতুন ফিউশন এক্ষেত্রে অগ্রজদের ছাড়িয়ে গিয়েছে, যেমন ম্যাঙ্গো, তামারিন,ক্যাফে স্পাইস,মোম্বাই এক্সলেম্পরারী ইত্যাদি।

সেই কবে কখন ব্রিটেনে প্রথম কারী সাম্রাজ্য গড়ে উঠার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিলো, তা রীতিমতো গবেষণার দাবী রাখে। হালের ব্রিটেনের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন লন্ডন ও নিউক্যাসল)এ নিয়ে গবেষণা শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে। যদি তাই হয় আমাদের ক্যাটারিং সেক্টরের আধুনিকায়ন ও নিত্য-নতুন ফিউশন ক্রিয়েট করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।

**ব্রিটেনে সব কটা সেক্টরের কর্মচারী, কর্মকর্তা, অফিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্মেসী, জরুরী বিভাগ, ব্যবসা, ফ্যাশন, সুপার মার্কেট প্রভৃতি সেক্টরের সকলেই বছরে আইনানুগ ভাবে নানান হলিডে যেমন উপভোগ করে থাকেন, একই সাথে সামারের ছয় সপ্তাহ হলিডে ও ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার হলিডে, ব্যাংক হলিডে – এই ছুটিগুলো একজন শ্রমিক, একজন কর্পোরেট, একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন মন্ত্রী, একজন ক্লিনার, একজন কেয়ার টেকার, একজন নিরাপত্তা কর্মী, একজন পুলিশ সকলেই সমানভাবে এবং অল্টারনেটিভ এরাঞ্জম্যান্টের মাধ্যমে(প্রয়োজনের সময়)ভোগ করে থাকেন।এতে একজন শ্রমিক ও কর্মকর্তার জন্য সমান আইন সমানভাবে প্রযোজ্য, তার জন্য তার ট্রেড ইউনিয়ন সমানভাবে দায়িত্বশীল।এটা তার নাগরিক এবং আইনগত অধিকার। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান এই অধিকার রক্ষা ও সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর, এ অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারেননা।**

 

ব্যতিক্রম শুধুমাত্র বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট ও এ সেক্টরের কর্মরত কর্মচারীদের। বাংলাদেশী এই ৮০ হাজার এবং কোন কোন তথ্য মতে এই সংখ্যা আরো দ্বিগুণ হবে(অরেজিষ্ট্রিকৃত মিলিয়ে)শ্রমিক- ওয়েটার,কুক,শেফ,ম্যানেজার,এসিসট্যান্ট ম্যানেজার,অর্থাৎ এই সেক্টরে জড়িত কেউই বছরের এই নির্ধারিত জাতীয় হলিডের ছুটি ভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, এই সেক্টরের কেউই আমাদের জাতীয় হলিডে দুই ঈদের মতো উৎসবেও ছুটি ভোগ করতে পারেন না। কেউ চাইলেও ছুটি নিতে পারেননা। কেননা রেস্টুরেন্ট সেক্টর খোলা থাকে, আমাদের ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন কিংবা এর ফেডারেশন ও এর মালিকবৃন্দ যৌথ উদ্যোগ নিয়ে এব্যাপারে নিজেদের জাতীয় ধর্মীয় এই উৎসবে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখার কোন উদ্যোগ নিয়েছেন বলে শুনা যায়নি। বেশ কিছুদিন আগে, ইংল্যান্ডের নর্থের কতিপয় বাঙালি নিজেদের উদ্যোগে শুধু মাত্র নিজেদের শহরের ভিতরে সব কটা রেস্টুরেন্ট বন্ধ রেখে ঈদ উৎসব পালন করার ব্যবস্থা কিঞ্চিত ভাবে নেয়া হয়েছিলো। এতে আশানুরূপ সাড়াও পড়েছিলো। কিন্তু যিনি বা যারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, দেখা গেলো সেই উদ্যোগের সাথে জড়িত একজনের রেস্টুরেন্ট ছাড়াও টেকওয়ে ব্যবসা থাকায় সকলের অগোচরে ঈদের দিন নিজের টেকওয়ে খোলা রেখে দেদারছে ব্যবসা করে বসেন, যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাঙ্গন ও ফাটল দেখা দেয়। যার ফলে ঐ শহরের ঐ উদ্যোগ আর এগোয়নি। এর পরের বছর শুধুমাত্র লাঞ্চ আওয়ারে ঈদের নামাজের সুবিধার্থে সবাই মিলে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখার উদ্যোগ নিলেও দু একজনের কারণে তাও আর সম্ভব হয়নি। লোকাল কাউন্সিলে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ব্যবসায়ীরা স্বাধীন। তারা যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কাউন্সিল তাতে পূর্ণ সহযোগিতা করবে। তারা যদি ঈদের দিন রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখেন, কাউন্সিল তাতে স্বাগত জানাবে ও কাস্টমারদের কাছে সেই তথ্য সরবরাহ করবেন, মুসলিম ধর্মীয় ঈদ সেলিব্রেশনের সুবিধার্থে এই সেক্টর(বাংলাদেশী) ঈদের দিন বন্ধ থাকবে।

বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস বারার স্কুল ও ইংল্যান্ডের নর্থ-ইষ্টের স্কুল গুলো পর্যন্ত হেড টিচাররা আন-অফিসিয়ালি ছেলে-মেয়েদের ঈদের ছুটি ভোগের অধিকার দিয়ে থাকেন, এটা এখন প্রায় ফর্মালি হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের রেস্টুরেন্ট সেক্টরের কর্মরত ভাই-বোনেরা কখনো এই ফেয়ার ছুটি থেকে বঞ্চিত। এমন নয় যে ঈদের দিন কাজ করলে ওভার টাইম স্কেলে বেতন দেয়ার বিধান চালু রয়েছে, তাও নয়। তারপরেও কেন যে তারা বঞ্চিত ? নিছক মুনাফা আর ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এক্ষেত্রে ক্যাটারার্স এসোসিয়েশন ও অন্যান্য সংস্থা মিলে একটা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। সবাইমিলে যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে টেলিভিশন বা নিউজ পেপারের মাধ্যমে জানিয়ে দেন, ঈদ উৎসব পালনের জন্য রেস্টুরেন্ট, টেকওয়ে ঈদের দিন বন্ধ থাকবে- তাহলে ব্যবসায়ীদের এমন কোন ক্ষতি হবেনা। সারা বছরইতো ব্যবসা খোলা থাকে, ক্রিসমাসের দিন, নিউ ইয়ারের দিন, যেখানে সমস্ত ব্রিটেন ঘুমিয়ে থাকে, সেই সব দিনেও আমাদের রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে, তাহলে দুই ঈদের দিন রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখলে তেমন কোন ব্যবসায়িক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেননা প্রবীণ লন্ডনী ক্যামডেনের বাসিন্দা ইদ্রিস আলী। বার্মিংহামের মুরুব্বী সোনাই মিয়া, রচডেলের কণা, ব্রাডফোর্ডের শাহেদ, লন্ডনের রোকন, মিসবাহ, নিউক্যাসলের শিমূল, রায়হান সকলেই একই মত পোষণ করেন।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, কোন কোন রেস্টুরেন্টে আমাদের দেশের কোন কোন ইল্যিগ্যাল ইমিগ্র্যান্টদের নামমাত্র বেতনে দিনের পর কাজ করানো হচ্ছে, এবং সেই সুবাধে তারা অমানবিক জীবন যাপন করছেন। কিন্তু তারা না পারছেন যথাযথ আইনের আশ্রয় নিতে, না পারছেন মালিককে মুখ ফুটে কথা বলতে।তবে এ সংখ্যা এখন অনেক কমে এসেছে, সাম্প্রতিক ব্রিটিশ বর্ডার এজেন্সির ধরপাকড়ের ফলে। বর্ডার এজেন্সি এখন একটাই শ্লোগান হয় পালাও, না হয় ধরা পড়ো, নিজের দেশে চলে যাও। ব্রিটেন এখন ইল্যিগ্যাল ইমিগ্র্যান্টদের জন্য জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে।

