প্রসঙ্গ আবুল মাল আব্দুল মুহিতঃ এক সুন্দরের কষ্টকর উপাখ্যান-
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
আবুল মাল আব্দুল মুহিত– এই সময়ে বাংলাদেশে সব চাইতে আলোচিত, সব চাইতে সমালোচিত অর্থমন্ত্রী।দীর্ঘ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার জীবনে আবুল মাল আব্দুল মুহিত এই রকম ব্যাতিক্রম ধর্মী অবস্থার মুখোমুখী হয়েছেন বলে আমার জানা নেই, কারণ আমি ব্যাক্তিগতভাবে এই অর্থমন্ত্রীকে যেমন চিনি, জানি, একই সাথে খুব কাছে থেকে, এবং সম-দূরত্বে থেকে দেখেছি।অল-ইন্ডিয়া সিভিল সার্ভেন্টস,আইসিএস,কিংবা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একজন দক্ষ সচিব, দক্ষ বুরোক্রেট, দক্ষ প্রশাসক হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই অর্থমন্ত্রী মুহিত জীবনে একটি বারের জন্যও স্বজন প্রীতি ও ঘুষ-দূর্ণীতির কাছে আত্ম-সমর্পণ করাতো দূরে থাকুক, সমসাময়িক কালের কোন আমলা, মন্ত্রী, ভুল করেও বলতে পারবেননা মুহিত অন্যায়কে কখনো প্রশ্রয় দিয়েছেন।দূর্ণীতি করাতো অনেক দূরের ব্যাপার।জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলতেও শুনিনি।মুহিতের শিশু কালের সাথী,কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী, দীর্ঘ চাকুরী জীবনের সহ পাঠী, বিশ্ব অঙ্গনের সহকর্মী অনেকের সাথে ব্যাক্তিগতভাবে কথা বলে আমার উপলব্ধি আরো গাড়ো হয়েছে। ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তানী, বাংলাদেশ শাসন ব্যাবস্থা ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউএনডিপি,এসকাপ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করেও মুহিতের বিরুদ্ধে কখনো কোন অন্যায় ও দূর্ণীতির কোন প্রমাণ গুণাক্ষরেও পাওয়া যায়নি। সেই মুর্তিমান সৎ, দক্ষ একজন আমলা, একজন প্রশাসক, একজন মন্ত্রীর মুখে আজকে প্রায়ই যখন রাবিশ, ননসেন্স শুনি, তখন আশ্চর্য হই। কারণ আমি যতটুকু চিনেছি, রক্তের দাবী নিয়ে বলছি, আমি কখনো একজন আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মুখে এই সব শব্দ ভুলেও কিংবা রাগান্বিত অবস্থায়ও শুনিনি।তাহলে আজ হঠাৎ কী হলো? অনেকেই বলেন, বয়সের ভারে তিনি বকে চলেছেন, হয়তো তাই।কিন্ত শুধু কী তাই?যদি তাই হবে, তাহলেতো তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হতেন, চলা-ফেরা,বক্তব্য, বিবৃতিতে নানান ছন্দ-পতন ঘটতো।এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আপনাদেরকে একটু পেছনে নিয়ে যেতে হবে।আবুল মাল আব্দুল মুহিত যেদিন আওয়ামীলীগে যোগদান করেন, সেইদিন অনেকের সাথে, নিউজ কাভারেজ করার জন্য, আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেদিনকার অনুষ্টানে সুরঞ্জিত বাবু সহ প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদ উপস্থিত ছিলেন।লাখো লোকের সমাবেশ স্থলে, এতো বড় জাতীয় পর্যায়ের এক অনুষ্টানে দলীয় শ্রমিক লীগের তখনকার সাধারণ এক লোকাল নেতা প্রকাশ্যে জনসভার মাঠে বলেছিলেন, আবুল মাল আব্দুল মুহিত সন্দেহ নেই খুব বড় মাপের এক আন্তর্জাতিক ব্যাক্তিত্ব, কিন্ত আওয়ামীলীগের নেতা হতে হলে উনাকে আওয়ামীলীগের ব্যাকরণ শিখতে হবে। যদি তিনি তা শিখতে ব্যর্থ হন, তবে বেশী মূল্য দিয়ে চলতে হবে, আজকের যোগদান অনুষ্টানে আমরা মুহিত সাহেবকে এই অগ্রীম ম্যাসেজটা দিয়ে রাখতে চাই।বলাই বাহুল্য, সেদিনকার ঐ শ্রমিকলীগ নেতার ঐ এহেন বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ কোন জাতীয় কমিটির কেউই করেননাই।
প্রিয় পাঠক, এখানেই মূলত নিহিত আছে আবুল মাল আব্দুল মুহিতের এই সাম্প্রতিক অসঙ্গগতির কারণ।আওয়ামীলীগ কখনো শীষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন করেনা, অতীতের আওয়ামীলীগের শাসনই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।আওয়ামীলীগ দলীয়ভাবে হাই কমান্ডের নির্দেশেই একজন সৎ দক্ষ মুহিতকে স্বাক্ষী-গোপাল হিসেবে সামনে রেখে, হাত-পা বেধে বলা যায়, দলীয় হরিলুটে ডিজিটাল স্বপ্নের ধোয়া তুলে মহা লূট-পাটে ব্যাস্ত হয়ে আছে।মুহিত তার স্বভাব জাত কারণে যখনি বাধা হয়ে দাড়ান, তখনি তারা একাট্রা হয়ে মুহিতকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে, প্রয়োজনে হাই কমান্ডকে দিয়ে লাল টেলিফোনে আদিষ্ট হয়ে মুহিত তার স্বভাবজাত বিশ্বাস থেকে প্রেসের সামনে এসে বলে যাচ্ছেন বলে আমার মনে হয়, অথচ তিনি যে প্রতিনিয়ত এক্সপ্লয়েট হচ্ছেন, তা দেরীতে যখন বুঝতে পারেন, তখন আর কিছু করার থাকেনা, হাই কমান্ড মুহিতকেতো ভালো মানুষের মতো রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা বলে ধোকা দিয়ে চলেছে, যা আওয়ামীলীগ এর মজ্জাগত স্বভাব, মাঝখানে মুহিত জনগণের রোষানলের স্বীকার হচ্ছেন। এমনও অনেক দূর্ণীতি সরকার করে চলেছে, যা মুহিত অনেক পরে যখন অবগত হন, তখন কিছু করার যেমন থাকেনা, অথচ না পারেন সইতে, না পারেন হজম করতে।মুহিতের নাম ভাঙ্গিয়ে সরকারের হর্তা-কর্তারা মহা হরিলুট করে চলেছে, যা মুহিতকে ভাবিয়ে তুলেছে।মুহিতের সমস্যা হয়েছে, সততার ঝুলি বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগের ব্যাকরণ যদি রপ্ত করতে পারতেন, তবে আর যাই হউক, দলের ভিতরে তিনি সমালোচিত হতেননা, দুষ্টের নাটের গুরুরা আর আর্থিক সংস্থা লুট-পাটের কু-সংস্কৃতির ধারক-বাহকেরা তার মহত্ত প্রচারে সারা দিন-রাত ব্যাস্ত থাকতো, অন্তত তাদের বদৌলতে মিডিয়ার একটি অংশ তার প্রশংসায় থাকতো উচ্চকিত।মুহিত পদত্যাগ করলেও এই শয়তান আর ষড়যন্ত্রকারীরা কিবরিয়ার মতো ঘটনা ঘটাতে পিছুপা হবেনা, আবার যদি পদত্যাগ না করেন, তবে সব কলংকের ভাগীদার মুহিতকেই নিতে হবে, কেননা শয়তান এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা এমনভাবে ডাল-পালা বিছিয়ে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে আছে যে, মুহিত ইচ্ছে করলেও তাদের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেননা।আর মুহিতের মতো বিদগ্ধ আর সারাটা জীবন সততার হাজারো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জাদরেল এই সরকারী আমলার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের এই রকম মৃত্যু আগামীদিনে সুধী, সৎ, ভদ্র,জ্ঞানী ও শিক্ষিতলোকদের রাজনীতির ময়দানে তথা আওয়ামী রাজনীতির পাঠশালায় আসতে নিরুৎসাহিতই করবেনা, বরং এক্ষেত্রে একরকম বন্ধাত্যই দেখা দিবে, ফলে আওয়ামী অপ-সংস্কৃতি আরো ফুলে-ফেপে উঠবে, সন্ত্রাস, রাহাজানী, চুরি,ডাকাতি দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাবে, সমাজে ও রাষ্ট্রে অশান্তি বাড়বে বৈ কমবেনা।
খোদ মন্ত্রী পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দূর্ণীতির তকমা আর সন্ত্রাসীর অভয়ারণ্যের হোতা গায়ে নিয়ে মন্ত্রী আর সাড়ে তিন বছরে একটিদিনও ফুল-টাইম অফিস না করার রেকর্ডধারী, এক এগারোর সুবিধাভোগী বিদেশ ফেরৎ আরো এক মন্ত্রী- মন্ত্রী পরিষদের মিটিং-এ যখন ইউনুস ও বিশ্বব্যাংক প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তোলে মুহিতকে অপবাদ দিয়ে বিপর্যস্ত করে তোলেন, তখন কারো বুঝতে বাকী থাকেনা যে নাটাইয়ের মুল গিট্র কোথায় থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসতেছে, যদিও প্রধানমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন বলে সংবাদে প্রকাশ।একজন সরকারের উচ্চ পদস্থ মন্ত্রী মহোদয়কে সুকৌশলে অন্ধকারে রেখে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে এই সরকার এতো ব্যাতিব্যস্ত যে, জনকল্যাণ এখন তাদের কাছে গৌণ।
বিশ্বব্যাংক এর ওয়াশিংটন অফিস, আর এডিবির ম্যানিলা অফিসের বিশ্বস্ত সূত্র মতে, পদ্মা সেতুর জন্য একমাত্র মুহিত ব্যাতিত বর্তমান সরকারের আর কেউই কোনভাবেই আন্তরিক নয়, যাতে বিশ্বব্যাংক আর দাতাদের অর্থায়নে স্বচ্ছতার সাথে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন হয়।পদ্মা সেতু নিয়ে বিগত তিন বছরের সরকারের সকল কর্মকান্ড নিরবচ্ছিন্নভাবে যে কেউ পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমেয় হবে, সরকার কোন অবস্থাতেই আন্তরিক নয়, বিশ্বব্যাংক ও দাতাগোষ্টী স্বচ্ছতার সাথে এতে অংশগ্রহণ করুক।আর বর্তমানে আওয়ামীলীগ কোন অবস্থাতেই এখন আর পদ্মাসেতু করতে চাচ্ছেনা।কারণ তারা জানে এখন বিশ্বব্যাংকে এনে তাদেরমতো করে লুট-পাট করে প্রকল্প ব্যায় বাড়িয়ে ভুয়া ভাউচার-বিলে বাস্তবায়ন করা যাবেনা।পদ্মাসেতুর নামে তাই আওয়ামীলীগ চাদাবাজীর মহালুটের যে পরিকল্পণা হাতে নিয়ে এগুচ্ছিলো, মুহিত এই বয়সে এসে উল্কার বেগে দাতাদের সাথে দৌড়-ঝাপ করে দাতাগোষ্টীদের আবার ট্র্যাক লাইনে আসার সুযোগ করে দেওয়ায় আওয়ামীলীগের লুট-পাটের হোতারা মুহিতের উপর বেজায় নাখোশ।নাহলে বিশ্বব্যাংক ও দাতারা মুহিতকে গ্রীণ সিগন্যাল দিয়ে যখন অনেকটা এগিয়ে এলো, মাঝপথে খোদ সরকার প্রধান থেকে শুরু করে নীতি-নির্ধারকরা দাতাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা ও উল্টো লবিং কেন শুরু করে দিলো, পদ্মা পরিকল্পণায় মুহিতকে সরকারই অন্ধকারে রেখে এগিয়ে যায়, উদ্দেশ্য একটাই পদ্মা সেতু নয়, সেতু করার নামে হরিলুট করার ব্যাবস্থা।এই সরকারের শুরুতে শেয়ার বাজারের যে হরিলুট হয়, সেখানে অর্থমন্ত্রীকে খোদ নীতি-নির্ধারকরা ভুয়া তথ্য সরবরাহ করে এমন অন্ধকারে রাখে যাতে নির্বিঘ্নে টাকা-পয়সা লুট করে সরে যেতে পারে, সরকারের একেবারে উপর মহলের কারসাজি ছাড়া এতোবড় কেলেংকারী করার দুঃসাহস ঐ সব লুটেরা আর চোরেরা করতে পারতোনা।আর যদি নিজেরা একা করতো, তাহলে জাতি তাদেরকে আজ ঐ লাল ইটের ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখতো, যেমন করে বন্দী আছে মামুন, বাবররা।
উল্লেখ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্দ্বের সময় মুহিতই প্রথম সিএসপি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা যিনি পাকিস্থানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতি বিশ্ব জনমত গঠণে পালন করেন এক বলিষ্ট ভুমিকা।সেদিনের এই মুক্তি সেনানী পরবর্তীতে হার্ভার্ড এবং অক্সফোর্ড থেকে স্পেশালাইজড ইকোনোমিক্স নিয়ে ডিগ্রী অর্জনের বিরল এক গৌরবের অধিকারী ছাড়াও পড়া-লেখা ও চাকুরী জীবনে কৃতিত্ত্বের স্বীকৃতি স্বরুপ বেশ কয়েকবার গোল্ড মেডালিষ্ট এর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই মুহিতই সেই মুহিত।
দূষে-গুনে মানুষ, তার অর্থ এই নয় আমি মুহিতের সাফাই গাইছি।বরং যা বাস্তবতার আলোকে অন্ধকারের আড়ালে ঘটনার পেছনের ঘটনা সকলের সামনে নিয়ে আসার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।কেননা আপাদ মস্তক একজন সৎ,শিক্ষিত, এবং কর্ম দক্ষতার হাজারো পরীক্ষায় উত্তীর্ণই শুধু নন, পরীক্ষিতও বটে, যার সারাটা জীবন জনপ্রশাসনের কল্যাণে নিবেদিত, মাত্র কিছুদিনের কর্মে, অপ-সংস্কৃতি আর দুষ্টগ্রহের খপ্পড়ে পড়ে চিরন্তন বাঙ্গালীর অসম্ভব এক সুন্দরের পতনে এবং জনমনে নানান প্রশ্ন ও বিরুপ আলোচনার প্রেক্ষিতে আমার চেনা এই মুহিতই সেই মুহিত এক ও অনন্য সুন্দর তারার নক্ষত্রচ্যুতিতে তাই বড় কষ্ট ও হ্রদয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে।আমি চাই মুহিত তার স্ব-মহিমায় আবার সকলের মাঝে জলে উঠুন, আল্লাহ পাক উনার সহায় ও মঙ্গল করুন।আমীন।
12th Sept.2012.