বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আওয়ামীলীগের একচ্ছত্র ক্ষমতা আর দাম্ভিকতার প্রতিবাদের একমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে জলিল-রবের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ মাঠের রাজনীতি ও পার্লামেন্টের রাজনীতি গরম করে রাখার জন্য জনতার একমাত্র ভরসার স্থল হিসেবে বিবেচিত ছিলো। তখনো আওয়ামীলীগের ঐ পার্লামেন্টের তরুণ সদস্যদের অ-সংসদীয় ভাষা আর খিস্তিখেউড়ে অতিষ্ঠ হয়ে আর তখনকার তরুণ আর যুবসমাজের মুকুটহীন সম্রাট আর বিপ্লবী প্রতিভূ হিসেবে জাঁদরেল জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব জনসভায় হুঙ্কার দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পার্লামেন্টকে শূয়রের খোঁয়াড় হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
এ নিয়ে তখনকার পত্র-পত্রিকা ছিলো বেশ গরম আর গণকন্ঠ বাজিমাৎ করে রেখেছিলো। মাত্র কিছুদিন আগে রাণুর পর অপু উকিল তারপর আরো অনেকই, এই আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যগণ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে বিশেষ করে বড় দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও পরিবার নিয়ে এতো নোংরা, অশ্লীল ভাষায় খিস্তিখেউড় আওড়িয়ে চলেছেন, যা রীতি মতো যেকোন সুস্থ মস্তিষ্কের লোক পাগল হয়ে যাওয়ার মতো। হেন কোন ভাষা নেই যে আমাদের মাননীয় সাংসদরা আওড়াচ্ছেননা। হালের সাংসদের আওড়ানো চুদূর-বুদূর এখন বাংলাদেশের পথে-ঘাটে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যার রেশ কোলকাতার আনন্দ বাজার পর্যন্ত ঠেকেছে। আমাদের মাননীয় স্পিকারকে পর্যন্ত বলতে হয়েছে, চুদূর বুদূর চলবে, পরীক্ষা করে দেখেছেন, এক্সপাঞ্জ করা যাবেনা। তাই বলে কি শিষ্টাচার বলতে কিছুই থাকবেনা, নাকি তাকেও বিদায় জানাতে হবে ? আফসোস হয় আমাদের সংসদ কি শেষ পর্যন্ত গালি প্রডাকশনের ফ্যাক্টরি বনে যায় কিনা, গালি দেয়া আর গালি চর্চার জন্য যেন এ এক নতুন পাঠশালা হয়ে গেছে। অথচ এখানে রয়েছেন অনেক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, দক্ষ রাজনীতিবিদ, উচ্চ শিক্ষিত অনেকেই আছেন, অথচ কেউই এই সব গালিগালাজ কিংবা অ-সংসদীয় ভাষা বর্জনের ব্যাপারে দলীয় সাংসদের বারণ বা নিবৃত্ত করছেননা। আর অবলীলায় সেই সব অ-সংসদীয় ভাষা সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে, যা স্যাটেলাইটের বদৌলতে সারা বিশ্বে দেখানো হচ্ছে।অথচ জন-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটা মানবিক হউক আর জনগণের প্রাণের দাবী হউক, সরকারের মনঃপ্লুত না হলে লাল টেলিফোনের আদেশ আসে ওটা যাবেনা, প্রচার করতে নিষেধ আছে। আর খোদ অ-সংসদীয়, অশ্লীল ভাষা সরাসরি প্রচার, প্রকাশ করতে কোন বাধা নেই। আহারে শুনতে কতো মধু্র লাগে! গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের বিদেশী শিক্ষক আমাদের এই সংসদীয় কার্যক্রম বেশ কয়েকদিন মনিটর করে হতাশ হয়ে বললেন, যে দেশে ইউনুসের মতো লোককে জন্ম দিলো, সেদেশে এমন অ-সংসদীয় রাজনীতির প্রতিভূদের সংসদে কে পাঠালো ? সংসদ সচিবালয় ও স্থানীয় এবং আইন মন্ত্রণালয়কে সংসদ অধিবেশনের শুরুতে সংসদীয় রীতি-নীতি এবং রাজনৈতিক ভাষা জ্ঞান, শিষ্টাচার নিয়ে বিশেষ কোর্স চালুর ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার তাগিদ দিলেন ডঃ ইভান্স।
একের পর এক খিস্তিখেউড় যখন চলছিলো, আমরা সাধারণ জনগণ যখন হতাশ হয়ে নীরব দর্শক হয়ে সেই সব সার্কাসের আর চুদূর-বুদূর মার্কা অ-সংসদীয় ভাষা শুনে অভ্যস্ত হয়ে এদের কাছে আত্মসমর্পণ করছিলাম, ঠিক তখনি এক ঝলক আশার আলো হয়ে জনগণের প্রাণের কথাই তুলে ধরলেন তরুণ সাংসদ আন্দালিব পার্থ আর জুনায়েদ পলক। জনতার অকুস্থলের একেবারে প্রান্তরেখা থেকে এই দুই সাংসদকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি, সাহস করে বিচক্ষণতার সাথে সত্য, সুন্দর ও সঠিক বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। রাজনীতিবিদ আর সাংসদদের কাছ থেকে জনগণ এটাই আশা করে। অশ্লীল, নোংরা কথা-বার্তা বলে সাময়িক বাহবা আর তালি পাওয়া যায়। জনতার মনে স্থায়ী স্থান করে নেয়া যায়না। আর মনে রাখা দরকার অশ্লীলতা অশ্লীলতাই ছড়ায়, দুর্গন্ধ কেবল দুর্গন্ধই ছড়ায়না, সমাজের ভিত্তিমূল ও আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য, মনন এবং ক্যারিশমাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি ততো বেশী উন্নত।আর শিক্ষিত ও উন্নত রুচির মানুষের কাছ থেকে কখনোই তার জনগণ অশ্লীল, নোংরা কথা-বার্তা আশা করেনা। আপনার রুচিবোধ, টেস্ট, মেজাজ, চিন্তা-ভাবনা সবই প্রকাশ পায় আপনার আচার,আচরণ, বাক্য চয়ন। মেধা আর বিকাশের আয়নাই হলো আপনার কথা-বার্তা, আচরণ, কাজ,কর্ম।
জাতি হিসেবে আমরা কতো অধঃপতিত অবস্থায় চলেছি, একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার জন্য এমন সব শব্দ আমরা চয়ন করে চলেছি, এমন সব উদ্ভট বাক্য, শব্দ ব্যবহার করে চলেছি, যা কেবল অ-সংসদীয়ই নয়, পুরো জাতির মেধা, বিবেক আর আগামী সব নেতৃত্বের মূলে সমূলে কোঠারাঘাত করে বিরাট এক প্রশ্নবোধক অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। এই কি আমাদের গণতন্ত্রের মহান চর্চা? এর নামতো গণতন্ত্র নয়। মাননীয় সাংসদরা দয়া করে জাতিকে বলবেনকি, কি করছেন আপনারা ? সৈয়দ হিলাল সাঈফ নামের ছড়াকার,যে আওয়ামীলীগের একজন নিবেদিত প্রাণ নেতা,কর্মী। প্রবাসের অসম্ভব ব্যস্ততা আর কষ্টকর জীবনের মাজেও সাংসদদের অশালীন বক্তব্যে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে একটি ছড়া লিখে পাঠিয়েছে আমার কাছে, আমার মনে হলো অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মনের কথাই সে তার ছড়ার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছে। পাঠকদের সুবিধার্থে তা এখানে তুলে ধরলাম-
অর্ধ লক্ষ্য টাকা প্রতি মিনিট বিল
সংসদে বসে ওরা ছুড়ে ঢিলা ঢিল
মহান সংসদে বসে কিছু নারী- নর
পারদের মত করে ওঠা নামা স্বর
বিশেষ পাড়ার বুঝি ঐ শালা- শালী
কথা গেলে কইতে শুধু গালা গালি
সংসদে গিয়ে তারা মারে ফালা ফাল
জাতির বিবেক হয়ে করে গালা গাল
ঝগড়াটে সাংসদ কিছু নর নারী
মারমুখী ভাব নিয়ে ফিরে যায় বাড়ি
চুদুর বুদুর’ যদি অশ্লীল হবেনা !!
চুত মারানি’ পোলা কেন আর কবেনা :
মায়ে বলে ছোট সোনা বি টিভি দেখনা
অধিবেশন দেখে দেখে আর কিছু শেখনা
সাংসদ জুনায়েদ যেমন করে বলেছেন, এই সব অ-সংসদীয় ভাষা এক্সপাঞ্জ করার সাথে সাথে ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং একই সাথে একদিনের জন্য প্রতীকী বহিষ্কার – সময় এসেছে স্পিকারকে এ সব নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে ভাববার। কারণ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রতি মিনিটের জন্য যেখানে ৩০ হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে, সেখানে এই সব ফাজলামি আর নোংরামি খিস্তিখেউড় শুনার জন্য জনগণ পাঠায়নি। দুই দলের শীর্ষ নেতা আর অভিজ্ঞ সাংসদদের এ ব্যাপারে অবশ্যই দায়িত্ব এড়াতে পারেননা।বাঘা বাঘা সাংসদ আর অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সংসদে জাতীয় নেতৃবৃন্দদের নিয়ে, এমনকি কবরের বাসিন্দাদের ধরার পৃথিবীতে ঠেনে এনে অ-সংসদীয় ভাষায় গালি গালাজ করে চলেন, আর সকলে মিলে টেবিল চাপড়ে বাহবা কিংবা হা করে শুনতে থাকবেন, এরকমতো হওয়ার কথা ছিলোনা।উনারা আমাদেরকে ও আগামী প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে চলেছেন, জাতি জানতে চায় ? কতিপয় উন্মাদ, বদ্ধ পাগল আর চিন্তা-চেতনায় দারিদ্র ক্লিষ্ট বিবেকহীন ব্যক্তির কারণে গোটা জাতির মন, মগজ, মস্তিষ্ক আর চিন্তা-চেতনার উপর কেউ তাচ্ছিল্য করুক, নিশ্চয় বিবেকবান কোন নাগরিক সেটা চাননা। একের পর এক বেহায়াপনা রাজনৈতিক ময়দানে করতে অভ্যস্ত হয়ে এরা শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের মতো মহান ও পবিত্র এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সমস্ত লাজ-শরম ভুলে গিয়ে, এমনকি ঘরে রেখে আসা নিজেদের পরিবার-পরিজন, বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে যে রেখে এসেছে, তারাও যে সেই সব কথা দিব্যি শুনছে,দেখছে, শরমে মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে ফিরছে, এমন কথাও এই সব অতি দামি আর অতি উঁচু মানের সাংসদরা বেমালুম ভুলে যান। এই যখন অবস্থা, তাহলেতো গণতন্ত্র কি করে বিকশিত হবে ?
মানুষ যখন একেবারে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়, তখন হয় সে বদ্ধ পাগল হয়ে শরীর থেকে সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে । আবার যখন একেবারে হতাশ হয়ে যায়, তখন, সে কি যে করে বসে, গুড়ের বশে কি বলতে গিয়ে কি বলে বসে, বুঝতে পারেনা। সংসদের মধ্যেতো বাইরের রাজপথের গরমের তীব্রতা যেমন নেই, আবার ধূলা-বালি কিংবা ঝড়ো বাতাসের কিংবা মাতাল হাওয়ার আবেদনও নেই। তাহলে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থেকেও হঠাৎ হলে কথা ছিলো, কারো কোন অতিরিক্ত ব্লাড প্রেসার বা কম প্রেসারের কারণে বলা যেতো, প্রতিদিনই সাংসদ নামক শফিক রেহমানের সেই প্রিয় ৩০ সেট অলংকারের সাথে ৩০০ আসনের মোঘল হেরেমের আর সেই রাজকীয় বেনাম-বাদশাহদের রাজকীয় গালি যখন রাস্তার মাটি কাটার গালির সাথে তুলনীয় হয়ে আরো নীচে চলে যায়, তখন লজ্জায় বাংলাদেশও মুখ লুকায় সালুটিকরের কিংবা লাল মাই পাহাড়ের পাদদেশে, মুখ থুবড়ে পড়ে প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ, নিজেকেই ধিক্কার দিয়ে চলে, কোন বঙ্গ সন্তানদের রেখে গেছো আমার কোলে মাটির ঘরে দিব্যি শোয়ে আছ বঙ্গবন্ধু মুজিব আর আমি মেজর জিয়া বলছি`র জিয়াউর রহমান। জবাব দাও হে বাংলাদেশ, আর ঘুমিয়ে থেকোনা, এবার জেগে উঠো, কথা বলো হে বাংলাদেশ আর ধুয়ে মুছে ফেলো ঐ সব উচ্ছিষ্ট শকুনের পৃষ্ঠপোষক আর পাপিষ্ঠদের। জয় হউক মানবতার, জয় হউক বিশ্ব বাঙালির ।
২৪শে জুন ২০১৩।