Submitted by syed shah salim… on Fri, 26/07/2013 – 8:17am
তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে বিরোধীদল যেমন অটল, একই সাথে তত্বাবধায়ক নয় বরং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে সরকারি দলের অবস্থান হেতু আমাদের বিরাজমান রাজনৈতিক চালচিত্র বলা যায় এক ভয়ঙ্কর সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের দিকে এগুচ্ছে। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা এবং রক্তাক্ত রাজনৈতিক ইতিহাস তাই বলে। বলা বাহুল্য, দেশের ৯০ ভাগ জনগণ বলা যায় এই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে হলেও ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের অহমিকা আর একগুঁয়েমির কারণে ও বোধগম্য রাজনৈতিক কারণ হেতু এই দাবীর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চলেছে, যা গণতান্ত্রিক ও সহিঞ্চু রাজনীতির অন্তরায় বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বোদ্ধারা যদিও হরহামেশা এই তত্বাবধায়ক ইস্যুতে উভয় রাজনৈতিক দলকে একটি সমঝোতায় পৌছার আহবান করে আসছেন, কিন্তু সে আহবান, সেই সব মিনতি কেবল টক শো আর টিভি, মিডিয়া আর চায়ের টেবিলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে, যাদের জন্য বলা তাদের কেউই এ বিষয়ে সমঝোতার মতো কোন সুন্দর অবস্থা ও পরিবেশের সামান্যতম ধার ধারেন বলে মনে হচ্ছেনা।এই আমাদের বিরাজমান গণতান্ত্রিক চলমান রাজনীতির সবচাইতে মাইন্ড সেটের এক বড়-সংকট, যেখান থেকে আমরা কেউই বেরিয়ে আসতে কিংবা উত্তরণ ঘটাতে পারছিনা। সেটা কি দলীয়, কি সরকারি, কি বেসরকারি সকল ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। আর দুই বৃহৎ দলের দুই নেত্রী দলীয় এই অপ-রাজনীতির সুযোগে নিজে যেমন রাজকীয় ও জমিদারী স্টাইলে এই একগুঁয়েমি, এই তাঁবেদারি, এই লেজুড়বৃত্তি উপভোগ করছেন খুব সুনাম ও দক্ষতার সাথে, একই সাথে বলা যায়, দুই নেত্রীর আঙ্গুলের ইশারার উপর এই জাতির ভাগ্য বিপর্যয় কিংবা ভাগ্য উন্নয়ন ও ভাগ্যদেবী আশীর্বাদের মাত্রা উঠা-নামা করে চলে এমন করে, এ যেন বানরের বিশ হাত লাঠি বেয়ে উপরে উঠার পর আবার বিশ হাত নীচে তৈলাক্ত মর্দনে শপাং করে নামার মতোই।
০২) তত্বাবধায়কের বিকল্প কি হতে পারে বা এই রকম রাজনীতির এই অচলায়তন ও সংকট মোচনের জন্য উভয় দলের সম্মানার্থে সমঝোতার কি উন্নত ফর্মুলা হতে পারে, এ নিয়েও উভয় দলের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা কিন্তু খুব একটা সোচ্চার নন। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে নেত্রীর রোষানলে পড়ার ভয়ে সমঝোতার কোন নয়া ফর্মুলা উপস্থাপন থেকে বিরত রয়েছেন।
ইতিমধ্যে টিআইবি নির্বাচনকালিন সরকারের যে ফর্মুলা উপস্থাপন করেছিলো, বিএনপি আগ বাড়িয়ে সেই ফর্মুলা সমর্থন করায় আওয়ামীলীগের জাত্যভিমানে লেগেছিলো। আবার টিআইবির সাথে আওয়ামী ঘরানার অনেকেই জড়িত থাকা সত্বেও দুর্নীতি ও সুশাসনের প্রশ্নে টিআইবি সোচ্চার থাকায় আওয়ামীলীগ টিআইবিকে তাই খুব একটা সুনজরে দেখছেনা। সুতরাং টিআইবির ফর্মুলা সংবাদ পত্রের পাতাতেই রয়ে যায়। অতি সম্প্রতি মহাজোটের সাংসদ ওয়ার্কাস পার্টির রাশেদ খান মেনন নির্বাচনকালিন সরকারের নতুন কিছু যুক্ত করে আওয়ামীলীগের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলা দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কোন পক্ষ থেকেই এব্যাপারে মুখ খোলা হয়নি।
ইতিমধ্যে তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ডঃ আকবর আলী খান সহ অনেকেই এই তত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে নিজেদের মতামত প্রদান করে চলেছেন।কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কোন সমঝোতার আভাস পাওয়া যায়নি।
মাজখানে ব্যবসায়ীদের সংগঠন-এফবিসিসিআই-এর উদ্যোগের কথা শুনা গিয়েছিলো, কিন্তু সে চেষ্টাও থমকে গেছে অদৃশ্য কোন এক কারণে।
