
তিন বাহিনীর সাথে সংসদীয় কমিটির বৈঠক: ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাইনারে !
তিন বাহিনীর সাথে সংসদীয় কমিটির বৈঠক: ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাইনারে !
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
সম্প্রতি সেনা বাহিনীর তিনটি ইউনিটের তিন প্রধানের সাথে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের খবর বেশ ঘটা করে পত্র-পত্রিকায় আলোচিত হয়েছে। কোন কোন পত্রিকার ঐদিন বেশ মোটা আকারের শিরোনাম দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাথে তিন বাহিনীর প্রধানের এই ধরনের বৈঠক হওয়াটা স্বাভাবিক এবং সেটা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় একটা রুটিন ওয়ার্ক হিসেবেই গণ্য। তবে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অতিমাত্রায় সহিংস রাজনৈতিক এবং উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশের প্রেক্ষিতে তিন বাহিনীর প্রধানের সাথে বেশ অনেকটা গ্যাপ দিয়ে হঠাৎ করে সংবাদ মাধ্যমে প্রেস ব্রিফিং করে এই ধরনের বৈঠকের খবর ফলাও করে প্রচারে রাজনৈতিক বুদ্ধা ও মিডিয়ার কাছে বলা যায় অনেকটা না চাইতেই যেন এক শীর্ষ অথচ বেশ উঞ্চ এক সংবাদ হিসেবেই গণ্য, যা তারা লুফে নেয়। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতার প্রেক্ষিতে কোন কোন মহল থেকে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের আশঙ্কা যখন জোরালো ভাবেই করা হচ্ছিলো, টকশো গুলোতে খোলাখুলি ভাবে সেই শঙ্কার কথা বলা হচ্ছিলো; এমনকি কিছুদিন আগে বগুড়ার জনসভায় প্রকাশ্যে বেগম জিয়া যখন বলেন, সেনাবাহিনী যথা সময়েই তার দায়িত্ব পালন করবে বা বসে থাকবেনা- তখন সেই আশঙ্কা পুরো জাতিকে করে তুলে আরো দ্বিধান্বিত ও অনেকেই বুঝে নিতে থাকেন সেনা হস্তক্ষেপ নিকটবর্তী।
পৃথিবীর কোন সশস্র বাহিনীর মতোই বাংলাদেশের সেনা বাহিনীও অত্যন্ত আধুনিক, সুশৃঙ্খল, নিয়মানুবর্তী এবং চেইন অব কমান্ডের মধ্যে পরিচালিত। প্রচলিত অন্য যেকোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চাইতে সেনা বাহিনী অনেকটাই চৌকস এবং খুবই সুশৃঙ্খল- এতে কোন সন্দেহ নেই। আর প্রশ্নটা হলো মূলত সেখান থেকে তথা এই সুশৃঙ্খল এবং চেইন অব কমান্ডকে ঘিরেই। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপ, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, তথা বিশ্বের যেকোন দেশের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই সেনা বাহিনী প্রতিটি দেশে তার চেইন অব কমান্ড এর মধ্যে এবং সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। জাতির যে কোন দুর্যোগ ও ক্রান্তিকালে তার সেনা বাহিনী সরকারের আহ্বানে ও নির্দেশে সরকারের সহযোগী অঙ্গ সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে। নিকট অতীতে আমরা আমাদের নানা দুর্যোগ ও ঘূর্ণিঝড়ে, সিডরে, কিংবা যানজট নিরসনে সশস্র বাহিনী গণতান্ত্রিক সরকারের আহ্বানে সরকারের সহায়তায় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে যেমন দেখেছি, একই সাথে ৮৩ র সামরিক শাসনে, বা ১/১১ নাটকীয় অনেক ঘটনা ও দুই বছরের জরুরী শাসনের আদলে সেনা শাসনের অবস্থায়ও দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বলা যায় সেনা সহযোগিতার সুফল ও কুফল, সহযোগিতা এবং ক্ষমতা গ্রহণ- এই দুই অবস্থাই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি । আবার বিশ্ব পরিমণ্ডলে অতীতে পাকিস্তান, আজকে ইথিওপিয়া, দাড়ফোর, রোয়ান্ডা, দারুসসালাম প্রভৃতি দেশে সেনা বাহিনীর ভূমিকা ও যুদ্ধাবস্থার চিত্র মিডিয়ার ব-দৌলতে আমদের দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে।
