তারপরেও দুই নেত্রী কি কোন যাদুর বাক্স খুলে দিবেন
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
নব্বই-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর এবং বিশেষ করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ামক শক্তি দুই নেত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া এবং তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-পথ ( বিশেষত: নব্বই-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর-অথচ সেই স্বৈরাচার এখন গণতন্ত্রের নিয়ামক শক্তি) ওলট-পালট করে দিতে কিংবা রাজনীতির উত্থান-পতন এর সাথে দুই নেত্রীর সাথে এই দুই দল আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি-র দ্বারা সম্ভব, এতে সকলেই ( নিতান্ত কট্টর বাম তাত্ত্বিক ব্যতীত ) একবাক্যে একমত পোষণ করবেন। যে কারণে ১৯৯০ সালের পর থেকে মন্দের ভালো হলেও আপামর জনতা ঘুরে ফিরে এই দুই দলের এবং তাদের নেত্রীদের দ্বারা পরিচালিত গণতান্ত্রিক শাসনের আদলে নির্বাচিত একব্যক্তির শাসন মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের আপামর জনগণ ধরেই নিয়েছে, এই দুই দলের শাসন ব্যতীত বাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনের আর কেউ নেই, নিকট ভবিষ্যতে আসারও সম্ভাবনা নেই। সে কারণে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর-অন্তর ভোটের রাজনীতির উৎসব আমেজে বাঙালি এই দুই নেত্রীর একজনকে বেছে নিয়ে থাকে এবং মুখ বুঝে ক্রমান্বয়ে এই দুই দলের তাণ্ডব, লুট-পাট, খুনাখুনি, হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, জ্বালাও-পোড়াও সবই মেনে নিয়ে যাপিত জীবন চালাচ্ছে।
মজার ব্যাপার হলো ১৯৯০ সালের পর থেকেই দৃশ্যত এই দুই দলের ঐক্য এবং অবশ্যই তাদের এই দুই নেত্রীর সমঝোতা ও ঐক্যের উপর ভর করেই এখন পর্যন্ত শত-দুর্যোগ স্বত্বেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং এই দেশ আস্তে-ধীরে এগিয়ে চলছে। মাঝখানে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পরেও সংসদের লাল ইটের ঘরের দুই বাসিন্দা এই দুই নেত্রী নিজেদের রান্না করা খাবার একে অন্যকে খাইয়ে সমঝোতার ও সহনশীলতার মাত্রাকে চাঙ্গা করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে ১/১১র ভয়াবহতার পরেও জাতি পেয়েছিলো একটি সাধারণ নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলো। এর আগে তাদের পক্ষের দূতিয়ালি করতে গিয়ে দুই প্রয়াত মহাসচিবের নিষ্ফল সংলাপ যেমন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে, একই সাথে রাস্তায় খুনাখুনি, ককটেল, গুলি, লঘি-বৈঠার তাণ্ডব সবই দেখেছে, দুই নেত্রীও দেখেছেন, উপভোগও করেছেন।
কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, এতো রক্ত, এতো শহীদ ( ময়েজ উদ্দিন, তিতাস, দীপালী শাহা, কাঞ্চন, সেলিম-দেলোয়ার, শাহজাহান সিরাজ, জেহাদ, নুর হোসেন, ডাঃ মিলন) এর বুকের তাজা রক্তের পরেও আমাদের দুই নেত্রীর রাজনৈতিক জিঘাংসা চরিতার্থ হচ্ছেনা ? শহীদের লিস্ট যদি করা হয়, তার দীর্ঘতা এতো ব্যাপক হবে যে, প্রমত্ত পদ্মা কিংবা বুড়িগঙ্গার পানি শুকিয়ে যাবে, শহীদের লিস্ট কিন্তু শেষ হবেনা। তাদের ঐ রাজনৈতিক অসহিঞ্চু রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এখনো কতো যে লাশ রাজপথে পড়বে, কতো মায়ের বুক যে খালি হবে, আরো কতো বোন যে বিধবা হবেন , তা কেবল সময়ই বলে দিবে। তবুও দুই নেত্রীর উন্মত্ত রাজনৈতিক জিঘাংসা চরিতার্থ হবে কিনা সন্দেহ। এখানে দুই নেত্রীর কোন সমালোচনা করার জন্যে এই লেখার অবতারণা করা হচ্ছেনা। কেননা, বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতায় এই দুই দল এবং তাদের দুই নেত্রী যেমন একথাটি জানেন, জনগণও জানেন। আর এই জানেন- বলেই বাংলাদেশে সংলাপের মতো সর্বজন স্বীকৃত, গ্রহণ যোগ্য, সভ্য, উন্নত, সর্ব কালের জন্য আধুনিক এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তারা এবং তাদের অনুসারীরা হাটতে অভ্যস্ত নন- একথা বারে বার তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে বহুবার প্রমাণ করে দিয়েছেন। তারপরেও আপামর জনগণ, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক সহ সকলেই কায়-মনোবাক্যে দুটি দল এবং দুই নেত্রীর সংলাপের নানা পথ, পন্থা, পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। এ যেন শেক্স পিয়রের রোমিও-জুলিয়েটের সেই though brutus (you too)-র মতো, ঐ যে আমিই বড়, আমি কি কম বুঝি- এই ইগো আর দাম্ভিকতায় জনগণের ত্রাহি অবস্থা।
আর এই অবস্থা, ঘটনা, নাটক, আর রাজনৈতিক জগরা-ফ্যাসাদে দেশের এখন বারোটা বেজে চলেছে। বর্তমানে দেশের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেও এখনো ডঃ আকবর আলী, ডঃ শাহদীন মালিক, ডঃ এমাজ উদ্দিন, ডঃ মাহফুজ উল্লাহ সহ কেউ কেউ নিভু নিভু বাতির মধ্যেও আশার আলো খুঁজে বেড়ান। আবার ডঃ তালুকদার মণিরুজ্জামান, ডঃ আসিফ নজরুল সহ অনেকেই প্রকাশ্যে এর থেকে পরিত্রাণের সহসা কোন পথ দেখছেননা । যুক্তির কষ্টি পাথরে দু-দলই আমার কাছে সমান মূল্যবান।
এটা ঠিক বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সহিংসতা আর সংকট শুরু হয়েছে, তা ক্রমেই আরো হিংস্র এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, সন্দেহ নেই। আর দুই নেত্রীর কাছে এখন আর আলাদীনের প্রদীপ কিংবা অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ইউএন-এর বিশেষ সেশনে উল্লেখিত “ম্যাজিক অর্থনীতির” এই দেশে এমন কোন ম্যাজিক দেখিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব- সেটা এখন সুদূর পরাহত। কেননা দুই নেত্রী যখন বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তখন বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক গুটির চাল তাদের নাগালের অনেক বাইরে চলে গেছে। ৯০-র দশকের পর দুই দল এবং দুই নেত্রী এ রকম রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের মধ্যে পড়েছেন বলে দৃশ্যত কারো কাছে মনে হচ্ছেনা। এই মুহূর্তে দুই নেত্রী চাইলেও সংলাপ করে সমাধানের মতো সহজ কোন পন্থা আবিষ্কার করতে পারবেন বলে মনে হয়না। কেননা যে আগুন, যে দণ্ড-মুণ্ড নিয়ে নিজেরা খেলেছেন, রাজনীতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, আপাত: দৃষ্টে নিজেদের অনুকূলে এবং নিয়ন্ত্রণে মনে হলেও কার্যত দুই নেত্রীর কাছে এখন আর কোন নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয়না। এই মুহূর্তে দুই নেত্রী সব ইগো ফেলে দিয়ে একে অন্যকে টেলিফোন, কিংবা আগ বাড়িয়ে সংলাপের আহ্বান খুব একটা ফলদায়ক যে হবে, সে রকম মনে করার কোন কারণ নেই।
তবে নাটকীয় এবং সম্ভাবনাময় এক সমঝোতার দোয়ার খুলে দিয়েছে, সাভারের মর্মান্তিক ট্রাজেডি। অভিশপ্ত রানা প্লাজার লাশের স্তুপ এবং দুই নেত্রীর মানবিক জ্ঞান বেশ নাটকীয়ভাবে জেনে জেগে উঠেছে। আপাতঃ দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়ার মাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি সরাসরি আলোচনা বা সংলাপের আহবান- বলা যায় বাংলাদেশের রাজনীতির বন্ধ দুয়ার অনেকটাই খুলে দিয়েছে। যার ইতিবাচক সাড়া হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আহবানে বিরোধীনেত্রীর হরতাল পরিবর্তন বা স্থগিত কিংবা প্রত্যাহার- সকলেই বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামীলীগের সৈয়দ আশারাফ এবং বিএনপির সামসুজ্জামান দুদু বেশ আশাব্যঞ্জক বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন।সারা বাংলাদেশের লাখো-কোটি জনগণের সাথে ডঃ ইমতিয়াজ সহ অনেকেই রাজনীতির ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক এবং দুই নেত্রী নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, সাভারের মতো ট্রাজেডি যাতে আর না ঘটে, দুই নেত্রীর রাজনীতির সাথে চিরন্তন মানবিক গুণ জেগে উঠলে দেশ এবং জাতি অবশই এই ধরনের অমানবিক হত্যাকান্ড থেকে রক্ষা পেতে পারে, যেহেতু এরাই দেশের হর্তা-কর্তা, সুতরাং তাদেরকেইতো আগাম সব ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে ৫ তারিখের অবরোধ নিয়ে হেফাজত বেশ অনড় অবস্থায় রয়েছে। যদিও হেফাজতের ৫ তারিখের এই কর্মসূচী পূর্ব ঘোষিত, তথাপি সাভারের ট্রাজেডি গোটা বাংলাদেশকে করে তুলেছে এক একটি লাশে পাহাড়ের ধবংসস্তুপে, আর এই অবস্থায় হেফাজতের ৫ তারিখের কর্মসূচী ঠিক কতটা বাস্তব ও মানবিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য, তাতে যেমন রয়েছে অনেক প্রশ্ন, একই সাথে বাংলাদেশের ক্ষত-বিক্ষত এবং শোকাহত হ্রদয়কে আরো ক্ষত-বিক্ষত ও বিধবস্ত করার মধ্য দিয়ে এই সময়ে এই রকম কর্মসূচী কতোটুকু সুচিন্তিত, সেটাও একটা বিরাট বিষয়। তারপরেও হেফাজতের ৫ তারিখের কর্মসূচী নিয়ে রয়েছে অনেক উত্তেজনা, কেননা আগামীর ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতের ভাগের অংশীদার দুই নেত্রী সমানভাবে নেয়ার জন্য তৎপর দেখে গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক সুন্দর বাংলাদেশ আঁতকে না উঠে পারেনি। আর সরকারের শেষ সময়ের হিসেবে প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগ সন্ধানী আর বঞ্চিতরা, একই সাথে পুলিশ সহ সকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের নিজেদের সুযোগের সদ্ব্যবহার সকলেই যে নিবে-এটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে। আর তা মূলত দুই নেত্রীর অদূর দর্শিতা থেকেই সৃষ্টি। কেননা ১৫ বছরের মতো গণতন্ত্রের বয়স হতে চলেছে, অথচ ক্ষমতা হস্তান্তরের সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা এখনো আবিষ্কৃত করতে ব্যর্থতার পরিচয় শুধু দেননি, গণতান্ত্রিক ইন্সটিটিউশন গুলোকে কার্যত আরো পঙ্গু এবং ডিস-এবল কি করে করা যায়-বিগত সময় ধরে সেই সব কাজে নিজেদের পারঙ্গমতা বেশ কৃতিত্বের সাথেই দেখিয়েছেন। তারপরেও আশা থেকে যায়, কারণ মানুষ এবং মানবতা আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। আমাদের মাননীয় দুই নেত্রী কি একটু এগিয়ে এসে এমন কোন ম্যাজিকের বাক্স জাতির সামনে খুলে দিবেন, যাতে বাংলাদেশে যে উন্মত্ততা, হানাহানি, সহিংসতা, খুনাখুনি, আর প্রকাশ্য অরাজনৈতিকসূলভ হুমকি-ধমকি, দেশ অচল করে দেয়া, আরেকটি ভুজপুরের জন্ম দেয়া, এই সব জংলী কর্মকাণ্ড অনতিবিলম্বে বন্ধ করে জনগণের জান-মালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানের নিশ্চিত ব্যবস্থা করবেন- ঘুম থেকে উঠে সব কিছু একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে তড়িৎ বাস্তব(বাতাসী, বায়বীয় নয়)পদক্ষেপ নিবেন- এমন আশা-ই এখনো হাজারো নিরন্ন জনগণের সাথে আমিও করি।
Salim932@googlemail.com
৩রা মে ২০১৩