সাবেক কন্সাল জেনারেল, ক্যাটারার্সদের অন্যতম নেতা এবং বিসিসির ওয়ালী তছর উদ্দিন বেশ আগে জানিয়েছিলেন অবশ্য ঈদের সময় রেস্টুরেন্ট কিভাবে বন্ধ রেখে সবাই মিলে ঈদ উৎসব পালন করা যায়, সেই নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌছা যায়নি। বর্তমান সময়ে কমেন্টের জন্য যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

নর্থ-ইষ্টের অনেক ক্যাটারার অবশ্য ঈদের দিন রেস্টুরেন্ট বন্ধ রেখে সবাই মিলে ঈদ উৎসব পালনের পক্ষে।

কিন্তু কেউ ই নিজের এলাকাতে এই উদ্যোগ শুরু করার উৎসাহ পাননা, নিজেদের অনৈক্যের কারণে। একজন আক্ষেপ করে বলেছেন, আজকে আমি যদি করি, এবং আমরা সবাই মিলে যদি এই সিদ্ধান্তে পৌছি, যে ঈদের দিন রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হবে। কিন্তু দেখা যাবে আমাদের এখানে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও কেউ কেউ লোভের বশে টেকওয়ে, রেস্টুরেন্ট ঠিকই খুলে ব্যবসা করছেন। আসলে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য আর সন্দেহ থেকে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাচ্ছেনা।

ব্রিটেনে বেড়ে উঠা আজকের তরুণেরা তাদের এই রাইট হলিডে ভোগ করার জন্য উদগ্রীব। তাদের কেউ কেউ ভাবছেন, বিভিন্ন এজেন্সির সাহায্য নেয়ার, নাহলে ক্যাটারার সেক্টরের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়বেনা। লোকাল সোশ্যাল সার্ভিস, ফুড এন্ড হাইজিন অথরিটি, কাউন্সিল মিলে হয়তো শেষ পর্যন্ত এই হাজার হাজার শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় যখন এগিয়ে আসবে, তখন নিজেদের ক্ষতি করে হলেও কর্মচারীদের ছুটির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হবেন। কেননা ব্যবসা এবং কর্পোরেশন ও ইউনিয়নের আইনের প্রয়োগ হলে রেস্টুরেন্ট সেক্টর বাধ্য হবেন বছরের এই সময়ে অতিরিক্ত কর্মচারী(অল্টারনেটিভ) নিয়োগ দিয়ে ঐ সময় স্টাফদের হলিডে দিবেন, জব সেন্টার ও ডিডব্লিউপি এবং ইউনিয়ন যখন ইনভলভ হয়ে যাবে তখনতো ঈদের দিনের লাভ সব গুড়ে বালি হয়ে যাবে। আমাদের রেস্টুরেন্ট সেক্টরের মালিক, কর্ণধারদের যত তাড়াতাড়ি সুবোধদয় হয়, ততোই মঙ্গল- বললেন সামসু, শাহিনুর, কোহিনুর, তাওয়াককুল সহ উপস্থিত আরো অনেকে, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই পেশায় কাজ করে চলছেন।

সূত্রঃ বিসিসিবি-লন্ডন
মিঃ এস ইসলাম-ক্যাফে স্পাইস
মুনজের আহমেদ চৌধুরী-বাংলা টাইমস
দ্য লাস্ট ডেইজ অব রাজ রেস্টুরেন্ট

Salim932@googlemail.com
29th July 2013.

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *