জাতি সংঘের দূত ফার্নান্দেজ তারানকোর উদ্যোগে দুই নেত্রী ও দলের মধ্যে সংলাপের একটা পরিবেশ পরিলক্ষিত হওয়ায় রাজনীতিতে সুবাতাস প্রবাহিত হওয়ার একটা সুলক্ষণ সূচিত হয়েছে বলে আপাতঃদৃষ্ঠিতে তাই মনে হচ্ছে।মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা সহ ইতিমধ্যে পর্দার অন্তরালে ও প্রকাশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নানান ফর্মুলা নিয়ে দূতিয়ালি করে চলেছেন। রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বেশ নাটকীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কেননা, তারানকোর উদ্যোগে ইতিমধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তত্বাবধায়ক সরকারের আগাম শর্তযুক্ত সংলাপের দাবি থেকে অনেকটাই সরে এসে শর্তহীন সংলাপে নিজেদের অবস্থান ঘটা করেই প্রকাশ করেছেন। চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শমসের মবিন এবং পরবর্তীতে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ডঃ মঈন খান মিডিয়ার সাথে সাক্ষাতকারে বেশ স্পষ্টতই বলেছেন, সংলাপের মাধ্যমেই রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তিনি এবং তার দল আশাবাদী এবং কোন রূপ শর্ত ছাড়াই, তবে আলোচনার প্রধান এজেন্ডাই হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। আওয়ামীলীগ মূলত তারানকোর আহবানে সংলাপের ব্যাপারেও বেশ এগিয়ে এসেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কেননা আওয়ামীলীগও সংলাপে বসতে রাজি হয়েছে।এই যখন অবস্থা তখন আওয়ামীলীগ দলীয় সূত্র দাবি করেছে নিজেদের দলীয় ও জোটের ফোরামে আলোচনার পরই আওয়ামীলীগের উদ্যোগে সংলাপের ব্যাপারে বিএনপিকে চিঠি দেয়া হবে এবং সেটা দু-একদিনের মধ্যেই হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, দুই দলই এখন মূলত: সংলাপের ব্যাপারে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে।কারণ দুই দলের কাছেই এখন প্রতীয়মান সংলাপের মাধ্যমেই বিরাজমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন সম্ভব। আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক দিক বলে সর্ব মহলে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে।
এখান থেকেই যদি আমাদের রাজনৈতিক গতিপথ মসৃণ হয়ে যেতো, সকলেই স্বস্তি পেতেন। কিন্তু রাজনীতির এই অন্ধ গলির সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে এখনো অনেক অন্ধকার। কেননা ইতিমধ্যে মন্ত্রী এবং সরকারী উচ্চ পর্যায়ের তরফ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে যে সংকেত স্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে, মূলত তাকে কেন্দ্র করে সংলাপের ব্যাপারে উভয়দল যেমন তেমন আশাবাদী হতে পারছেনা, একইভাবে আপামর জনগণও খুব একটা আশার আলো দেখছেননা।তারানকোর ফর্মুলায় শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান রেখে নির্বাচনের অল্প আগে পদত্যাগের যে ব্যবস্থা বাতলানো হয়েছে, আপাতঃদৃষ্ঠিতে সংলাপের বন্ধ জানালা খুলে দিলেও উভয় দল তথা বিশেষকরে বিএনপি ও এর শরীকদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক ও সন্দেহ। তার উপর জামায়াতে ইসলামী শুরু থেকেই সংলাপের ব্যাপারে জোট নেত্রীকে নেতিবাচক সিগন্যাল দিয়ে আসছে।অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে আওয়ামীলীগ নেত্রীকে কিছুটা সময়ের জন্য মেনে নেয়া হলেও পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময় বিএনপি যে মানবেনা, সেটা যেমন পরিষ্কার, একইভাবে কূটনৈতিকদের ফর্মুলামতে নির্বাচনের কিছু আগে শেখ হাসিনার পদত্যাগ, এবং মন্দের ভালো হিসেবে অনির্বাচিত ব্যক্তি ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর সবচাইতে গ্রহণযোগ্য স্পিকারকে সরকার প্রধান হিসেবে মেনে নিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের এই ফর্মুলাও অনেকটাই পক্ষপাতদুষ্ট বলে বিএনপি ও জোটের কাছে মনে হতে পারে। কেননা, নির্বাচনের অল্প আগে নতুন সরকার প্রধান করে যদিও বলা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানো ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তখন ব্যাপক রদবদলের সুযোগ থাকবে, তথাপি বাস্তবতার আলোকে কতোটুকু সম্ভব হবে, সেটাই বিরাট প্রশ্ন।