অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইকোনোমিকস এর প্রফেসর মিঃ তরুণ রামাডোরাই এবং বিজনেস স্কুলের পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো মিঃ ক্রিস্টিয়ান বাদারিনজা যৌথ ভাবে লন্ডন হাউস প্রাইস বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে ও এর অর্থনীতি ও সিনিয়র সিটিজেনের জীবন মানের উপর কি প্রভাব বিস্তার করছে, তার উপর এক গবেষণা করে সম্প্রতি তাদের সেই গবেষণা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের রিসার্চ ডিপার্টম্যান্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে। প্রফেসরদ্বয় ৫৫ পৃষ্টার তাদের গবেষণা পেপারে লন্ডন হাউস প্রাইস বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জাপান, রাশিয়া এবং বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যবসায়ী ও ধনী ইমিগ্র্যান্টরা লন্ডন শহরকে তাদের ভাষায় সেইফ হ্যাভেন মনে করে রাজনৈতিক টাল মাটাল পরিস্থিতির সময়ে যাতে লন্ডনে এসে নিরাপদে আশ্রয় ও পরিবার পরিজন নিয়ে এই হ্যাভেনে অনায়াসে থাকতে পারেন, সেজন্য অধিক মূল্য দিয়ে বাড়ী, ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন।
দুই প্রফেসর তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন লন্ডনের ৬২৪ ওয়ার্ডের মধ্যে এই সব ক্রস কান্ট্রির মানুষের লন্ডনে বাড়ীর শেয়ারের আনুপাতিক হার হচ্ছে-
চায়নাঃ ০.৪ , জাপান ০.৫, পাকিস্তান ৩.২, শ্রীলঙ্কা ২০৭, ভারত ৮.৬, মধ্যপ্রাচ্য ৩.৭, রাশিয়া ০.৬, বাংলাদেশ ৬.৯, প্রভৃতির হিসেবের সারণীর তথ্য উল্লেখিত রয়েছে।
বর্তমানে আর্থিক বিশ্লেষণে তারা দেখতে পেয়েছেন, লন্ডনে বাড়ীর এভারেজ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ শতাংশ। গত বিশ বছর ধরে লন্ডনে বাড়ীর বাণিজ্য বিদেশীদের দ্বারা মূল্য উঠা নামা করার অন্যতম কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছেন।এক্ষেত্রে তারা প্রধান তথ্য উপাত্তের উৎস হিসেবে গত ১৫ বছরের লন্ডনের ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অফিস, অফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক এবং ন্যাশনওয়াইড বিল্ডিং সোসাইটির ডাটা এনালাইসিস হিসেবে নিয়েছেন। ফরেন মর্গেজ প্রোভাইডার হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার নামে ন্যাশন ওয়াইড বিল্ডিং সোসাইটি মর্গেজ প্রধান করে থাকে, এক তৃতীয়াংশ বা ক্ষেত্র বিশেষে দুই তৃতীয়াংশ সহ অর্ধেক ডিপোজিট স্কিমের আওতায় এবং বেশীরভাগ হয়ে থাকে পাঁচ বা দশ পার্সেন্ট মর্গেজ। অর্থাৎ অনেক বিদেশীরা এবং রিস্ক ফ্যাক্টর কান্ট্রির মর্গেজ গ্রহীতা ও বাড়ীর ক্রেতাকে ক্রয় মূল্যের পুরোটাই পরিশোধ করে নামমাত্র মর্গেজে লন্ডনে বাড়ী খরিদ করে থাকেন তাদের ভাষায় সেইফ হ্যাভেন হিসেবে।
প্রফেসর তরুণ রামাডোরাই বলেন, তাদের গবেষণার তথ্য উপাত্ত নিশ্লেষনে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, ভারত, চীন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, স্পেনের রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী সকলেই লন্ডনের বাড়ী ক্রয়ে সেইফ হ্যাভেন হিসেবেই মনে করে থাকেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, লন্ডনের বাড়ীর দাম উঠা নামা করে মূলত: তিন দেশের ক্রেতাদের মাধ্যমে। বিশেষত: যেসব দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অস্থিতিশীল এবং হত্যা সন্ত্রাস প্রতিনিয়ত বিষয়, সেসব দেশের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা লন্ডনকে তাদের জীবনের নিরাপদ স্বর্গ হিসেবে মনে করে বেছে নিয়েছেন। যাদের মধ্যে অত্যন্ত গোপনে বিভিন্ন নাম ধারণ করে বা পরিবারের আত্মীয়স্বজন কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত বন্ধুদের নামে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা লন্ডনে বাড়ী কিনেছেন।
লন্ডনের মূল শহরের ৬২৪ ওয়ার্ডের ধনী প্রদান এবং নিরিবিলি দামী এরিয়ায় ধনী ইমিগ্র্যান্টদের বসবাস এবং বিদেশীরা মূলত সেই সব এলাকায় বাড়ী খরিদ করে দখলেই নিয়েছেন।পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, রাশিয়া, মিশরের অনেক ধনীব্যক্তি লন্ডনে থাকেন।তবে গত বিশ বছরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যাতে বাংলাদেশীদের এই সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।গবেষণার মূল পেপারের ফুটনোটে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে। কারো নাম উল্লেখ না করে জানা গেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ অনেকেই আছেন,যারা দেশে রাজনীতি করলেও লন্ডনে বাড়ী কিনে রেখেছেন এবং বিগত ১৫ বছরের সময়কালীন সময়ে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। যখনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়, তখন যাতে তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে লন্ডনের নিরাপদ স্বর্গে স্থানান্তর হতে পারেন এই আশায়। বাংলাদেশের এমন অনেক রাজনীতিবিদ আছেন যারা মূলত দ্বৈত নাগরিকও বটে। আর এক্ষেত্রে তারা অভিনব এক পন্থা বেছে নিয়েছেন, তাদের সাথে সমান তালে একই পন্থা অবলম্বন করে থাকেন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়ার রাজনীতিবিদেরা।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে নির্বাচনে দ্বৈত নাগরিকেরা প্রতিদ্বন্ধিতা করা থেকে বঞ্চিত হন। আর সেজন্যেই তারা বেছে নিয়েছেন এই পন্থা। গবেষকদ্বয় তাদের গবেষণার এই পর্যায়ে এসে রীতিমতো চমকে গেছেন। দেশের নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ যাতে হয়, সেজন্য তারা ঐ সময়ে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছাড়ার জন্য নোটিশ প্রদান করে ঐ নোটিশ নির্বাচন কমিশন অফিসে জমা দিয়ে থাকেন। ব্রিটেনের আইনে নোটিশ উইথ ড্রোর সময়কালীন সময় হলো দুই সপ্তাহ বা ১৪ দিন।আর ঐ সময়ের মধ্যে সুচতুর রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনী অফিসে জমা দেয়া নোটিশ দেশে বহাল রেখেই ব্রিটেনের অফিসে ইতিমধ্যে দেয়া নোটিশ উইথড্রো করে নেন অগোচরে। ফলে তাদের নাগরিকত্ব বহাল তবিয়তে রয়ে যায়।ব্রিটেন বিনিয়োগের ক্যাটাগরিতে ব্যবসায়ীরা নাগরিকত্ব পেয়ে থাকেন এবং এ নিয়ম এখনো অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে ব্যবসায়ীরা এবং হালের সময়ে রাজনীতিবিদেরা অঢেল পয়সার বিনিয়োগের উৎস দেখিয়ে ইমিগ্র্যাশনের সুযোগ নিয়ে থাকেন। দেশের গরীব মানুষদের লুটে এই সব নেতারা লন্ডনে সেইফ হ্যাভেনে প্রচুর বিনিয়োগের বিনিময়ে লন্ডনে বাড়ী কিনে রেখেছেন।
উল্লেখ্য বিগত ১/১১ র তত্বাবধায়ক সরকারের সময় গার্ডিয়ান এবং মেইল সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো বিএনপির মওদুদ আহমদ, নাজমুল হুদা সহ একডজন মন্ত্রীর নামোল্লেখ করে লন্ডনের অভিজাত ওয়েস্টমিনিস্টার সিটি ও সারেতে অনেক বাঙালি রাজনীতিবিদের বাড়ীর পাওনা ট্যাক্স সংক্রান্ত নোটিশের নিষ্পত্তির সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশে বিদেশে আলোড়ন তুলেছিলো।একই সময়ে নাটওয়েস্ট ব্যাংকে জয়নাল হাজারী নামের বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ একজনের নামে ত্রিশ মিলিয়ন পাউন্ডের হিসেবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য ফাইনানসিয়াল সিকিয়রিটি অথরিটি পেয়েছিলো। ঐ সময়ের তথ্যে মেইল ইনভেস্টিগেশনে রিপোর্ট বেরিয়েছিলো ব্রিটেনের সরকার ঐ একাউন্ট জব্ধ করে দিতে পারে, তার যথেস্ট কারণ রয়েছে এবং সরকারি ট্রেজারিতে ঐ টাকা মিসেলিনাস একাউন্টে এডজাস্ট করার সুপারিশ এক্সপার্ট ব্যাংকারদের থ্রোতে সংবাদ বেরিয়েছিলো। ঠিক তার পরেরদিন আরো একজন রাজনীতিবিদের একই ব্যংকে অলস হিসেবে দীর্ঘদিন এই পরিমাণের বেশী ষ্টার্লিং লেনদেনের সন্দেহ থেকেই একই প্রক্রিয়ায় জব্ধের সুপারিশ করেছিলো। যদিও ঐ সময় দেশের মিডিয়াতে সকলেই তখন অস্বীকার করেছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রফেসরের তথ্য উপাত্ত সহ লন্ডনে বাড়ীর দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত গবেষণা গার্ডিয়ানের সেই সংবাদের সত্যতা সমর্থন করে।
প্রফেসর তরুণ রামাডোরিয়া হাউস প্রাইজ, এসেট প্রাইসিং, ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাইনান্সিং, হাউসহোল্ড ফাইন্যান্সের একজন এক্সপার্ট হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে। বর্তমানে এই প্রফেসর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইকোনোমিকসের প্রফেসর ছাড়াও স্লোন ফাউন্ডেশনের সাথে মিলে হার্ভাডের রিসার্চার হিসেবে কাজ করছেন। আর ক্রিস্টিয়ান বাদারিনজা অক্সফোর্ডের পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে বিজনেস স্কুল ও ম্যান ইন্সটিটিউট অব কোয়ানটিটেটিভ ফাইন্যান্স অধ্যাপনা করছেন। এর আগে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকে রিসার্চ এসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ক্রিস্টিয়ান মূলত মর্গেজ মার্কেট এবং হাউসহোল্ড ডেবটের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেন্ট্রাল লন্ডনের ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটে সুখ্যাতি রয়েছে।
তাদের এই গবেষণা পত্র হত নভেম্বর ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণার নাম- Home Away From Home? Safe Haven Effects and London House Prices_
Cristian Badarinza and Tarun Ramadoraiy
November 19, 2013, Oxford University.
১৬ জানুয়ারি ২০১৪