সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
ঘড়ির কাঠায় তখন রাত ১টা বেজে ৩ মিনিট,চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম,দরজা জানালা একটু ফাক থাকায়,ভালো মতো যেই বন্ধ করে বিছানায় শুতে যাবো,এমন সময় জানালায় ঠক,ঠক শব্দ,চোখে-মনে ক্লান্তি থাকায়,শব্দের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দেহ-মন বিছানায় এলিয়ে দিলাম।একটু পরে আবারো ঠক,ঠক,ঠক শব্দে আধো ঘুম চোখে জানালার কাছে এগিয়ে যেতে ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,স্যার আমি হিমু।কে? স্যার আমি।বেশ চমকিয়ে এবং অনেকটা রাগত স্বরে বললাম,কে?ফাজলামুর আর জায়গা পাওনাই,কে,কি চাই,ঠিক করে বলুন।স্যার আমি হিমু,হলুদ হিমু,হুমায়ূন স্যার এর হলুদ হিমু।হলুদ হিমু!পথ হারিয়ে নাতো,রীতিমতো ভিমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।আনন্দ,উত্তেজনা আর ভয়ে আমার হাত-পা কাপতে লাগলো,এওকি সম্ভব,এই ভর কালো রাতে কোন পূর্ণিমা ছাড়াই হুমায়ুনের জ্বলজ্যান্ত আবিস্কার হলুদ হিমুর দুয়ারে আভির্ভাব।এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।তুমি সত্যিই কি হিমু।দেয়ালের সূইচ টিপ দিয়ে লাইট জ্বালাতে যাবো,পেছন থেকে একেবারে ঘাড়ের কাছে এসে গা ছম-ছম করে আওয়াজ এলো স্যার আলো জ্বালাবেননা,আমি আলো-আধারেই থেকে কিছু কথা বলে চলে যাবো।আপনাকে না বললে এই জায়গা থেকে আমি নড়াচড়া করতে পারবোনা।এইবার আমি একটু সরে এসে নিজেকে সামলে হলুদ হিমুকে চিনতে চেষ্টা করলাম,না কি এ আমার স্বপ্নভ্রম,না আমিতো সাক্ষাৎ হলুদ হিমু,হ্যা হুমায়ূনস্যার এর হিমুর সাথেই জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি।আমি বললাম,আচ্ছা হিমু,তুমি কি বলতে চাও,বল।আর কেনইবা তোমার এখানে আগমন।তোমারতো বরং এখন হুমায়ূন স্যার এর কাছে থাকা উচিৎ।এখানে আমি একা না স্যার,আমার সাথে আছে হুমায়ূনের মিসির আলীও।পেছন থেকে আওয়াজ,জ্বি স্যার আমি মিসির আলীও হিমুর সাথে চলে এসেছি।কি ব্যাপার তোমরা দুজনেরই হঠাৎ করে এখানে আগমন কেন? কি যন্ত্রাণায় ফেললে,তোমরা এখানে কি চাও?কি বলতে চাও?বলো।
এইবার হলুদ হিমু বেশ গলার স্বর নিচু করে ফিস-ফিসিয়ে বলতে লাগলো,স্যার,মনে খুব দুঃখ,পথ চলতে বড় কষ্ট হচ্ছে।শহীদ মিনারে ছিলাম বেশ কিছুক্ষন,হঠাৎ আচমকা দেখা মিললো রফিক আর জব্বারের।বড় মন খারাপ নিয়ে শহীদ মিনারের ঢাল বেয়ে সিড়িতে বসে চোখের জ্বলে একাকার করে বলতেছিলো,এই হলুদ হিমু,মিসির আলী,আমাদের বুকের লাল তাজা রক্তের বিনিময়ে লিখে গেলাম বাংলা বর্ণমালার কথা,বাংলা ভাষার কথা,বিশ্বসভায় জানান দিয়ে গেলাম বাংলা আমাদের মাতৃ ভাষার কথা।সেই ১৯৫২ সালের ৮ই ফাল্গুনে বাংলা ভাষাকে মায়ের ভাষায় স্বীকৃতি দানের জন্য ঢাকার রাজপথ রক্তে রাঙ্গিয়ে গেলাম,কিন্তু বড় আফসোস ভাই হিমু,ভাই মিসির আলী,কেবল একটি মাত্র শহীদ মিনার ছাড়াতো আমরা আর কিছুই পেলামনা।৮ই ফাল্গুন না এলে কেউ আমাদের কথা মনেও রাখেনা।প্রতিটি সকাল,প্রতিটি রাত এই শহীদ মিনারে এসে যাই,যদি কখনো শুনি কারো মুখে আমাদের আত্মদানের কথা,যদি কখনো শুনি প্রিয় বর্ণমালার প্রিয় পংক্তির দৃঢ় উচ্চারন।কিন্তু বড় কষ্টের সাথে তোমাকে বলতে হচ্ছে হিমু,বারে বারেই অশ্রুসজল নয়নে আমাদেরকে এক বুক কষ্ট আর হতাশা নিয়ে ফরে যেতে হয় শুন্য স্থানে।
রফিক,জব্বারের সাথে সালাম ও এসে যোগ দেয়,বলতে থাকে,শুধু কি তাই,যে ভাষার জন্য এতো ত্যাগ,এতো রক্তদান হলো,অথচ আজ দেখি সেই ভাষার এতো অবমাননা,কোথাও বাংলা ভাষার যথার্থ কোন চর্চা নেই,নেই এর ব্যাবহার আমাদের অফিস,আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে,সর্বত্রই বাংলা আজ অবহেলিত।আমাদের নতুন প্রজন্মতো জানেইনা ভাষার জন্য যে বাঙ্গালী এক সময় অনেক,ত্যাগ,তিতিক্ষা আর সংগ্রাম করে মায়ের ভাষা বাংলাকে প্রতিষ্টিত করেছে।পৃথিবীতে এমন কোন দেশও খুজে পাওয়া যাবেনা,ভাষার জন্য কোন জাতি এতো ত্যাগ আর সংগ্রাম করেছে বলে আমাদেরতো জানা নেই।তারপরেও এই ভাষা আজ বড় উপেক্ষিত,অবহেলিত।পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে,আর আমরা ছুটে চলেছি এখনো পেছনের দিকে,সামনে এগুনোর কোন দিক নির্দেশনা নেই।
রফিক,জব্বার আর সালামের কান্না যেন থামতে চায়না।শহীদ মিনারের এই নির্জনতাকে ভেদ করে আকাশ অবদি শব্দ ঝম-ঝম করে উঠে,বাতাস ভারী হয়ে আসে,ওদের অঝোরধারায় কান্না দেখে রাতের নিরবতা ভেঙ্গে পাখিসব কলরব করে উঠে,জানান দেয় শহীদদের আর্তনাদের সাথে পাখীসব,আকাশ,বাতাস ও কেধে উঠে।ওদের কান্না দেখে মিসির আলী এবং হলুদ হিমুও কাঁধতে থাকে।তাদের মিলিত কান্নায় পরিবেশ আরো ভারী হতে থাকে।এ কান্না যেন থামার নয়।
সালাম রফিক জব্বার আরো বলতে থাকে,হূমায়ূন স্যার এতো সুন্দর,সুন্দর গল্প লিখে,নাটক,সিনেমা বানায়,কিন্তু বাহান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তেমন কোন কাজ কিংবা সৃষ্টি কেন করেননা,হাতে গোনা দু একটি কাজ ছাড়াতো এই নিয়ে আর কোন কাজ দৃশ্যমান হয়না।কেন হয়না হিমু,মিসির আলী-তোমরা বলো,জবাব দাও।গোটা বাংলাদেশকে তোমরা জানিয়ে দাও,আমাদেরকে ভুলে গিয়ে গোটা বাংলাদেশটাকেই মূলত ভুলে থাকা,এই ভুল যেন বাঙ্গালী আর না করে।কারণ,আমরা আত্মদান করেছিলাম বলেই মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্টিত করতে পেরেছিলো বাঙ্গালী,আমরা শহীদ হয়েছিলাম বলেই বাঙ্গালী স্বাধীন রাষ্ট্রের বীজ বপণ করতে পেরেছিলো,আমাদেরকে ভুলে গেলে গোটা বাঙ্গালীর আত্মদানটাই বৃথা হয়ে যায়।
রফিক,জব্বার`রা বলতেই থাকে,ভাই হিমু,আমাদের রক্তে ভেজা রাজপথ লাল করে হায়েনারদল এসেম্বলী চালিয়ে যেতে থাকলে প্রয়াত রাজনীতিবিদ মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এসেম্বলী চলতে দেননাই,বেরিয়ে আসেন,অথচ সেই তর্কবাগিসের কথা আমাদের প্রিয় বাঙালি কেঊ মনে রাখেনি।নতুন প্রজন্মতো তার নামই জানেনা।এমনতো হওয়ার কথা ছিলোনা।
যাও ভাই হিমু,মিসির আলী,তোমাদের হুমায়ূন স্যারকে বলো আমাদের নিয়ে তার সৃষ্টি দিয়ে নতুন প্রজন্মের মাঝে ভাষা শহীদদের এই ইতিহাস তুলে ধরতে।মিসির আলী হলুদ হিমু কে, কি যেন বলতে গিয়ে তাকিয়ে দেখে রফিক জব্বার সালাম এখানে আর নেই,আছে শুধু শুকনো কড়-কড়ে পাতা,যা এলোমেলো মাতাল হাওয়ায় এদিক ওদিক ঊড়ে নিয়ে যাচ্ছে।বহু কষ্টে হলুদ হিমুকে সোজা করে ধরে নিয়ে মিসির আলী অন্ধকারে হাঠতে থাকে,বুকের মাঝে বড় কষ্ট নিয়ে নিল আকাশের নিচে শুধু হাঠতে থাকে উদ্দেশ্যবিহিন ভাবে।আর বলতে থাকে ভিড়,ভিড় করে আওড়াতে থাকে,সালাম,জব্বার,রফিকের রক্ত বৃথা যেতে দেবোনা,সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর,চালু কর।।
14th February 2012.UK