পৃথিবীর কোথাও সেনাবাহিনী আগাম বার্তা দিয়ে কখনো হস্তক্ষেপ করেছে, এমন উদাহরণ খুবই নগণ্য বা পাওয়া যাবেনা। ব্যতিক্রম কেবল যুদ্ধের সময়কালিন, স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধাবস্থা যখন বিরাজমান, তখন সেনাবাহিনী প্রকাশ্য ঘোষণায় সঙ্গত কারণেই দিয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সেনা বাহিনী চেইন অব কমান্ড এবং চৌকস, সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে কখনো হস্তক্ষেপ করবে এমন কথা ভুলেও বলতে পারেনা। সেদিনকার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে তিন বাহিনী সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে- এমন বক্তব্য বা ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই দিতে বাধ্য, যা দেশ,জাতি, সংবিধান ও সেনা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও শপথেরই বহিঃপ্রকাশ। এখানে তিন প্রধানেরা যথার্থভাবেই তাই করেছেন। কিন্তু বাঘের কাছে মেষ শাবক ইজারা যেমন দেয়া যায়না বা বিরাজমান উচ্ছৃঙ্খল , অরাজকতা ও জাহান্নামের মতো অবস্থায় যে কোন ওলট-পালট যে হবেনা বা হতে পারবেনা, এমন করে কি কেউ বলতে পারেন ? সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীর একশন কি হবে, বা ভূমিকা কি হবে, সেটাতো প্রয়োজনের সময় সেনাবাহিনী নিজ করণীয় ঠিক করে থাকে, এবং সেটা হয়ে থাকে অবস্থা ও ঘটনার প্রেক্ষিতে। ঘটা করে সংসদীয় কমিটির সংবাদ প্রকাশে ধরেই নেয়া যায় তলে তলে দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। নিজেরা সন্দেহমুক্ত নন বলেই সহিংস রাজনৈতিক ডামাডোলের সময় এমন করে সংবাদ প্রকাশ করে থাকতে পারেন। যেমন করে ইরাকের মাটিতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী যখন একের পর স্থাপনা দখল করে নিতেছিলো, তখনো তারিক আজিজ টেলিভিশনে বোমা ফাটিয়ে চলেছিলেন, যেমন করে লিবিয়ার পতিত শাসক গাদ্দাফী তার কম্পাউন্ডে বোমা হামলার পরেও হম্বি-তম্বি করে বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর হাস্যাস্পদ কৌশলী ভূমিকার আশ্রয় নিয়েছিলেন- কেন জানি মনে হচ্ছে, এই সরকারের সকল সংস্থাই নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দিহান হয়েই অতি হাইপার সিন্ড্রোম রোগে ভুগে মিথ্যে স্বর্গে বাস করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। আশা করি দেশে সেরকম অগণতান্ত্রিক কিছু হবেনা বা ঘটতে যাচ্ছেনা। কিন্তু যেভাবে দেশ চলছে, গুজবের পর গুজব ডাল-পালা বিস্তার করছে, তা গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য শুভ লক্ষণ নয়।
বর্তমান সহিংস রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সেনা হস্তক্ষেপ ১/১১র চাইতে যে ভয়াবহ হবে বা দীর্ঘায়িত হবে, সেটা সকলেই একবাক্যে প্রকাশ্যেই স্বীকার করছেন। একথা ভুলে গেলে চলবেনা, ১/১১ পরবর্তী অবস্থা রি-ষ্টোর করতে আমাদের লেগেছিলো দুই বছরেরও কিছু বেশী সময়, সরকারের অদক্ষতা, অসহিঞ্চু, অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, অন্ধগলির দিকে হাত মেলানোর ফলে যদি এরকম কোন পরিস্থিতির সুযোগে সেনা হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তবে তা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে আমাদেরকে দু বছর নয় পাঁচ বছরেও ফিরে আসা সম্ভব কিনা-সেটা প্রথিতযশা রাষ্ট্র বিজ্ঞানী তালুকদার মণিরুজ্জামানের মতের সাথে অনেকেই সন্দিহান। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি একটু প্রজ্ঞার পরিচয় দিবেন ?
Salim932@googlemail.com
19th April 2013.UK.