বাংলাদেশ নামক জন্মের পর থেকেই এই নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে এক ধরনের তর্ক-বিতর্ক এবং নানা সময় একে ঘিরে অনেক জটিল রাজনৈতিক অবস্থা তৈরি হয়ে আসছে। বিভিন্ন সরকারের সময় এই নির্বাচন কমিশন বলা যায় অনেকটা সরকারের তল্পি বাহক হয়ে কাজ করে, এ যেন এক রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। ব্যতিক্রম শুধু থাকে তত্বাবধায়ক সরকারের সময়।বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কিত ১/১১ সময়ে ডঃ শামসুল হুদা, ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন এবং ছহুল হোসাইন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, নানা সংকট সত্বেও।
তারমধ্যে যেমন উল্লেখযোগ্য ভোটার আইডি কার্ড, হাল নাগাদ ভোটার লিস্ট তৈরি, নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও স্বকীয়তা কল্পে বেশ কিছু আইনেরও বিধান চালু কিংবা সংস্কার করেন।যার ফলে ডঃ হুদা, সাখাওয়াত আর ছহূল হোসাইনের নির্বাচন কমিশন এ যাবৎ কালের নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সবচাইতে সফল ও সার্থক কমিশন হিসেবে সমধিক খ্যাত।
নিকট অতীতে আব্দুল আজিজ কমিশন আমাদের রাজনীতিতে কি ভয়ানক এক অবস্থার মুখোমুখি করেছিলো, আমরা সকলেই কমবেশি অবগত। রকিব- শাহ নেওয়াজ কমিশনের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ জনমনে বিভ্রান্তি ও নানা সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে স্বেচ্ছায় কোন প্রতিষ্ঠান, কিংবা কোন সাংবিধানিক সংস্থা নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য কোন পদক্ষেপ স্বেচ্ছায় নিয়েছে, এমন নজির নেই। আমাদের এই নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছায়, নিজেদের উদ্যোগে নিজেদের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্বের কেন উদ্যোগ নিলো, এটা কিছুতে কারো কাছে বোধ গম্য নয়। তবে কি বাজারে যে গুজব চালু রয়েছে, সাক্ষীগোপাল এই নির্বাচন কমিশন মূলত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের একটা উইং হয়েই কাজ করছে, আগামী নির্বাচন সরকারী ফর্মুলা মোতাবেক সম্পন্ন করার সব বিধি-বিধানে ব্যস্ত, যতটানা নিজেদের স্বাধীন-স্বকীয়তা বৃদ্ধি কল্পে নিবেদিত। যেখানে এই নির্বাচন কমিশন নিজেদের আলাদা বাজেট প্রণয়ন ও আর্থিক স্বাধীনতার জন্য কাজ করার কথা ছিলো, যা হুদা কমিশন অনেকটা এগিয়ে নিয়ে এসে রেখে গিয়েছিলেন, পরবর্তী কমিশনের জন্য, সেখানে তা না করে এই কমিশন জনপ্রতিনিধিত্ব বিধানের প্রার্থীতা রি-কলের নিধান সহ ভোটার আইডি কার্ড হাল নাগাদ না করা সহ আরো কতিপয় বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজে হাত দেয়। এই কমিশনের গোপন কাজ যা মন্ত্রী, সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ সংক্রান্ত বিধান ফাঁস হয়ে যাওয়ার ফলে গাবাচানোর জন্যে বলছে, এই রকম কিছু এখন আর করছেনা।
গতকাল এক আলোচনা সভায় সাবেক সিইসি ডঃ. এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, ৯১(ই) ধারা অর্জন করতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ২০০৮ সালে এর জন্য পাঁচবার সংবিধান পরিবর্তন করতে হয়েছে। অথচ বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই অর্জনকে স্বেচ্ছায় বির্সজন দিচ্ছে যা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে দুর্বল করে তুলবে। এভাবে ক্ষমতা খর্ব করা সলিলে প্রতিমা বিসর্জন দেয়ার মতো। এবং এটা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা।
আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ বলেছেন, দেশের ৯ কোটি ভোটারের মতামত নিয়ে আচরণবিধি সংশোধন করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হতো। তিনি আরো বলেছেন, দলীয় শৃঙ্খলার নামে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দলকে প্রদান করা ঠিক হবে না। কারণ এতে অনেক সৎ ও যোগ্য লোক প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, পস্তাবিত আইনে সিল মারার পরিবর্তে ভোটারকে ব্যালট পেপারে মার্কিং করে তা ব্যালট বাক্সে ঢোকাতে হবে, যা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি। নির্বাচনে না ভোটের বিধান থাকা উচিৎ এবং জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিশিষ্ট কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, আরপিও সংশোধনীর ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, যা জাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার শামিল।
হঠাৎ করে প্রধান বিরোধী দলের প্রতীক সহ মনোগ্রাম নিয়ে কোথাকার কে এসে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করলো বলেই কি তা অনুমোদন দিতে হবে নাকি ? এক্ষেত্রে প্রচলিত কোন বিধি-বিধানই ফলো করা হচ্ছেনা। এখন হঠাৎ যদি আরেকজন এসে নৌকা প্রতীকের জন্য আবেদন করে বসে, তাকেও কি তাই বরাদ্ধ করার তোড়-জোর করতে হবে নাকি? অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, রকীব কমিশন আগামী নির্বাচন ফ্রি ফেয়ার ও নিরপেক্ষভাবে করতে মোটেই বদ্ধ পরিকর নয়। এই কমিশন যদি তাই চাইতো, এতো সব সরকারি চাপের ফলে, নিজেদের ডিপ্লোম্যাটিক ভাবে আরো কিছুদিন সময় কিলিং করে কাঠিয়ে উঠতে বা ডিপ্লোম্যাটিক ভাবে হুদা কমিশনের ন্যায় মিডিয়ায় জানিয়ে দিতে পারতো। এরা তার কোন কিছু না করে বরং সরকারের তল্পিবাহক হয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।এদের এতোসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দেখে এখন লাল ইটের ঘরে বন্দীদের মতো আমাদের এই রকীব কমিশনকেও বলতে হচ্ছে, হে নির্বাচন কমিশন তুমি কার হয়ে কাজ করছ ? তুমিতো স্বাধীন, তোমারতো কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা রয়েছে, স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। তুমি তা না করে নিজের ক্ষমতাকে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিতে কেন উদ্যত হয়েছ? কোথায় তোমার হাত পা বাঁধা ? জনগণ যখন জেগে উঠবে, তখন আজিজ কমিশনেরও শেষ রক্ষা হয়নি, লাল টেলিফোনের বদৌলতে তোমারও শেষ রক্ষা হবেনা। সময়, সুযোগ থাকতে দেশ ও জাতির প্রতি তোমার যে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা, তা পুরোপুরি পালন করা হে নির্বাচন কমিশন!
১লা আগস্ট ২০১৩।