কেননা, বিদ্যমান বাস্তবতায়, নির্বাচন কমিশনকে যথাযথভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য অল্প সময় খুব একটা কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য মাত্রার যে হবেনা তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।কেননা, বর্তমান কমিশনের রেখে যাওয়া কাজকে নতুন কর্মকর্তাদের এসে বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার মধ্যে খুব একটা স্বচ্ছতার ও নিরপেক্ষতার মাত্রা আদৌ কতোটুকু সম্ভব কিংবা প্রচলিত নির্বাচনী আইন ও সংবিধান সম্মত সংস্কার সম্ভব কিনা –সেটাই বড় প্রশ্ন।
আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মামলার কার্যক্রম অনুসারে ধারণা করা হচ্ছে, এই মাসের ভিতরেই গোলাম আযমের মামলার রায় আসবে। জামায়াতের সাবেক আমীর, যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী গোলাম আযমের রায় নিয়ে জামায়াত যে বেশ বেকায়দায় ও হার্ড লাইনে চলে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর তারা জোট নেত্রী খালেদা জিয়াকে সংলাপের পজিটিভ পথ থেকে আন্দোলনের পথে নিয়ে যাওয়ার সকল ব্যবস্থাই করবে, এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তবে সব কিছুর নাটকীয় পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, কাদের মোল্লার আপীলের রায় কিংবা রায়ের কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার মাত্রা থেকে, যা সংলাপের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
এহেন অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে জটিলতা যেমন রয়েছে, সংলাপের সম্ভাবনা ভেস্তে কিংবা সংলাপ করেও সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর প্রদীপ জ্বালানোর সুযোগ থেকে জাতি বঞ্চিত হওয়ারই সম্ভাবনাই বেশী। ইতিমধ্যে আবার দুই দল ও তাদের নেত্রীদের কাছ থেকে তৈরি হওয়া সংলাপের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে খানিকটা ভাটার টান লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠছে, সংলাপ শুরুর আগেই বা যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো, তার আগেই সেই একই তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং সে দাবি না মানার বক্তব্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে। সেকারণে, রাজনৈতিক দল সমূহ এবং বিশেষকরে দুই নেত্রীর সদয় অবগতির জন্য ছোটমুখে একটা প্রস্তাব রাখার সাহস করছি, আশা করি নেতৃবৃন্দ ভেবে দেখতে পারেন।সংলাপের জটিলতা কাঠিয়ে উঠা এবং প্রধান এজেন্ডা থেকে জটমুক্ত হওয়ার জন্য আমি মূলত এই প্রস্তাব করছি। তার আগে দুটি কথা বলতে চাই।বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবং বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষিতে কোন অবস্থাতেই ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য সহ অর্থাৎ তাবৎ দুনিয়া থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন হয়ে এককভাবে কোন কিছু করার আদৌ কোন বাস্তব অবস্থা যেমন নেই, সেটা সম্ভবও নয়। কেউ যদি সেটা অস্বীকার করেন বা করার দুঃসাহস দেখান, সেটা অবশ্যই যেমন গর্বের ও গৌরবের, তবে আজকের বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেটা কতোটুকু বাস্তবের আলো দেখবে, সেটাই আসল প্রশ্ন। কারণ এখনকার প্রেক্ষিতে একজন ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিংবা একজন হুগো শ্যাভেজ হয়ে বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে এককভাবে চলা যেমন অসম্ভব, আমাদের মতো বিশ্ব সাহায্য নির্ভর অর্থনীতিতে সেটা আরো অসম্ভব, ঠিক তেমনি নতুন করে নয়া ফিদেল, নয়া শ্যাভেজের জন্ম নেয়াও অসম্ভব। আর এই প্রেক্ষাপটে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি একইসাথে সামাজিক প্রেক্ষিতে দেখতে হবে, এমন একজনকে, যার প্রতি রয়েছে গোটা জাতির অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে যার রয়েছে প্রশ্নাতীত খ্যাতি। একইসাথে আমাদের এই ভু-রাজনীতির মোড়ল, বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত এবং তার সাথে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র , সেইসাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য সহ সব কটা দেশের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। শুধু কি তাই এমন একজন ব্যক্তিকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে, আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও যার রয়েছে গ্রহণযোগ্যতা। এরকম একজন ব্যক্তিই কেবল হতে পারেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান, যাকে কেন্দ্র করে দেশের ভিতরে এবং বাইরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাঠিয়ে উঠে গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ, সকলের কাছে সমান, ফেয়ার, এমন একটা সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।কিন্তু কে হতে পারেন সেই এতো সব গ্রহণযোগ্যের অধিকারী, এই রকম কোন ব্যক্তি কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় পাওয়া যাবে? অবশ্যই পাওয়া যাবে। এবং আমার প্রস্তাবে, সর্বদিক দিয়ে গ্রহণযোগ্য, কূটনৈতিক অঙ্গনে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, স্যার ফজলে হাসান আবেদ। আমি মনে করি, একই সাথে দুই নেত্রী ও দলের কাছে আবেদন করছি, আপনারা একটু উদার মনোভাবনিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদকে মাথায় রেখে নিজেদের মধ্যে সংলাপ শুরু করে দিন। দেখবেন সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখায় সংসদের নির্বাচিত উভয় ও সকল রাজনৈতিকদলের আনুপাতিকহারে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে ( যা তারানকোর ফর্মুলায় দুই দলই একমত)অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রী পরিষদ গঠন করে নির্বাচনকালিন রুটিন ওয়ার্ক সম্পন্ন করা যেতে পারে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের নাম শুধু ঐসব কারণেই প্রস্তাবনা আকারে তুলে ধরছি-এমন নয়। কেননা, সংলাপ নিয়ে যে অচলাবস্থা চলছে, যে সন্দেহ একের পর এক দানা বেধে চলছে, যে কারণে রাজনীতিতে অনেক রক্তপাত ও সহিংসতার জন্ম হয়েছে, এই সব অচলাবস্থা কাঠিয়ে উঠে রাজনৈতিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এরকম এক প্রস্তাব আমি করছি। আওয়ামীলীগের নীতি-নির্ধারনী এবং ১৪ দলের,জাতীয় পার্টি সহ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপির খুব একটা আপত্তি স্যার ফজলে হাসান আবেদের ব্যাপারে আছে বলে মনে হয়না, ঠিক তেমনিভাবে বিএনপি সহ জোটভুক্ত দলেরও খুব একটা আপত্তি থাকবেনা। অবশ্য বিএনপি জোটের কট্রর জামায়াতীদের স্যার ফজলে হাসান আবেদের ব্যাপারে একটু আপত্তি হলেও বৃহত্তরও জোটের চাপে সেই আপত্তি খুব একটা টিকবেনা, তবে বর্তমানে বিএনপির অলৌকিক সন্ন্যাসী দৈব বাণী প্রাপ্ত উপদেষ্টার আপত্তির কারণে খালেদা জিয়া প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ইতিমধ্যে প্রমাণিত তার সকল কৌশলের কারণে খালেদা জিয়ার রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, বেগম জিয়া নিশ্চয় এতোসব বাস্তবতা সামনে রেখে সেই উপদেষ্টার আপত্তিতে স্যার ফজলে হাসান আবেদের ব্যাপারে অসম্মতি দিবেননা বলেই ধরে নেয়া যায়।আর ১৪দলের ভিতরে শরিক ওয়ার্কাস পার্টি, জাসদ, সহ অন্যদের খুব একটা আপত্তি থাকার মতো বাস্তব সম্মত কোন যুক্তিও উপস্থিত নেই।আমাদের রাজনীতির প্রভাবশালী নিয়ামক ভারত এবং মার্কিন ও অন্য সকলেই স্যার ফজলে হাসান আবেদকে মেনে নিতে কোন আপত্তি হবেনা। দেশের জনগণের কাছেও আবেদ গ্রহণ যোগ্য এক ব্যক্তি, যেমন করে প্রশ্ন আসতে পারে ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস কিংবা ব্যারিস্টার রফিকের ব্যাপারে, স্যার ফজলে হাসান আবেদের ব্যাপারের দেশের জনগণের ও নাগরিক সমাজের তরফ থেকে তেমন কোন আপত্তি আসবে বলে মনে হয়না।আমাদের মাননীয় নেতৃবৃন্দকি ভেবে দেখবেন ?
Salim932@googlemail.com
15th may 2013.UK