০৩) ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর আজকের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্য জোট, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ৭ দলীয় ঐক্যজোট আর জামায়াতে ইসলামীর যুগপৎ আন্দোলনের ফসল হিসেবে সব কটা সফল নির্বাচন মোটামুটি দুএকটি ঘটনা বাদে এই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বেশ সফল ভাবেই সম্পন্ন হয়েছিলো, দেশে-বিদেশেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলো। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে বিশ্বের বুকে নির্বাচনকালিন সময়ে এরকম এক তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সফলভাবে অবাধ, নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করেছিলো, যা এক বিরল ও একইসাথে বলা যায় ঐতিহাসিক ও বিশ্ব-রাজনীতির পরিমণ্ডলে এক যুগান্তকারী ব্যবস্থা।
*** বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে আজকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক গণতান্ত্রিক এমন কোন অবস্থান নেই যে কোন দলের আন্ডারে বা কোন দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাবে গৃহীত হয় বা হবে- এরকম কোন পরিবেশ দেশের মধ্যে নেই, একথা সরকারি এবং বিরোধী এমনকি আমাদের বন্ধু দেশ গুলোও স্বীকার করেন। আমরা কেউ কাউকে যেমন বিশ্বাস করিনা, তেমনি একে অন্যের প্রতি ঘৃণা ও কুৎসা রটানো থেকেও পিছুপা হইনা। আমরা একইভাবে যেমন গণতান্ত্রিক, ঠিক তেমনি আমরা চরম অসহিঞ্চু ও অধৈর্যশীল, অস্থির এক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিরন্তর বয়ে নিয়ে চলেছি।
ধরেই নিলাম এই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো বা অন্য কোনভাবে হলো। কিন্তু এইভাবে নির্বাচন হওয়ার পরেরদিন থেকে দেশের জনগণ আরো পাঁচটি বছর নিদারুণ এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে আর কতো চলবে? বিরোধীদলে যে দলই যাবে, সেই দলই নির্বাচনের পরেরদিন থেকেই আগামী নির্বাচন তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার জন্য চিল্লা-চিল্লি করতে থাকবে। কিন্তু এইভাবে আর কতো? এই রকম অনিশ্চিত এক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসার কি কোন উপায় নেই ? ৯০ সালের পর থেকে এতো বছর হতে চললো, এখন পর্যন্ত দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কেউই স্থায়ী কোন সমাধানের পথে এগুলোনা। এটাই বড় আফসোস ও নিদারুণ হতাশাজনক এক রাজনৈতিক অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয় বার বার।
০৪)** কেউ কেউ পার্লামেন্টে উচ্চ কক্ষ গঠনের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কথা অনেক আগ থেকে বলে আসছেন। এরশাদ সাহেব যখন ক্ষমতাসীন, ৮৩ সালের শেষ দিকে যশোর ক্যান্টনম্যান্টে প্রয়াত শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ শাহজাহানের সাথে এরশাদ সাহেবের কতিপয় উর্দিপরা নীতি-নির্ধারকদের সাথে সেদিন উপস্থিত ছিলাম, মোহাম্মদ শাহজাহান অত্যন্ত বিচক্ষণ দূরদর্শী এক রাজনীতিক ছিলেন। সিরাজুল আলম খান ও ডঃ জিল্লুর রহমান খানের শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে সামরিক উর্দি পরাদের সাথে সুন্দরভাবে যখন আলোচনা করছিলেন, তখনকার জিওসি বলছিলেন, এক কাজ করেন শাহজাহান ভাই, আপনাদের দাদার এই পুরো বিষয়টি ঢাকায় আমাদের নীতি-নির্ধারকদের সাথে খোলাখোলি আলোচনার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়। যেমন প্রস্তাব, তেমনি শাহজাহান সাহেব লুফে নিয়ে তাৎক্ষনিক জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের সাথে যোগাযোগ করলেন। পরবর্তীতে অনেক নাটকীয় ঘটনা, এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, এরশাদের আমন্ত্রণে কেবিনেট মিটিংয়ে আ স ম আবদুর রব, মোহাম্মদ শাহজাহান যখন সিরাজুল আলম খানের এই শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা তুলে ধরছিলেন,মিজান চৌধুরী বাদে সামরিক-অসামরিক সকলেই একমত হয়েছিলেন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের। সিরাজুল আলম খানের কনসেপ্টুয়াল ফ্রেম ওয়ার্ক বইয়ের ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় এই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
