০১) দুই খ্যাতিমান পুরুষ, পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত যেখানেই যাওয়া যায়, এই দুই বঙ্গ সন্তানের নাম-ডাক-কদর এতো বেশী যে শত দুঃখ, কষ্ট, হতাশার মাঝেও গর্বে বুকটা তখন অনেক উঁচুতে উঠে যায়। বলা যায়, রাজনীতির পাঠশালায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের পরে এবং তারও আগে বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া হয়ে বিশ্ব দরবারে মার্কিন মুল্লুক, সারা বিশ্বের জ্ঞানের আধার হার্ভার্ড, একসময়ের সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের রাজা-রাণী ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট স্কোয়ার, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আমাদের পাশের দেশ সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, ভারত-হেন কোন দেশ নেই, যেখানে আমাদের এই সোনার টুকরো এই সন্তানকে সম্মানের আসনে না বসানো হয়নি।
সাম্প্রতিক কালের সারা বিশ্বের প্রায় সব কটা প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, মানুষের আড্ডায়, আর সামাজিক সকল নেটওয়ার্ক ফেসবুক, টুইটার, গোগল প্লাস সর্বত্র বলতে গেলে এক বিশাল অংশ দখল করে আছে আমাদের এই গরীব দেশের সোনার ছেলে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বলয়, অবস্থা, ক্রমাগত বিবর্তন, এমনকি সাহিত্য, নোবেল, নাটক, রাজনৈতিক ক্যারিশমা সবই একাট্টা করে একের পর এক পর্যালোচনা করেও আমাদের এই সোনার টুকরো ছেলেটির মতো বিশ্ব দরবারে এতো জনপ্রিয়, এতো নন্দিত, এতো আহ্লাদিত, দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাওয়া যায়না। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী, নজরুলের আমি বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, শরৎ চন্দ্র, সুকান্ত, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, আজকের তিব্বতের দালালাই লামা, মায়ানমারের অং সান সূচী, কোরিয়ার কিম ইল জং, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণো সব কিছুকেই অসম্ভব এক সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক থিওরি স্টাডি দিয়ে পেছনে ফেলে খেটে খাওয়া, খরা-বন্যা-ঝড়, টর্নেডো,সাইক্লোন,সিডর, আর হরতাল-জ্বালাও-পোড়াও এর বাংলাদেশ ও বাঙালিকে বিশাল এক উঁচুতে নিয়ে গেছেন, সারা বিশ্ব জাগানো এক ব্যক্তিত্ব আমাদের এই জুপরা গ্রামের সন্তান আর ঢাকার গ্রামীণের নোবেল লরিয়েট ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস-
একথা এক বাক্যে সারা বিশ্ব থেকে স্বীকার করা হচ্ছে। এমনকি ইউনুসের কট্টর সমালোচক ( সে নরওয়ে হউক আর স্বদেশে হউক) পর্যন্ত আবডালে-গোপনে একথা নিজদের অকপটে স্বীকার করে নেন।
ইউনুসের সব চাইতে বড় যে ক্যারিশমা, আর যার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে একের পর এক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করেও হানাহানি-বিদ্বেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার ভাগাভাগির রাজনীতিতে জগরা-ফ্যাসাদ প্রতিনিয়ত করে রাষ্ট্র-ক্ষমতায় বেশ আরামের সাথেই করে যাচ্ছেন, সেই বাঙালির অর্ধেক জনগোষ্ঠীরও বেশী ভোটার নারী সমাজের সবচাইতে প্রান্তিক, খেটে খাওয়া,নিরন্ন, অবহেলিত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-বিত্তের একটু নীচের নারী সমাজের সাড়ে তিনকোটি মহিলাকে কর্মক্ষম করে দেশের অর্থনীতির গতি প্রবাহে প্রবাসী রেমিটেন্সের সাথে সমান্তরালভাবে দেশের ভিতরে যে রক্তনালীর প্রাণ-চাঞ্চল্য চালু রেখেছেন, যা থেকে আজকে শত ভুল-ভ্রান্তি থাকুক না কেন- এই অবদানকে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবেনা। আজকের বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার দিকে একটু যত্নের সাথে তাকালেই যে কেউ সহজে উপলব্ধি করতে পারবেন, সেদিন জুবরা গ্রাম থেকে একজন ইউনূস যদি এমন নীরব বিপ্লবের সূচনা না করতেন, তবে একমাত্র আল্লাহই ভালো করে জানেন, আজকের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, একই সাথে লাখো লাখো তরুণ বেকার, সেই সাথে অনুৎপাদনশীল খাতের বাড়তি আর আজকের চরম অসহিঞ্চু রাজনৈতিক দ্বন্ধ-সংঘাতের সাথে একেবারে কম করে হলেও ঐ সাড়ে তিন কোটি নিরন্ন-অসহায় হাত ( তাদের সাথে পরিবার +) যুক্ত হয়ে কি যে এক ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করতো- প্রিয় পাঠক একটু করে হলেও চিন্তা করে দেখুন। ইউনূসের এবং ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের হাজারো দুষ-ত্রুটি খোঁজার আগে আমাদেরকে অতীতের সাথে বর্তমানের সাযুজ্য যুতসই ভাবে মিলিয়ে নেয়াই অধিক যুক্তি সঙ্গত । আর ইউনুস মূলত এই অসম্ভব এক নীরব বিপ্লবী কাজ সফলতার সাথে করার সাথে সাথে নিজের কর্ম, মেধা আর যোগ্যতার বলে সারা বিশ্বের দরবারে নিজের উদ্ভাবিত শক্তি, কর্ম নিয়ে এমন করে আলোড়ন তুলে চলেছেন, বিশ্বের যেই প্রান্তে ইউনুস যাচ্ছেন, সেখানেই শুধু সমাদৃত হননি, ইউনুস প্রদর্শিত গ্রামীণ থিওরি আর সামাজিক ব্যবসা গৃহীত হয়ে লাভবান হওয়ার নানা স্বীকৃতি মিলছে। আর এখানেই আমাদের গ্রামীণের ইউনুস হয়ে যান সারা বিশ্বের উঁচু স্তরের এক বাঙালি গ্রামীণ ইউনুস, এখানেই ইউনুসের বড় সার্থকতা।
সারা বিশ্বে গ্রামীণের চেক পরিধান করে ইউনূস বাংলা মাকে আরো অপরূপ রূপে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছেন। অথচ নিজ দেশে এই অসাধারণ এক গুণী ব্যক্তিত্ব হয়ে যান চরম অবহেলিত, নানা দুষে দুষ্ট, সমালোচনার তীরে আবদ্ধ। এতে ইউনূস যেমন কষ্ট পান, শত কষ্টে জর্জরিত হতশ্রী, খরা-বন্যার দুর্গতি লাগানো বাংলা মাও কষ্ট পায়। ইউনূস যেমন সেই কষ্ট অতি যত্নের সাথে বুকে লালন করে সারা বিশ্বে বাংলা মায়ের চেক দূতিয়ালি করে ঘুরে বেড়ান, আমাদের এই চিরন্তন জসীম উদ্দিনের রূপসী বাংলাও বুকে একরাশ কষ্ট চেপে ইউনুসের জন্য সকল দরদ লালন করে চলে।
শত কষ্ট, শত ঝড়-ঝঞ্ঝা-বিক্ষোভের পর ক্ষুদিরামের বাংলা মা যেভাবে জেগে উঠে বারে বার, ইউনূসও শত লাঞ্ছনা, শত বঞ্চনার পরেও বীরের বেশে বিশ্ব দরবার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসেন সব চাইতে উঁচু দরের উচ্চতম পুরস্কার- যেখান থেকে কেউই সেই উচুতাকে স্পর্শ করে আর টেনে-টুনে নীচে নামাতে পারেনা। জয়তু বাঙালির শত সহস্র ভালোবাসায় প্রিয় ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস, বাঙালির চির অম্লান ভালোবাসা তোমার জন্যে।
০২) ইউনূস যেভাবে দেশের মধ্যে অবহেলিত, অপমানিত , নানাভাবে সমালোচিত, একই ভাবে যে মানুষটি জীবনের সকল সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, মাটির পৃথিবীর এই ভালোবাসা, ভোগ-লালসা সব কিছু ছেড়ে দিয়ে একেবারে সন্ন্যাসীর মতো জীবন-যাপন করে, নিজের জীবন যৌবন, তারুণ্য, প্রৌঢ়ত্য সব কিছুই দেশ, মাটি ও এর জনগণের জন্য বিলিয়ে দিলো, বাঙালি জাতিকে পৃথিবী নামক এই মানচিত্রের মধ্যে পৃথক এক স্বাধীন-স্বত্বা বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের হাজারো-লাখো কোটি তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী,যুবা-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আবাল বণিতাকে অসম্ভব এক সঞ্জীবনী শক্তির মাধ্যমে সমমনাদের সহযোগিতায় জাগিয়ে তুলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটালো, স্বাধীন বাংলাদেশের সেই রূপকার, স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসে প্রতিষ্ঠাতা,৬২ ছাত্র আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা, বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি কিভাবে সকল মানুষের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে একুশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, রাষ্ট্র দার্শনিক- সেই সিরাজুল আলম খান-
সকলের কাছে যিনি দাদা নামে খ্যাত, ইউনুসের মতো বাঙালির জীবন্ত আরো এক কিংবদন্তী নিজ দেশে বড় অবহেলিত, উপেক্ষিত, বলা যায় সব কিছুর অন্তরালে নীরবে-নিভৃতে শেষ জীবনের প্রান্তে এসে, শেষ ক্ষণিকের জন্য যেন অপেক্ষমাণ শেষ ট্রেনের যাত্রী হয়ে আছেন। যে লোকটি তার জীবনের সমস্তকালই বলা যায় বাঙালির জন্য অকাতরে ঢেলে দিলো, ৭ই মার্চের শেখ মুজিবের জবানীতে এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম যুক্ত করে দিলো, বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটির জাতীয় পতাকা নির্ধারণ, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ, ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বট তলায় আ স ম আবদুর রব কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য বিএলএফ গঠন, মুজিব বাহিনী গঠন সহ ঐতিহাসিক সকল কর্মকাণ্ড নিউক্লিয়াস এবং সিরাজুল আলম খান-দাদার মাধ্যমে সংগঠিত হলো- অথচ আফসো্স, সভ্যতার নির্মম পরিহাস, বাঙালি এবং বাংলাদেশে সেই মানুষটি বড় উপেক্ষিত, রাষ্ট্রীয় সামান্য সৌজন্যতাটুকু থেকেও বঞ্চিত। অথচ সিরাজুল আলম খান মুক্তিসংগ্রামের অকুতোভয় বীর সেনানীই শুধু নন, একজন পলিটিক্যাল থিয়োরিস্ট হিসেবে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইনকনসন বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সাইন্টিস্ট ডঃ জিল্লুর রহমান খানের সাথে মিলে পার্টিসিপেটরী ডেমোক্রেসীর উপর যে থিওরি প্রকাশ করেন-যা পরবর্তীতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মডেল নামে বর্ধিত কলেবরে প্রকাশ করে রাজনীতি বিজ্ঞানের জগতে এক আলোড়ন তুলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাকে সিরাজুল আলম খান মনে করেন অবশ্যম্ভাবী, এবং তা থেকেই আজকের সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বাংলাদেশের অকুতোভয় এই সৈনিক আজ অসুস্থ অবস্থায় ল্যাব-এইড হাসপাতালে। দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত, সু-হ্রদ সিরাজুল আলম খানের খবর নিলেও আমাদের রাষ্ট্র-যন্ত্র যেন এব্যাপারে একেবারে নীরব-নিশ্চুপ। জীবিত অবস্থায় সিরাজুল আলম খানের স্বীকৃতি যেন ভয়াবহ এক পাপ কাজ হয়ে যাবে- আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্রের এমনি এক ভাব, সূচী বায়ু। অথচ এই লোকটি নিজের জীবন-মান-মর্যাদার দিকে না চেয়ে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ধীরে ধীরে আওয়ামীলীগের শীর্ষের মধ্য মণি করে রেখে দিয়ে স্বাধীন বাংলার পূর্ণ রূপ-রেখা বাস্তবায়িত করে, যার ফলে আজকের বাংলাদেশ।
পৃথিবীতে এমন একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যে তার বীরদের সম্মান করেনা, তার গুণীদের কদর করেনা, এমন জাতি শত চেষ্টা করে মেলা ভার। আমরাই কেবল অসম্ভব ব্যতিক্রম এক জাতি, যে তার গুণী সন্তানদের কদর করা দূরে থাকুক, তাদেরকে অযত্নে-অবহেলায়-অপমানে লাঞ্ছিত করার সব ব্যবস্থাই করে ফেলি। যে জাতি তার জ্ঞানী-গুণীদের কদর করেনা, সে জাতি বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনা।
আমাদের সব চাইতে আরো এক মুদ্রা দুষ হলো, আমরা যেমন অহেতুক খুঁত এবং সমালোচনা করতে জানি, একই সাথে জাতীয় বীর আর খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিদের মৃত্যুর পরে আমরা তাকে মেডেল, উপঢৌকন, উপাধি, আর জাতীয়ভাবে সম্মান দেয়ার জন্য উঠে-পরে লেগে থাকি, আমাদের মধ্যে তীব্র এক প্রতিযোগিতা তখন শুরু হয়ে যায়, মৃত ব্যক্তিকে কে কতো আগে-ভাগে, কতো ব্যাপক ভাবে সম্মানিত করতে পারি। এটা যে খারাপ তা বলছিনা, কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি, জীবিত অবস্থায় একটি রাষ্ট্রীয় সম্মান ঐ ব্যক্তিকে যতটুকু সান্ত্বনা দিতো, মৃত্যুর পরে তার চেয়ে হাজার গুণ বড় পুরস্কার কি তাকে স্পর্শ করতে পারে ? আমরা কি একবারের জন্য হলেও জাতির এই সব ক্ষণজন্মা বীর সন্তান আর বিশ্ব কাঁপানো গুণীদের জীবিত অবস্থায় যথাযথ সম্মান দিতে পারিনা ? কারণ আজকে আমি যদি গুণীর কদর করি, তবেইতো কাল আমার প্রজন্ম আমার কদর করবে।
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
Salim932@googlemail.com
23rd April 2013,UK.