ক্রাউন প্লাজায় সভা পন্ডঃ পাল্ম ট্রি রেস্টুরেন্টে শান্তিপূর্ণভাবে তারেক রহমানের সভা সম্পন্ন
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
বহুল আলোচিত ও বহুল প্রতীক্ষিত যুক্তরাজ্য বিএনপির নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে এবং নেতা-কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত জাতীয়তাবাদী দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানের উপস্থিতিতে সোমবার বেলা আনুমানিক দুইটার দিকে লন্ডনের ক্রাউন প্লাজা হোটেলে বিএনপির সভা শুরু হয়। ব্রিটেন ও ইউরোপের ২৪টি দেশের বিএনপির শাখা কমিটির প্রেসিডেন্ট, সম্পাদক, আহবায়ক এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী ক্রাউন প্লাজায় উপস্থিত হন। তারেক রহমানের উপস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। ক্রাউন প্লাজা শহীদ জিয়া, খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানের শ্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে। হোটেলের লবির ভিতরে স্থান সংকুলান না হওয়াতে অনেক নেতা-কর্মী বাইরে থেকে হোটেলে ঢোকার জন্য গেইটে ধাক্কা-ধাক্কি করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে উত্তেজিত কর্মী-সমর্থকরা ভিতরের পক্ষের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকলে সেখানে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের সাথে কথা কাঠাকাঠি শুরু হয়। একপর্যায়ে তা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়।
বাইরের এই বিশৃঙ্খলার সংবাদ ভিতরে পৌছলে সেখানেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।এই পর্যায়ে তারেক রহমানের উপস্থিতিতে নেতা-কর্মীরা একে অন্যের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়লে সভায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আকতার হোসেন সভায় শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। উপস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মহিদুর রহমান, সাবেক কমিটির আব্দুল মালিক, ব্যারিস্টার এম এ সালাম নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের শান্ত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সভা পণ্ড হয়ে যায়।
বেলা দুইটায় ক্রাউন প্লাজার সভার শুরুতে তারেক রহমান স্বাগত বক্তব্য দেন। এতে তিনি বাংলাদেশের নিহত জনগণের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন, দুর্গত জনগণের সাহায্যে নেতা-কর্মীদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। এছাড়াও তিনি সরকারের দমন-পীড়নে বিএনপি নেতা-কর্মীদের খোজ-খবর নেন।স্বাগত বক্তব্যে তিনি যুক্তরাজ্য বিএনপির শক্তিশালী কমিটি গঠনের ঘোষণা দিলে পুরো হলে বিএনপি নেতা কর্মীরা তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন।স্বাগত বক্তব্যের পর তারেক রহমান তখন বিভিন্ন শাখা কমিটির প্রতিনিধিদের বক্তব্য দেয়ার আহবান জানান এবং তিনি সকলেরই বক্তব্য শুনবেন বলে সবাইকে আশ্বস্থ করেন। এই পর্যায়ে একে অন্যের বক্তব্যের বিরোধীতা আর বাইরের হট্টগোলে একে অন্যের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়লে সভা পণ্ড হয়ে যায়।হোটেল কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার অজুহাতে পুলিশ কল করলে সভায় উপস্থিত উভয় গ্রুপের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেয়, এখান থেকে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আকতার হোসেন সামান্য আহত হয়েছেন, তবে মহিদুর রহমান, আব্দুল মালিক, এম এ সালাম সহ সভার প্রধান অতিথি তারেক রহমান সভা এখানে স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে পাল্ম ট্রি রেস্টুরেন্টে চলে আসার কথা বলে সেখানে চলে যান।তারেক রহমান, মহিদুর রহমান, আব্দুল মালিক, এম এ সালাম কেউই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেননি।
পরে বিকেলের দিকে ক্রাউন প্লাজা থেকে সভা সরিয়ে নিয়ে পাল্ম ট্রি রেস্টুরেন্টে শুরু হয়। সেখানে নির্ধারিত নেতা-কর্মী ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পাল্ম ট্রি রেস্টুরেন্টে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সভা চলছিলো। সেখানে তারেক রহমান অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে নেতা-কর্মীদের বক্তব্য শুনেন এবং মাঝে-মধ্যে নিজের ডায়রিতে নোট লিখে নিচ্ছিলেন। ক্রাউন প্লাজার মতোই তিনি সবাইকে আশ্বস্থ করেন, সকলের মতামতের ভিত্তিতেই যুক্তরাজ্য বিএনপির গতিকে শক্তিশালী করতে নতুন কমিটি শীগ্রই তিনি ঘোষণা করবেন।এই সভায় বিএনপি নেতা আকতার এবং অধ্যাপক আব্দুল আহাদকে বেশ শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে তারেক রহমানের সভাকে সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে সকল পক্ষের সাথে সমঝোতার পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। শান্তিপূর্ণভাবে সভা অনেক রাত অবধি চলে।
উল্লেখ্য তারেক রহমান গত ১৭ই মে শুক্রবার হঠাৎ করে ইউরোপের রাজধানী ব্রাসেলস-এ গিয়েছিলেন। তারেক রহমানের হঠাৎ করে ব্রাসেলস গমন লন্ডনে রাজনৈতিক এবং বাংলা মিডিয়ায় বেশ গুঞ্জন ও আলোচনার খোঁড়াক জুগিয়েছিলো। বিগত মঈন উদ্দিন-ফখর উদ্দিনের তত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা নির্যাতিত বিএনপির এই তরুণ নেতা লন্ডনে পাড়ি জমানোর পর থেকেই বলা যায়, অনেকটা নীরবে ও মিডিয়াকে এমনকি বিএনপি দলীয় সকল নেতা-কর্মীদের এড়িয়ে লন্ডনের সাসেক্স-এর এক অভিজাত নিরিবিলি এলাকায় প্রায় চুপ-চাপ অবস্থায় দিনযাপন করে আসছিলেন। ঐ সময়কালীন সময়ে অনেক মিডিয়া এবং বিএনপি দলীয় নেতা-কর্মী শত চেষ্টা করেও তারেক রহমানের সাক্ষাত পাননি কিংবা সক্ষম হননি। মরহুম কমর উদ্দিন জীবিত থাকাকালীন কেবলমাত্র কমর উদ্দিন এবং তার ঘনিষ্ঠ লোকজন তারেক রহমানের নিকটবর্তী হতে পেরেছিলেন। চিকিৎসকের শরণাপন্ন আর মেয়ে জাইমাকে নিয়ে মাঝে-মধ্যে শপিং ট্রিপ ছাড়া খুব কমই তারেক রহমান জনসমক্ষে এসেছেন। বলা যায়, তিনিই নিজেকে অনেকটা নেতা-কর্মী থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।
ইতিমধ্যে তারেক রহমান লন্ডনে এসাইলাম প্রাপ্তির খবর বিভিন্ন সংবাদ পত্রে ও মিডিয়ায় আলোচিত হয়েছে, যদিও স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী তারেক রহমানের এসাইলাম প্রাপ্তির সংবাদের সত্যতা মানতে রাজি নন। যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক স্থগিত কমিটির নেতা আব্দুল মালিক তারেক রহমানের এসাইলাম নেয়ার যৌক্তিকতা না থাকার পেছনে বেশ নাতি-দীর্ঘ রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন ইতিমধ্যেই বাংলা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
এমনি অবস্থায়, গত কিছুদিন আগে সপরিবারে তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে সৌদি আরব গমন করেন, সেখানে মহানবী সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারক জেয়ারত ও ওমরাহ পালন করেন। লন্ডনের ফিরে আসার প্রাক্কালে প্রথমবারের মতো সৌদি আরব বিএনপির প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখার সচিত্র সংবাদ দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। আর মূলত: ওমরাহ পালনের মধ্য দিয়েই তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতিতে তার সক্রিয়তার জানান দিয়েছিলেন বলেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। কেননা, তারেক রহমানকে কাছে থেকে যারা পর্যবেক্ষণ করে আসছেন, তারা সকলেই একমত যে, তারেক মূলত এক নির্দিষ্ট ছক বা প্ল্যান-প্রোগ্রামের ভিতর দিয়ে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত। ইতিমধ্যে অসুস্থতার সুযোগে তারেক রহমান নিজের রাজনৈতিক কর্ম-পরিকল্পনার এক ডায়াগ্রাম করে নিয়েছেন, আর যার ফলশ্রুতিস্বরূপ ধীরে ধীরে নিজেকে রাজনীতির পাদ-প্রদীপে আবার উপস্থাপন করতে আছেন বলে বাংলা মিডিয়া সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গভীর রাতের সভায় তারেক রহমান বলেনঃ-
সোমবার আর্লি আওয়ারে তারেক রহমানের সভায় কিছুটা বিশৃংখলা হলেও শেষাবধি পাল্ম ট্রি রেস্তোরাতে অত্যন্ত প্রাণবন্ত আলোচনার মাধ্যমে বিএনপির লন্ডনের এই সভা শেষ হয়। গভীর রাত অবধি চলা এ সভায় যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের বক্তব্য অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তিনি শুনেন।উপস্থিত সকল নেতৃবৃন্দকে বক্তব্যের সুযোগ দেন। তাদের বক্তব্যের নোট তারেক রহমান লিখে নেন।রাত এগারোটায় রেফরেশম্যান্টের বিরতি দিয়ে আনুমানিক দেড়টা অবধি সভার কাজ চলে।
বিএনপির সিনিয়র নেতা শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভা যৌথভাবে পরিচালনা করেন আব্দুল কাইয়ূম ও ফেরদৌস আলম।
সভায় তারেক রহমান প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রশ্ন রাখেন, রাতের অন্ধকারে বাতি নিভিয়ে শাপলা চত্বরের সমাবেশে অভিযান-এ কোন গণতন্ত্র ? উপস্থিত আমার দেশের সিনিয়র সাংবাদিক ওয়ালি উল্লাহ নোমানের কাছে তারেক জানতে চান গত পাঁচ বছরে কতোজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।জবাবে নোমান জানালে তারেক রহমান বলেন ২৫জন সাংবাদিক নিহত হয়েছে এই সরকারের আমলে।
জাতির এই ক্রান্তিকাল অতিক্রমের কথা উল্লেখ করে তিনি বিএনপির সকল নেতা-কর্মীকে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানান।
আধঘণ্টার মতো সময় তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন, এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। তারেক রহমান আরো বলেন, জনগণের প্রয়োজনে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির জন্ম হয়েছিলো। বাংলাদেশের এই দুঃসময়ে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত, বাক-স্বাধীনতা নিরাপদ ও ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিএনপিকে ও এর অগণিত নেতা-কর্মীকে জনগণকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
তারেক রহমান সভায় সকল নেতা-কর্মীকে আশ্বস্থ করেন, সকলের পরামর্শ মতোই যুক্তরাজ্য বিএনপির শক্তিশালী কমিটি গঠণ করা হবে। উপস্থিত অনেক নেতা-কর্মী তারেক রহমানের বক্তব্যে সন্তোষ প্রকাশ এবং সভা শেষে দলীয় নেতৃবৃন্দকে বেশ উৎফুল্ল ও প্রাণচঞ্চল দেখা যায়। অনেকেই দীর্ঘদিন পর যুক্তরাজ্য বিএনপি প্রাণ ফিরে পেয়েছে বলে মন্তব্য করতে শুনা যায়।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দলের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মহিদুর রহমান, বাতিল কৃত আহবায়ক কমিটির আহবায়ক এম এ মালিক, যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এ সালাম, এনামুল হক লিটন, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মল্লিক হোসাইন আহমেদ হাসনু, নাসিম চৌধুরী, কয়সর আহমেদ, জমিলুল হক, ফয়সল আহমেদ, এম লুৎফুর মোশাহিদ হোসেইন ও এম জাহেদ আলী প্রমুখ।
উল্লেখ্য ব্রিটেনে আশ্রয় নেয়া দৈনিক আমার দেশের সিনিয়র সাংবাদিক ওয়ালি উল্লাহ নোমান এসময় উপস্থিত ছিলেন।
Salim932@googlemail.com
20th May 2013.UK