এই মুহূর্তের বাংলাদেশ এবং এর রাজনীতি বলা যায় এক টালমাটাল অবস্থায় আছে। দেশ যে কে চালাচ্ছে, কিভাবে চলছে- তা নিয়ে দেশবাসীর সাথে, সচেতন জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে দিন রাতের গুম হারাম করে চলেছে বিশ্বের প্রভাবশালী সকল নামকরা সংবাদ পত্রিকা আর মিডিয়াগুলো। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে আওয়ামীলীগ, বিএনপির সাথে জাতিসংঘ, ভারত, আমেরিকা, চীনের পর এবার ইকোনোমিষ্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য হিন্দুও সমানভাবে উদ্বিগ্ন। অবশ্য এই উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতার সাথে অনেক আগেই শীর্ষে আরোহন করে আছে ভারতের আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইকোনোমিক টাইমস প্রভৃতি।
নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য হিন্দু, ইকোনোমিষ্ট যখন বাংলাদেশ নিয়ে তাদের ভাবনা তুলে ধরে, তখন আমাদের পত্র-পত্রিকাও বেশ লোভনীয়ভাবে লুফে নিয়ে তা প্রকাশ করে একেবারে হেড লাইনে। প্রকাশ করারই কথা। বিশ্বের নামকরা ঐসব সংবাদ পত্রের পাঠক সংখ্যা মিলিয়ন বিলিয়নের উপরে। সুতরাং এরকম পত্রিকায় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে যখন সংবাদ কিংবা সম্পাদকীয় প্রকাশ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই সেটা সকলের জন্যই না চাইতেই যেন এক মহামূল্যবান প্রাপ্তি।কিন্তু, লক্ষণীয়, কোন পত্রিকাই কখনো সেই সব সংবাদ বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করার মতো সুন্দর, সুস্থ, তেজোদীপ্ত, ক্ষুরধার কোন লেখনী দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে কেন জানি একধরনের হীনমন্যতা বা কার্পণ্যতা করে চলেন, সেটা বোধগম্য নয়। বরং সেই সব সংবাদের অনুবাদের সাথে সংবাদ বিশ্লেষণ বাংলাদেশের আপামর জনগণের অবস্থা ও অবস্থানের প্রেক্ষিতেই বেশীমাত্রায় বিশ্লেষিত হওয়াটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত ছিলো। আমাদের বড় বড় পত্রিকা আর বহুল স-প্রচারিত সর্বাধিক পাঠকের দাবিদার সংবাদপত্র আর বড় মাপের সাংবাদিকেরা কেন যে এই কাজটি করতে উৎসাহ পাননা, অথবা অধঃস্থন কাউকেও উৎসাহিত করেননা সেটা বোধগম্য নয়।একই অবস্থা চ্যানেলগুলোর মধ্যেও। গথ বাধা টকশোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। একটু রিসার্চ ধর্মী সংবাদ বিশ্লেষণ উপস্থাপনে বাধা কোথায় ?
