সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ, আলতাব আলী পার্ক- লন্ডন থেকে
এ এক ব্যতিক্রমী আয়োজন, ব্যতিক্রমধর্মী উচ্চারণ। চোখে মুখে দৃপ্ত শপথ, নতুন বাংলাদেশের শপথ, বিজয়ের এই নতুন কাফেলার যাত্রীরা সবাই তরুণ, আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত। আর সেই আদর্শিক উজ্জীবনা বলেই বাংলাদেশের অজোপাড়াগা নয়, ঢাকার রাজপথও নয়, কিংবা নয় কোন বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা, নয় কোন চিরচেনা তপ্ত কোন বালুকাময় মাঠ, এ যে সুদূর সাত সমুদ্র তের নদীর পারের এই ইউরোপের স্বপ্ন রাজ্যের একেবারে প্রাণ কেন্দ্র লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের সবুঝ চত্বরে, খোলা আকাশের নীচে শহীদী মর্যাদা আর শ্রদ্ধায় উদ্দীপ্ত ভালোবাসার অমর কাব্যের নাম আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো শত শহীদের স্মারক এই শহীদ মিনারের পাদদেশে একদল ব্রাউন আর কালো চামড়ার বাংলার দামাল ছেলে মেয়েরা একত্রিত হয়ে আওয়াজ তুলেছে, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। এ যেন এক নতুন এক আওয়াজ।যা বাঙালিরা শিখেছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময়। যে শ্লোগান বাঙালিদের করে তুলেছিলো ইস্পাত কঠিন এক ঐক্যের বন্ধনে- দল মত নির্বিশেষে সেদিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর বাঙালি একত্রিত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।
শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ব্রিক লেন আর ইষ্ট লন্ডনের এই প্রান্ত থেকে মনে পড়ছিলো, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালির ফিদেল ক্যাস্ট্রো, নিউক্লিয়াসের জনক সিরাজুল আলম খান দাদা, কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মণি আর তাদের ছায়ায় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাক সাইটে চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন আর শত শহস্র লাখো বাঙালির মুখ থেকে উচ্চারিত তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা- স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এসে আজকের তরুণ প্রজন্ম প্রবাসের এই মাটিতে দাঁড়িয়ে বীর দর্পে উচ্চারণ করে চলেছে। প্রয়াত ও জীবিত সকল বীর মুক্তি সেনানী আর সন্তানেরা বড় শান্তনা আর বিজয়ের এই প্রফুল্লে হর্ষ চিত্তে জয়ের এই চির জয়গান বাঙালির প্রাণে একাকার করে দিয়ে গেছেন। প্রিয় বাঙালি, প্রিয় বাংলার দামাল ছেলেরা- তোমরা যেখানেই থাকো, ভালো থাকো। তোমাদেরকে অভিনন্দন হে বাংলা মা।ধন্য তোমার কোলে এই বীরদের জন্ম দিয়ে।
প্রবাসের এই দ্বিতীয় বাংলা খ্যাত ইষ্ট লন্ডনের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে একদল অমিত সাহসী বাঙালি তরুণ তরুণী প্রকৃতির বিষণ্ণ রূপ আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর হাড় কাঁপানো শীতকে উপেক্ষা করে গগণ বিদারী শ্লোগানে শ্লোগানে ব্রিকলেন কাপিয়ে তুলে চলছে সামনের দিকে। সকলের চোখে মুখে একই আওয়াজ, জয় বাংলা, বাংলার জয়, পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা, বীর বাঙালির এই বাংলায় রাজাকারের ঠাই নাই, ঠাই নাই- গগণ বিদারী এমন শ্লোগানে শ্লোগানে তারুণ্যের এই দলটি যখন আলতাব আলী পার্ক হয়ে বাঙালির কারি সাম্রাজ্য খ্যাত ব্রিক লেন প্রদক্ষিণ করছিলো, তখন শনিবারের ছুটির সন্ধ্যায় পুরো ব্রিকলেন কানায় কানায় পূর্ণ। বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোকজন তখন রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে বাংলার এই তারুণ্যের শ্লোগানে মুখরিত অভিযাত্রী দলটিকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। কেউ কেউ রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে শ্লোগানে মুখরিত দলকে উৎসাহ উদ্দীপনা দিতেছিলেন। র্যালীর একেবারে সামনের কাতারে ব্রিটেনে বেড়ে উঠা বসবাসকারী প্রবাসী মা বোনদের দল, তাদের হাতে নানা রঙের প্ল্যাকার্ড আর শ্লোগান সম্বলিত ফেস্টুন। তার পেছনে তরুণ, যুবা, প্রবীণ আর ছাত্র ছাত্রীদের দল সারিবদ্ধভাবে শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে চলছে। নিজের চোখ কানকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিলনা, একি ব্রিটেন নাকি আমার সেই ফেলে আসা প্রিয় বাংলাদেশ।
গণজাগরণ মঞ্চের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ বেলা ৩.৩০ টা থেকে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে গণজাগরণ মঞ্চ যুক্তরাজ্য এক আলোচনা সভা, র্যালী, শহীদ মিনারের পুষ্পার্ঘ নিবেদনের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আয়োজন করে।
ব্রিটেনের আবহাওয়া গত কয়েক সপ্তাহ থেকে প্রচণ্ড ভাবে খারাপ অবস্থায় চলছে। একেতো খুব ঠাণ্ডা, তার উপর ঘন ঘন বৃষ্টি, আর প্রবল হাওয়া- এই অবস্থায় উদ্যোক্তাদের শঙ্কা ছিলো এমন আবহাওয়ার মধ্যে লোকজন আলতাব আলী পার্কে জড়ো হবেন কিনা।
কিন্তু সকল শঙ্কা ও বৈরি আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালি, ছাত্র, ছাত্রী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী সকলেই এক কাতারে দাঁড়িয়ে গণজাগরণ মঞ্চের পূর্তি উৎসব পালন করলেন।
সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের সাথে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কবি সাংবাদিক লেখক শামীম আজাদ, মানবাধিকার কর্মী আনসার আহমদ উল্লাহ, সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও শহীদ সাংবাদিক মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়, সাংবাদিক রাকিব এইচ রুহেল সহ আরো অনেকেই।
বক্তারা সকলেই দৃপ্ত উচ্চারণে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লাখো শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনার সাথে রাজাকার আলবদর আর আলশামসের বিরুদ্ধে ঘোষিত অপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত নতুন গণজাগরণের এই যুদ্ধের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। মুহুর্মুহু শ্লোগান আর বাংলাদেশ বাংলাদেশ উচ্চারণে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, শহীদের এই বাংলায় রাজাকারেরা এখনো ফেণা মেলে উদ্যত, নানা নামে, নানা ভঙ্গিমায়।
এ রিপোর্ট লেখার সময় রাত ৭.৩০ মিনিটে আলোচনা ও র্যালী পর্ব শেষে গত বছরের গণজাগরণের উপর এক প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনীর প্রস্তুতি চলছিলো ।
http://www.youtube.com/watch?v=MJY6lJPWqAo
http://www.youtube.com/watch?v=g1_OzajiwlY
8th February 2014.