***আজকে তত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিশৃঙ্খল পূর্ণ রাজনৈতিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদেরকে এই বিশৃঙ্খল পূর্ণ ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে। আমাদেরকে ভাবতে হবে এর বিকল্প কি হতে পারে ? মহাজোটের শরিক জাসদের ইনু এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপি এই দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিরোধী নয়, বরং তারা এর সমর্থক।মহাজোটের বাইরে আ স ম আবদুর রব সহ যারা এর প্রস্তাবক ও প্রচারক তাদের অনেকেই এর বিকল্প হিসেবে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলছেন। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্রিটেনের আদলে কমন্স সভা ও লর্ড সভার মতো দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা নির্বাচনকালিন সংকটের স্থায়ী সমাধান হিসেবেও চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানা গেছে। আমাদের পাশের দেশ ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে এই দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কার্যক্রম রয়েছে।আবার এক্ষেত্রে অনেকে আবার সিরাজুল আলম খানের প্রস্তাবিত দ্বি-কক্ষ বা পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষের সাথে সংসদের আসন বাড়ানোর পক্ষে, এমনকি জানা যায় আমাদের ইসিও এই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।সিরাজুল আলম খান যখন (৮০সালে)এই তত্ব দেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন পথিক তুমি কি পথ হারিয়েছ? অথচ আজকের বাংলাদেশের বিরাজমান বাস্তবতা, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি চাপ, মানুষের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা, আর বিভিন্ন সমাজ শক্তির অভ্যুদয় আর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধির ফলে সিরাজুল আলম খানের সাথে কেবলমাত্র আ স ম আবদুর রব নন, আজকের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ডঃ আবুল বারাকাতও কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সংসদের আসন বৃদ্ধি করে ৫০০ তে উন্নীত করে বিরাজমান সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।কিছুদিন আগে বিদেশী গণমাধ্যমে দুবাইতে খ্যাতিমান বাঙালি শিল্পপতিও নিজ নিজ পেশার প্রতিনিধিত্ব সংসদে দাবী করেছেন।
** রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, আমাদেরকেও এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে এই রকম কোন এক পন্থার দিকে এগুতে হবে। নতুবা রাজনীতি থেকে আমাদের এই সংঘাত, বিভাজন দূর হবেনা।কারণ পরিবর্তিত বিশ্বের আলোকে, একই সাথে বৈশ্বয়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক নয়া বিন্যাসের ফলে মানুষের চাহিদা যেমন ক্রমাগত বাড়তে থাকবে, ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকবে, একই সাথে সেই বাড়তি চাহিদার সাথে যোগানের সমন্বয়হীনতার ফলে সংঘাত বৃদ্ধি পেতেই থাকবে, যা আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে করে তুলবে অস্থিতিশীল। সুতরাং আমাদের সকলকে এখনি নিতে হবে আগাম ব্যবস্থা, নতুবা আমাদের জন্য ভয়াবহ সংঘাত আর বিপর্যয় থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা মুস্কিল হয়ে পড়বে, যার কিছু কিছু ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
২২শে জুলাই ২০১৩।
- to post comments
- 3059 reads