২০ নভেম্বর ২০১৩ ইকোনোমিষ্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস আর দ্য হিন্দুর বিশেষ প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় ঘাটাঘাটি করে যে কথাটি মোটামুটি একই সুরে উপলব্ধি করা যায়, আর তাহলো বিশ্বের এই তিন রাজ্যের তিন প্রভাবশালী পত্রিকা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকালিন সরকার, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতার অভাব আর সহিংস ও উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েই তাদের অভিমত তুলে ধরেছেন। ইকোনোমিষ্ট যেমন তার নিরপেক্ষতার কষ্টিপাথরে টু দ্য পয়েন্ট সংবাদ প্রতিবেদন করেছে, সেখানে নিউ ইয়র্ক টাইমস একটু এগিয়ে এসে আগামীর সরকার নিষেধাজ্ঞার মতো চরম এক বৈরি অবস্থার মুখোমুখি বাংলাদেশ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। অপরদিকে দ্য হিন্দু তাদের বন্ধু আওয়ামীলীগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছে, ভারতের উচিত দুই পক্ষের সাথে সমান কূটনীনৈতিক উদ্যোগে সমঝোতার পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা-বরং কারো পক্ষে নয়। অর্থাৎ রাজনীতি বিজ্ঞানের সেই মুখস্থ বিদেশ নীতির সুন্দর নীতিমালার সারাংশই দ্য হিন্দু তাদের প্রতিবেদনের শেষ লাইনে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশের এই উত্থাল ও অসংলগ্ন রাজনৈতিক অবস্থায় কাল হয়তো এই মিছিলে শামিল হতে পারে গার্ডিয়ান, ষ্টার, সিএনএন, বিবিসি, এনবিসি, ফক্স আরো অনেকেই । আল-জাজিরাতো অনেক আগেই শরিক হয়ে আছে এই মিছিলে।
আলাদীনের প্রদীপের নয়া কাব্যিক সংস্করণ:
০২) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ দ্রুত যেন পরিবর্তিত হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। কেউ কোন কিছু আন্দাজ করে কিংবা চলমান ঘটনা প্রবাহ কেলকুলেশন করে এরিথম্যাটিক কিংবা জিওমেট্রিক পন্থায় উপস্থাপনের সুযোগ খুব একটা কমই মিলছে। পর্দার অন্তরালের খেলা আরো ভয়াবহ।এ যেন আলাদীনের প্রদীপের নয়া এক কাব্যিক সংস্করণ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
দ্য হিন্দু, ইকোনোমিষ্ট, নিউইয়র্ক টাইমস আর নিশা দেশাইয়ের নিশা লাগানো –
০৩) দ্য হিন্দু, নিউ ইয়র্ক টাইমস, আর ইকোনোমিষ্ট এর ভিতরের বা পর্দার অন্তরালের ডিপ্লোমেটিক খেলার সাথে বাংলাদেশের পর্দার অন্তরালের রাজনীতির খেলার ছক কিন্তু এক ও অভিন্ন। যেমন করে অভিন্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের পাতানো ছকের। বাইরে কথামালার কূটনীতির ফুলজুরির সাথে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই মেরুতে থাকলেও নিশা দেশাইয়ের নিশা লাগানো কূটনৈতিক দূতিয়ালি আর মজীনার দৌড়-ঝাপ আর পঙ্কজ শরণের ঘন ঘন একের পর এক রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠক- সেই নিশা লাগানোর দেশাই কূটনীতির অন্য কথার ছক মোতাবেক বাংলাদেশের রাজনীতি এখন চলছে, একথা আমরা ধরেই নিতে পারি। কেননা, আমাদের একটা কথা ভুলে গেলে চলবেনা, আমেরিকা ও ভারতের বর্তমান ব্যবসা, বাণিজ্য, ইনভেষ্টম্যান্ট, সমরনীতি, ডিপ্লোম্যাটিক টাই বাংলাদেশের হাসিনা, খালেদা, গোলাম আযম, আল্লামা শফীর জন্য তাদের নিজেদের বিশাল ও বৃহৎ এবং আগামী দিনের দক্ষিণ এশিয়ায় লিডিং করার বাণিজ্য, অর্থনীতি, ইনভেষ্টম্যান্ট, সামরিক, রাজনৈতিক স্বার্থ নষ্ট করে দিবে- এটা ভাববার কোন কারণ নেই। ভারত-আমেরিকার মহারথীরা বাংলাদেশের হাসিনা-খালেদার জন্য তাদের প্যাক্ট ও ষ্ট্র্যাটেজী, আগামী দশকের ডিপ্লোমেসি কিছুতেই আঁচড় লাগুক বা নষ্ট হয়ে যাক-সেটা হতে দিবেনা। আজকের যুগের একজন বোকা লোকও এমন ধারণা রাখেন। রাখেননা শুধু আমাদের গুণধর রাজনীতিবিদেরা।তাই আত্মাহুতি দিতে ভুল করেননা।
দেশাই এর নিশা লাগানো অন্য শব্দের উচ্চারণের নতুন কূটনীতি আর ২৭ নভেম্বর টিকফায় স্বাক্ষরের সম্মতি, সবই এখন ভারত-বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র তিনটি আপাত: দৃশ্যের নক্ষত্রের এক এবং অভিন্ন স্বার্থের নিশা লাগানোর কূটনীতি, যা হাসিনার সরকারের যেন তেন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার দুর্লভ ও দুর্দমনীয় এক অমার্জনীয় ও সাপ মারবো লাঠিও ভাঙ্গবোনা কিংবা চার মাস আগে সজীব ওয়াজেদ জয়ের আমার কাছে তথ্য আছের সেই বহুল আলোচিত মিথের বাস্তবতার ভারতীয় ছকের প্রভাবের বৃত্তের বাইরে না গিয়ে বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বিশ্ব কূটনীতি এখন ওপেন সিক্রেট, যা চায়নিজ এম্বিশিয়াজ সোনাদিয়া দ্বীপ হয়ে আফ্রিকা টু অস্ট্রেলিয়া ফুয়েল সাম্রাজ্য গড়ে তুলার রুট থামিয়ে দেয়ার মার্কিনীদের উদ্যোগের সুপার পাওয়ার সফট ডিপ্লোমেসির নয়া সংস্করণের প্রাথমিক ড্রেস রিহার্সাল বাংলাদেশের আগামীর নির্বাচন, যার মধ্য দিয়ে সুপার পাওয়ার সফট ডিপ্লোমেসির অভিষেকের জানান বিশ্ব জানিয়ে দিলো বাংলাদেশকে।
আর দুই বছরের সরকার!
০৪) এই সফট ডিপ্লোমেসির স্বার্থের অনুকূলে থাকার কারণে হাসিনার সরকারের এই তথাকথিত সর্বদলীয় সরকার-এর সময়কাল নিয়ে তাই এখনি সংশয় অমূলক নয়। কেননা, হাসিনা জানেন, খালেদা জিয়াও এখন অবগত হয়ে গেছেন, বাংলাদেশ নিজেদের অজান্তেই সেই সুপার পাওয়ার সফট ডিপ্লোমেসির শিকার হয়ে পড়েছে। যার ফলে হাসিনার সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই বিএনপির সাথে নেপথ্যে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের দিকে যাবেননা। আর নির্বাচনের দিকে না যাওয়ার মানেই হলো, এই সরকারের দীর্ঘমেয়াদী কাল অবস্থান-হতে পারে দুবছর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে হাসিনার বিশ্বাস বিএনপির সাথে সমঝোতার পথ খুলে নিতে পারবেন। আর যদি নির্বাচন হয়ও, বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে কিংবা না করলেও আ স ম আবদুর রব যেমন বলেছেন, আওয়ামীলীগ আসবে বাক্স পুরোপুরি ভর্তি করে নিয়ে নির্বাচনে, আর আমি যাবো খালি হাতে খালি বাক্স ভরার জন্য- এ নির্বাচনে আমি এ যাবোনা, আসলেও তাই হবে। কেননা এখনতো আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গিয়েছেন, দুদিন পর আরো অনেকেই যাবেন, যারা এই সরকারের সমালোচনা বেশী করছেন, তারা আগেই যাবেন। সুযোগ যারা হাতের কাছে পাবেন, তারা কি আর সুযোগ হাতছাড়া করবেন ? কারণ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের গোটা রাজনীতিতো কখনো জনগণের জন্য নয়। এটা কেউ মানেন আর নাই মানেন-এটাই বাস্তব।
তাই আজকে প্রভাবশালী বিশ্ব মিডিয়া আগ বাড়িয়ে আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা ও ডামাডোল নিয়ে যতটা না সক্রিয়, তারা আমাদের রাজনীতির ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ নিয়ে ততো সক্রিয় হতে কখনো দেখা যায়নি। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়ার সাথে আমাদের প্রভাবশালী মিডিয়াও আনন্দ বাজার, ইকোনোমিষ্ট, টাইমস অব ইন্ডিয়া আর আল-জাজিরার সাথে মিলে আরো অনেক নাটক ও খেলা করবে, পানি এখানে ঘোলা করবে, তা বুঝাই যাচ্ছে। আর তা দেখার জন্য আমাদের সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
Salim932@googlemail.com
21st November 2013, London.