হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদঃ নক্ষত্রের পতন, আর কতো ভন্ডামিরে চাচা

হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদঃ নক্ষত্রের পতন, আর কতো ভন্ডামিরে চাচা

একসময়ের দুর্দন্ড প্রতাপের সাথে নয়টি বছর সামরিক বাহিনীর উর্দি গায়ে লাগিয়ে বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটির শাসন করার ক্ষমতার সবচাইতে সৌভাগ্যবান ব্যক্তির বিশ্ব খেতাবের উপাধিপ্রাপ্ত এই এরশাদ। হেন কোন কাজ নেই, সেদিন এই এরশাদ করেননি। সমগ্র বাংলাদেশ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছিলো, অথচ নিয়তির কি উপহাস, একসময় যাদের কে তিনি রাজনীতির মারপ্যাঁচে ও ছড়ির জোরে নাকানি-চুবানি খাইয়েছিলেন, আজ তাদের করুণা ভিক্ষার জন্য বৃদ্ধ বয়সে এসেও হেন কোন কাজ নেই যে এই এরশাদ করছেন না। একসময়ের সকল কাজের কাজী, এরশাদের সেই ক্ষিপ্র চোখ এখন মাছের চোখের মতো মিন মিন করে কি যেন খুঁজে বেড়ায়।

এরশাদের সব কিছুই যে খারাপ- তা বলছিনা। নিজের শাসনের সময় এরশাদ বেশ যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েওছিলেন, যদিও ব্যুরোক্রেসির লাল ফিতার দৌরাত্ম আর কায়েমি স্বার্থের কাছে তার নিজেরই সেই বৈপ্লবিক কিছু সংস্কারমূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূলে নিজেই কুঠারাঘাত করে যান। না হলে এরশাদ যেমন করেছিলেন প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, উপজেলা ব্যবস্থা, জাতীয় ঔষধ নীতি, জনসংখ্যা নীতি, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ- এই কাজগুলো যদি এরশাদ যেমন শুরু করেছিলেন, তেমনি সঠিক এবং যুগোপযোগী করে সংস্কার করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো। আসলে এরশাদ নিজেই ছিলেন একজন বদ লোক, ভালো কাজ মাথায় আসলেও নিজের বদ স্বভাবের আর অসৎ সংসর্গ ও দুষ্টু, লম্পট চরিত্রের কারণে সেই সব ঐতিহাসিক সংস্কারমূলক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডেও অগণতান্ত্রিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে সমূলেই সেই সম্ভাবনাময় সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সেজন্য তখনকার কায়েমি বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এরশাদ নিজে এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গ আর বদলোকগুলো অনেকাংশে দায়ী। এরশাদ বৈপ্লবিক কাজে হাত দিয়ে বসেন, অথচ নিজে এবং সাঙ্গ-পাঙ্গ সব সেকেলে, কায়েমি আর বদের হাড্ডি নিয়ে চলতে থাকেন।

ছাত্রদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে সেলিম, দেলোয়ারের রক্তে এরশাদের হাত রঞ্জিত। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এরশাদ আজ ছাত্রলীগের নেত্রী সভানেত্রী শেখ হাসিনার ভাই হয়ে মহাজোটের শরীক। ডাঃ মিলনের ঘাতক, শহীদ জেহাদ, ময়েজউদ্দিন, তিব্বত, কাঞ্চন, দীপালী সাহা, শাজাহান সিরাজ সহ অসংখ্য শহীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এরশাদ দুর্দন্ড প্রতাপের সাথে দেশ শাসন করেছিলেন। এরশাদের সেদিনকার বিরোধীদলীয় নেতা হাসানুল হক ইনু আজ এরশাদের সহযোদ্ধা। একেই বলে আমাদের রাজনীতি।

তারপরেও এরশাদ চাচা ( বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চাচার বয়সেরও অধিক বয়সী সম্মানিত ব্যক্তি)এতো ওলট-পালট আর প্রয়াত পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসান কর্তৃক বিশ্ব বেহায়ার খেতাব প্রাপ্ত হয়েও আজ চুরাশি বছর বয়সে এসেও মনের, দেহের, চোখের, চাহিদা ও যোগানের কোন স্থিতি হতে দেখিনা। মানুষ যৌবনে রক্ত গরম, মাথা গরম, সঙ্গদূষ, অসৎ চরিত্র হেতু অনেক ভুল-ভ্রান্তি করে পৌড়ত্বে বা বার্ধক্যে এসে পেছনের ডায়রির দিকে যখন তাকায়, তখন আল্লাহর ভয় আর কবরের অনন্ত জিন্দেগীর কথা ভেবে আফসোস আর তওবা, ইস্তেগফার করে মনের, দেহের, বাক্যের স্থিতি নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। বিরুদ্ধ ও প্রতিকুল পরিবেশে বা ঘেরাটোপে আটকা পড়লে চুপসে হয়ে যায়। মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় থাকে মুখ খোলার বা তওবা-তসবিহ জপতে থাকে। জীবন ও কাজের মধ্যে একধরনের নমনীয়তা, কমনীয়তা, সাম্য, সুস্থিতি নিয়ে আসে।

অথচ চাচারে, প্রিয় এরশাদ চাচা, আপনি সকালে এক কথা বলেনতো, বিকেলে আরেক কথা বলেন। মধ্যাহ্নে এক ডায়ালগ দিলেনতো, সন্ধ্যার আলো নিভার আগেই আরেক ক্যারিশম্যাটিক ডায়ালগ দিয়ে বসলেন। বেশী কিছু না, সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসের প্রতিদিনকার খবরের কাগজ আপনি নিজে একটু ওল্টায়ে দেখুন, নিজের কাছেই জবাব পেয়ে যাবেন। একজন কতো বদমাশ আর মোনাফেক হলে নিজের দেয়া ওয়াদার উপর থেকে এক মুহূর্তেই সরে গিয়ে নতুন কথা আবার প্রেসের সামনে অনুনয়, বিনয় করে বলতে পারে, এরশাদ চাচা, আপনাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতোনা।

এমননা যে, আপনি একেবারে ফকির, রাস্তার ভিখেরি হয়ে আছেন- তাও না। আল্লাহ পাক জীবন চলার চড়াই-উতড়াইয়ে আপনাকে অনেক কিছুই দিয়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচাইতে ভাগ্যবান সেনা নায়ক যেমন আপনি ( আপনার শাসনভার গ্রহণের সময় সেদিন আপনার আজকের সহযোদ্ধা সেলিমের বাংলার বাণী হেড লাইন করেছিলো এক ফোটা রক্তও ঝরেনি, একটি বুলেটও খরচ হয়নি) , একই সাথে সবচাইতে অথর্ব এক সাবেক সেনাপতি আপনি। সেনানায়কের কাছ থেকে এরকম আবুল-তাবোল বাক্যবাণ জাতি আর কতো শুনবে ?

একধরনের রোগ আছে ডিমেনশিয়া– যার কোন চিকিৎসা এখন পর্যন্ত মেডিক্যাল সাইন্স আবিষ্কার করতে পারেনি। বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতি বিলোপের এই রোগ পৃথিবীর খুব কম ডাক্তারই শুরুতেই ধরতে পারেন। যখন ধরা পড়ে তখন এই রোগের আর কোন ঔষধ কিংবা চিকিৎসা করা সম্ভব হয়না। চাচারে, গরীব দেশ ফকির করে দিয়ে আপনাদের মতো রাষ্ট্রনায়কেরাতো অনেক কামিয়েছেন। আমারতো মনে হয়, রেজিস্ট্রি খাতা না দেখলে বলতেও পারবেননা কোথায় কত সম্পত্তি আপনার আছে। জিনাত, নাশিদ, মেরী, হালের দিশা-ভিসা সবাইকে উজাড় করে দিয়েওতো আপনার গোপন অঢেল খাজানা শেষ হওয়ার নয়। তাহলে ডিমেনশিয়ার রোগের বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে সেই মতো চলতে বাধা কোথায়? চুরি, লুট, মহালুট, রাষ্ট্রীয় উপঢৌকন সবইতো নিয়েছেন, এবার শেষ বয়সে অন্তত একটু আরাম আর ইজ্জত, সম্মানের সাথে কাটান।

চাচারে, আপনার সপ্তম সংশোধনী আর উপজেলা, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ঔষধ নীতি, জনসংখ্যা নীতি প্রভৃতিকে বৈধতা দেয়ার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সবচাইতে জনপ্রিয় ও অবিসংবাদিত নেতার আসনে যার নাম– ছাত্র,শ্রমিক, যুবক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কাছে পরম স্নেহে লালিত ও উচ্চারিত হতো, সেই বিপ্লবী আ স ম আবদুর রব ১৫ দলীয় ঐক্যজোটকে রাস্তায় রেখে আপনার সাথে হাত মিলিয়ে নিজের সারা জীবনের সমগ্র উপার্জন, জনতার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সব কিছু বিসর্জন দিয়েছিলো আপনার জন্যে, অথচ সেই আ স ম আবদুর রবকেও আপনি এই চুরাশি বছর বয়সে এসে আবারও ধোঁকা আর ছলনার বেষ্টনে ফেলে দিয়ে নৌকার মইয়ে পাল তুলে নাটকের মঞ্চায়ন করতে চেয়েছিলেন। আফসোস, চাচা, এবার আর সম্ভব হলোনা। পড়ন্ত বেলায় আপনি যেমন সেয়ানা, আ স ম রবও সেয়ানা। কিন্তু দুজনের সেয়ানা গিরি অনেক দেরীতে হয়ে গেলো, যা কখনো আর জীবন দিয়েও শুধরানো যাবেনা। চাচারে, এমনি করে আপনি বাংলাদেশের সব কটা সম্ভাবনাময় জাঁদরেল লিডারদের কড়কড়ে টাকার আর ক্ষমতার খেলার ছলনায় ফেলে এ জাতির যে ক্ষতি করে রেখেছন, নেতৃত্বশূন্য করে পঙ্গু করে রেখেছ, বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আপনার মত এতো ক্ষতি ( রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্যতা) আর কেউ করেনি।

এদেশের সবচাইতে আশা আর ভরসা ও আদর্শ স্থল ছিলো যে ছাত্র সমাজ, সেই ছাত্র সমাজের হাতে অস্র আর টাকাকড়ি, নগদ ব্যবসা, বাণিজ্য, দলবাজি, টেন্ডারবাজী, অস্রবাজি, মাস্তানি, সবই রাষ্ট্রীয়ভাবে আপনিই করে দিয়ে গোটা ছাত্ররাজনীতিকে কলঙ্কিত ও দুষিত করার সুন্দর ও কাব্যিক এক সূত্রপাত করেছিলেন, যার রেশ এখন দল থেকে দলে, জোট থেকে জোটে বয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ হারাচ্ছে তার মেধাবী সন্তান আর আগামীর স্বপ্নদ্রষ্টাদের।

এতোসব করার পরেও চাচা, এদেশের অতি সাধারণ আর অতিথি আপ্যায়নে সমৃদ্ধ এই বাঙালি জাতি আপনাকে অনেক আদরে আহ্লাদে রেখেছে। মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখে আপনাকে নিয়ে। মানুষ আপনার অতীতকে খুঁজে ফিরছেনা, আপনার মাঝে দেখতে চাচ্ছে আগামীর এক সম্ভাবনাময় এরশাদকে। কিন্তু মানুষ জানেনা, এই এরশাদ অনেক আগেই পচে, গলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর যে একবার নষ্ট হয়ে যায়, সে আর কখনো সুন্দরের সৃষ্টি করতে পারেনা। কারণ এরশাদ চাইলেও এখন আর “ তোমাদের পাশে এসে, সব ব্যথা বুকে নিতে আজকের চেষ্টা আমার “- এরকম মিথ, স্রোত, সৃষ্টিশীল ক্রিয়েটিভ রাজনীতির উপহার দিতে পারবেনা। আমাদের এই চাচা এরশাদ আদতেই একজন বদ লোক, যে যৌবনে নারী সঙ্গ নিয়ে বুদ হয়ে থাকতো, পৌড়ত্বে এসেও সে তার বদ স্বভাবের নষ্ট রাজনীতির নষ্টামি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেনা। রাজনীতিকে নষ্টামি করে সুস্থ রাজনীতি কি করে করবেন চাচা ? একটু কি ভেবে দেখেছন ?

ক্ষমতায় থাকতে আটরশী-ফাটরশী কতো যে ভণ্ডামি করেছিলে্ন, এখন আবার পত্রিকায় দেখলাম, হাট হাজারী যাচ্ছেন আশীর্বাদ নিতে। চাচা আর কতো ? এবার একটু থামো চাচা প্লিজ। হয় সুস্থ রাজনীতি একা হলেও করো, নয়তো এখানেই থামো চাচা।

Salim932@googlemail.com
17th November 2013.London.

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *