সংঘাত, বিভাজন না করলেই কি নয় ?

সংঘাত, বিভাজন না করলেই কি নয় ?

কেন এই সংঘাত, কেন এই বিভাজন বলবেন কি ?
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

রাজনীতি এখন ক্রমেই সহিংস রূপ ধারণ করেছে। সকল পক্ষই বলছে, দেশ অচল করে দিবে।কোন পক্ষই কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।একে অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে এখন মুখোমুখি অবস্থানে, আসলে কে যে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত করে আছে, বুঝা মুস্কিল।১৯৭১ সালের বাঙালির গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বাঙালি জাতি জেনেছিলো তারা যুদ্ধ করছে দেশ স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে। আজকের এই বাংলাদেশে সরকার বলুন, হেফাজতে ইসলাম বলুন, জাগরণ মঞ্চ বলুন, নারী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আন্দোলন বলুন- কে কার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, কেন নিয়েছে, কেন এই সংঘাত, হিংস্রতা, বিভাজন, হরতালের পর হরতাল, একের পর এক দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি-ধমকি, গোটা বাংলাদেশ আজ সন্ত্রস্ত- কিন্তু কেন ? আজকের পরিবর্তিত বিশ্বে, গ্লোবাল ইকোনমিক-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এর কি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে ? মিডিয়া এবং সংবাদ পত্রের আর টেলিভিশনের টক-শো গুলোর বদৌলতে আমরা সাধারণ জনগণ এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করে অনেক যুক্তি-তর্কের কথা শুনি, অনেক প্রকাশ্যে হুমকি-ধামকীর কথা শুনি। কিন্তু কি জন্য এতো সব বিশৃংখলাপূর্ণ রাজনৈতিক-সামাজিক সংঘাত। এইসব বিভাজন, বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের গন্তব্য কোথায়- কেউ কি একটু খানিকের জন্যে হলেও ভেবে দেখছি। এইভাবে প্রতিনিয়ত সংঘাত, অস্থিরতা,হরতাল-অবরোধ,ঘেরাও,সমাবেশ করে রাস্তা-ঘাট দখল করে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলে আমরা কি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ করতে পারবো ? নাকি প্রতিনিয়ত এই সংঘাত আর অবরোধ আমাদেরকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে- একটু করে হলেও ভাববার সময় কি এখনি নয়।

কেননা, ইতিমধ্যে এই সরকার গণতন্ত্রের নাম নিয়ে যেভাবে গেইম খেলে চলেছে, রাজনীতিকে এই পর্যায়ে হিংস্রতা আর ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে নিয়ে এসেছে, সাধারণ একজন দর্শকও আজ ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছেন, সরকারের উদ্দেশ্য মোটেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চর্চা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া নয়, বরং সরকার শুরু থেকেই, বলা যায় ক্ষমতারোহনের প্রথম দিক থেকেই ফন্দী আটতে থাকে কি করে আগামী দশটি বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। আর তা করতে গিয়ে সরকার একের পর এক ষ্টেক হোল্ডার তৈরি করে, এর মাঝে আবার একে অন্যের সাথে বিভাজন ও হিংস্রতা তৈরি করে নিজেদের পাতানো ছকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফিরে আসার পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। আর তা করতে গিয়ে এই সরকার বাংলাদেশের গোটা রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজব্যবস্থায় অসম্ভব এক বিষ ও হিংস্রতা এমন সূক্ষকৌশলে ছড়িয়ে দিয়েছে, এখন সেই খেলা সরকারের নিয়ন্ত্রণের অনেকটাই বাইরে চলে গিয়েছে। এই অবস্থায়, সরকার যেন তেনভাবে তার সকল ফোর্স যে ব্যবহার করবে, নিজেদের ছকে রাজনীতিকে রাখার জন্যে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এতে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক কাঠামো ঠিকলো, বিকশিত হলো কি হলো না- সরকারের তাতে কোন লক্ষ্য বা ভ্রুক্ষেপ নেই।কারণ সরকারের এই ডেঞ্জারাস রাজনৈতিক খেলার সুযোগে নিজেদের অজান্তেই খালি স্পেসের মধ্যে ইতিমধ্যেই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাম পন্থী নাগরিক সংহতি, নতুন ইসলামিক শক্তি হেফাজতে ইসলাম, নারী সংহতি সহ নানান সংগঠন ইতিমধ্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে স্থান করে নিয়েছে। আর এই সব নতুন ও পুরনো শক্তিগুলো কখনোই গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে রাজনীতি চর্চা করে ক্ষমতায় আসীনের চিন্তাও করেনা এবং করলেও তারা সকলেই জানে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা তাদের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।আর সম্ভব নয় বলেই সরকারের এই বিশৃঙ্খলা পূর্ণ রাজনৈতিক খেলার সুযোগে এরা সকলেই মাঠ দখল করে নিয়েছে।

আমাদের এই রাজনীতি এখন এমন এক পর্যায়ে এসেছে, যেখান থেকে এখন আর হাজার চেষ্টা করেও সরকারের পক্ষে সংলাপের মতো গণতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হবেনা। আর এই অবস্থার জন্য বর্তমান সরকারই দায়ী, কেননা তারা যেকোনভাবেই হউক আবারো ক্ষমতায় আসতে চায়।সুতরাং গণতান্ত্রিক পন্থা অনুসরণ এখন আর এই সরকারের কোন লক্ষ্য বা ক্রেডেবিলিটির মধ্যে নেই।

চ্যানেল আই এর তৃতীয় মাত্রার আলোচনায় সেদিন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডঃ তালুকদার মণিরুজ্জামান স্পষ্টতই বলেছেন, আজকের রাজনৈতিক এই ঘোলাটে অবস্থায় তিনি আপাত দৃষ্টিতে সরকারের উদ্যোগে সংলাপের মতো গণতান্ত্রিক পন্থা অনুসরণের কোন পথ দেখছেননা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শাহবাগের তরুণদের অতি সূক্ষ্মভাবে এমন করে ধর্ম আর কওমি মাদ্রাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আর বাম সংগঠনগুলো স্থান দখল করে নিয়েছে। সরকার নিজেদের চালে হেফাজতে ইসলামকে জাগরণ মঞ্চের মতো রাজনীতির পাদ-প্রদীপে নিয়ে এসে, জাগরণ মঞ্চের সাথে বিমাতাসূলভ আচরণ করে, হেফাজতকে হাতে নিয়ে, আওয়ামী ঘরানার ২৭ সংগঠনকে মাঠে নামিয়ে প্লাট ফর্ম সুযোগ করে দিয়ে, আবার হেফাজতের প্রতি অনমনীয় অবস্থান নিয়ে, দুই পক্ষকে একে অন্যের সাথে মুখোমুখি করে রাতের অন্ধকারে হেফাজতের সাথে সমঝোতা করে ঢাকা থেকে নির্বিঘ্নে বিদায় করার ব্যবস্থা করে- এই যে বিভ্রান্তিকরর এবং হিংস্রতা ও দুই-তিন নৌকায় পা দিয়ে খেলা খেলে চলেছে, তার খেসারত গোটা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে দিতে হচ্ছে। আজকে হেফাজতের ১৩ দফার বিপরীতে নারী আন্দোলন বিক্ষোভ করে দেশ অচল করে দেয়ার কথা টেলিভিশনে প্রকাশ্যে বলছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাগরণ মঞ্চ হেফাজতের হরতাল প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে। কোথায় ছিলো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করার জন্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আর বাম ও নারী সংগঠনগুলো সোচ্চার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে জাগরণ মঞ্চ ছিলো সোচ্চার, জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে ছিলো গোটা বাংলাদেশ উত্তাল, আজকে সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে অসম্ভব এক বিভাজনের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। আজকে ধর্ম ও সংস্কৃতি, হেফাজত ও নারী আন্দোলন, নাস্তিক এবং আস্তিকের দ্বন্ধ সংঘাত শুধু নয়, গোটা বাংলাদেশে এক উন্মাদনা তৈরির নির্লজ্জ এক সংগ্রাম শুরু করে দেয়া হয়েছে।এতে বাংলাদেশের ও বাঙালি জনগণের কি লাভ হচ্ছে, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ইমেজ গোটা বিশ্বে ছিলো সুবিদিত-তা আজ বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে- কিন্তু কেন ? এতে কি বাংলাদেশের কোন লাভ হবে বা হচ্ছে। প্রতি নিয়ত অস্থিরতা আর হরতাল, অবরোধ, সংঘাত নিয়ে কোন জাতি কি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছে ?

কোন পক্ষকে ছোট করার জন্যে নয়, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে অযথা মুখোমুখি দাঁড় করানোর মধ্যে কি এমন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভিত মজবুত হচ্ছে, বলবেন কি ?

Salim932@googlemail.com
7th April 2013.

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *