শাহবাগের নয়া-জাগরণ, আইনীভাবনা ও একটি ঐকান্তিক চাওয়া
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
০১) প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন যখন একের পর সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, দলে দলে লোক শাহবাগ চত্বরে এসে সমবেত হতে থাকেন, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যখন সংহতি প্রকাশ করতে থাকেন, শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ছড়িয়ে শুধুর নিউইউয়র্ক, লন্ডন, সূইডেন, ইতালি, লুক্সেমবার্গ সহ যেখানেই বাংলা ভাষা-বাসী, সেখানেই শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর হয়ে উঠে এক একটি জ্বলজ্বলে বাংলাদেশ।শুক্রবারের লাখো লোকের সমাবেশ থেকে ঘোষিত হয়েছে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত শপথ, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, বান্দরবন থেকে বাহাদুরাবাদ সর্বত্র প্রজন্ম চত্বরের এই নয়া মুক্তির সংগ্রাম ( ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ )কে ছড়িয়ে দেয়ার অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে। শাহবাগের এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সকল বাঙালিকে এমনভাবে আকৃষ্ট ও আবেগে-আপ্লুত করেছে, শুধুর লন্ডনের ঠাণ্ডা বৈরি হাওয়া উপেক্ষা করে হাজারো বাঙালি তরুণ-তরুণী শাহবাগের শত-সহস্র প্রাণের সাথে একাকার হতে ছুটে চলে অযুত শহীদের অম্লান প্রতীক আর লাল-সবুঝের নিরন্তর প্রাণের ভালোবাসার নাম আলতাব আলীর শহীদ স্মৃতি স্তম্বের পাদদেশে।বাঙালি আজ যেন হাজার বছর পর তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ১৯৭১ এর পর বাঙালি আবার জেগে উঠেছে সকল অন্যায়, অবিচার ও মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সকল ঘৃণা আর ধিক্কার জানাতে। যেখানেই বাঙালি সেখানেই আজ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আর প্রজন্ম চত্বরের সাথে সংহতি। বাঙ্গালির এই নয়া জাগরণ জানান দিয়ে যায় বাঙালির হাজার বছরের অতীত ঐতিহ্য আর গৌরবময় ইতিহাসের কথা।সেই মোঘল আমল, পাল আমল থেকে ধীরে ধীরে সেই যে শুরু, যা ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনে বাঙালি গর্জে উঠেছিলো, ১৯৭১ এ এসে সেই গর্জন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব গর্ব ভরে জানান দিয়ে দিলো- যা অনেকের কাছে শুরুতে ছিলো কল্পনারও বাইরে। কিন্তু বাঙালি বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন ইতিহাস রচনা করে জানিয়ে দিলো বাঙালি পারেনা তাবৎ দুনিয়ায় এমন কিছু নেই। আমাদের এই শক্তি আর ঐতিহ্যের প্রতি তাই বড় শ্রদ্ধা আর মমত্ব খুঁজে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল হয়ে আজকের অধুনিক সাহিত্য সভার নামকরা সকল পণ্ডিত ও বোদ্ধাদের সাহিত্য কর্মে।
বাঙালির এই এতো সব অর্জন ও নয়া নয়া জাগরণ রাজনৈতিক কূট-কৌশলের বেড়া জালে পড়ে বারে বার হূচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার ইতিহাসও কিন্তু কম নয়। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের নয়া প্রজন্মের ( ছাত্র-ছাত্রীদের) রাজ-পথ রক্তে রঞ্জিতের সফল ইতিহাস যা বাংলা ভাষাকে করে প্রতিষ্ঠিত, তার পরে ১৯৭১ সালে একই নয়া প্রজন্ম (বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী, বাঙালি পেশাজীবী, বাঙালি সাংবাদিক, বাঙালি সৈনিক, বাঙালি পুলিশ, আনসার, বিডিআর, বাঙালি শিল্পী, বাঙালি তরুণ ইত্যাদি সকলেই)নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়- এই দুই সফল ইতিহাস বাদ দিলে বাঙালি তরুণ প্রজন্মের গড়ে উঠা বিপ্লব, আন্দোলন রাজনৈতিক বেড়া জালে পড়ে মাঝপথে হাইজ্যাক, হারিয়ে যাওয়া, নস্যাৎ হওয়া কিংবা অসমাপ্ত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি এবং এর অধিবাসী সকল বাঙালি জনগণের কপালে এখনো অনেক দুর্যোগ ও দুর্ভোগ রয়ে গেছে, আর তা যেমন রাজনৈতিক ভাবে সত্যি, একইভাবে অর্থনৈতিক ভাবে সত্যি, প্রযুক্তিগত ভাবে এবং কৃষ্টি ও সংস্কৃতিগতভাবে সমানভাবে সত্যি। এখানে কারো কোন দ্বি-মতের কোন অবকাশ নেই। দ্বি-মত করতে পারেন অনেকেই, কারণ তারা বাঙালির আজন্ম লালিত স্বপ্নের সঠিকতার ধারণ করেননা। আর এই শ্রেণীর সাথে অহেতুক তর্ক করে অযথা সময় ও তর্কের কলেবর বৃদ্ধি করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই।
শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের এই আন্দোলন আজকের নয়া প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উজ্জীবিত এবং বলা যায় তা গোটা বাংলাদেশে ঐ একই স্বতঃর্স্ফুর্ততারই বহিঃপ্রকাশ।এখানে কোন ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা লুটার বা রাজনীতিকীকরনের সামান্যতম চেষ্টা এই সময়ের তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার পীঠে শুধু ছুরিকাঘাতই হবেনা, তরুণ প্রজন্মের দ্বারা গড়ে উঠা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গোটা বাংলাদেশ ও সারা পৃথিবীর বাঙালির ঐক্যকে অতীতের মতো গড়ে উঠা ঐক্যকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিয়ে গোটা বাংলাদেশে আবারো সাম্প্রদায়িক অপ-রাজনীতির বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করা হবে। তাই মানবতার স্বার্থে সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের কাছে সনির্বন্ধ নিবেদন, দয়া করে প্রজন্ম চত্বরের এই ঐক্য আর বাঙালির এই নব-জাগরণকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে সহায়তা করবেন, কোন ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা অন্তত স্বাধীনতার পর জেগে উঠা বাঙালির এই ঐক্যের প্রতি একবারের জন্য হলে আপনাদের ঐ অপ-রাজনীতি থেকে দূরে রাখবেন আশা করি। আমার এই আবেদন এই কারণে যে, কোন কোন মাধ্যম ইতিমধ্যে প্রজন্ম চত্বরের এই জাগরণকে রাজনীতিকীকরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টায় সক্রিয়। কোন কোন রাজনৈতিক নেতা তির্যক মন্তব্য ও সতর্ক মন্তব্য করে প্রজন্ম চত্বরের জাগরণকে ভিন্ন প্রশ্নের আধারে ঢেকে দিতে চাচ্ছেন। আমাদের সবচাইতে বড় দুঃখ, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের এই সব নেতা-নেত্রীরা তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার ও চাহিদার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দলবাজি আর পেশীবাজীর রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন। নয়া প্রজন্মের লাখো-কোটি তরুণের চাহিদা-মন-মনন বুঝতে এরা বড় অক্ষমতার ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিনিয়ত দুর্বৃত্তায়ন, ঠেন্ডারবাজী, দলবাজি, অস্রবাজী আর লুট-পাটের চিন্তা থাকলে তরুণ সমাজের মন-মনন-চিন্তা-ভাবনা ভাববার সময় তাদের কোথায় ? তাই আজকে যখন তরুণদের মাধ্যমে গড়ে উঠা জাতীয় এই জাগরণ হয়েছে, তাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের কোন ধরনের সামান্য চেষ্টা হবে গোটা বাঙালি ঐক্যকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার নামান্তর। আর এ রকম কোন কিছু করা হলে ইতিহাস আপনাদের কাউকে ক্ষমা করবেনা।
০২) কাদের মোল্লার রায় নিয়ে সৃষ্ট নয়া জাগরণ অন্য কোন জাগরণ বা বিশ্বের কোন অঞ্চলের জাগরণের সাথে তুলনীয় করাটাও এই মুহূর্তে যুক্তিসঙ্গত হবেনা। কারণ বিশ্বে আর কোথাও কোন আদালত এই রকমের কোন রায় প্রদান করেননি, যার ফলে এই ধরনের নতুন প্রজন্মের দ্বারা নয়া এক জাগরণের জন্ম হয়েছে এমন প্রমাণ বিশ্বের কোথাও নাই। বাঙালির এই জাগরণ সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য এবং আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। এটাকে একক এবং ইউনিক এক জাগরণ হিসেবে দেখাটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত হবে। কাদের মোল্লার রায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা অবশ্যই আলোচনার দাবী রাখে। যাদের ব্যর্থতার জন্য কিংবা যাদের সীমাহীন দুর্বলতা, অবহেলা আর অপ-রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশের ফলে এমন রায়-তা অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এতো বড় জাতীয় নব জাগরণ দেখার পরেও ক্ষমতাসীন দল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আইন পরিবর্তনের মতো প্রশ্ন-বোধক কাজের কথা যখন বলেন , তখন অবাক হয়ে যাই, এরা এখনো কোন কুম্ভরাজে বসবাস করছে? এরা এখনো এই জাগরণকে ধারণ কিংবা উপলব্ধি করতে এতোটাই ব্যর্থ যে, যার ফলে তারা এখন আইন সংশোধনের কথা বলছে। অথচ বাঙালির এই ইস্পাত কঠিন ঐক্যের দিকে সম্মান দেখিয়ে প্রসিকিউশনকে পরামর্শ দিতে পারে নতুন অভিযোগ দায়ের করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করতে, পাশা-পাশি অ্যাপিলের সুযোগ নিতে। কেননা, ট্রাইব্যুনালের আইনে শুধুমাত্র একটি (৬ টির মধ্যে ৫টি প্রমাণিত, ১টিতে খালাস)অভিযোগের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে এপিল করে কতোটুকু সফল হওয়া যাবে, তাতে বিজ্ঞ আইনজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মধ্যে যেমন রয়েছে সন্দেহ, একইভাবে এমন কোন আলাদীনের প্রদীপ কারো হাতে নেই যে নেহায়েত একটি মাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে নিশ্চিত এপিল জয়ের গ্যারান্টি কেউই দিতে পারবেনা। আর আদালত কখনো নয়া এই জাগরণ বিবেচনায় নিবেনা বা নিতে পারেনা, আদালত দেখবে আইন, সাক্ষ্য, প্রমাণ, এভিডেন্স- যা প্রমাণের ও উপস্থাপনের দায়িত্ব প্রসিকিউশনের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যখন গঠন করা হয়, তখন এই সব খুঁটি-নাটি ভালোমতো কনসাল্টেশন করে যদি করা হতো, তবে আজকে এই অবস্থা হতোনা। এখানে কেউ যদি মহাজোটের প্রতি অঙ্গুলি প্রদর্শন করে, তবেতো তা দুষের কিছু নেই। কারণ যে অন্যায় কিংবা ভুল করবে, তাকে তো সেই দায়িত্ব নিতে হবে, তা না নিয়ে অন্যের ঘাড়ে দুষ চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মধ্যে কোন সততা নেই। এখানে যেহেতু একটি পক্ষ বাস্তবিক অর্থেই এই বিচারের বিরুদ্ধে সক্রিয়, এবং তা দেশে-বিদেশে নানাভাবে সক্রিয়, খোদ জাতি সংঘের দুজন কর্মকর্তা যখন এই আদালতের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সেখানে কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পরে নতুন করে তাকে সাজা দেয়ার জন্য এর আইনের পরিবর্তন আদালতের কার্যক্রম, স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিচারের বিরোধীতাকারিদের লবীষ্ট করতে সহায়তা হবে। আর জেনে-শুনে আমরা কেউই এই বিচার নিয়ে কোন ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হতে দিতে পারিনা।
তাছাড়া, অ্যাপিলেট ডিভিশনে মামলা চালানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের কমবেশি অবগত। আজকে অ্যাপিলেট ডিভিশনে যখন মোল্লার মামলা যাবে, তখন প্রধান বিচারপতি যে বেঞ্চ গঠন কিংবা যে বেঞ্চে সেটা শুনানির জন্য ধার্য করবেন,সেখানে যে বিচারপতিরা বিভ্রতবোধ করবেননা, তার কোন গ্যারান্টিও নেই। কেননা, বাংলাদেশের মামলা পরিচালনার এপিলের ইতিহাসে এই রকম উদাহরণ অনেক রয়েছে ( বঙ্গবন্ধুর মামলার এপিলের সময় অনেক বেঞ্চ বিব্রত বোধ করেছিলেন)। এমনও রায়ের ইতিহাস বাংলাদেশে আছে, এপিলেট ডিভিশনের দুই বিচারপতির দুই রায়। অর্থাৎ মামলা জট এবং দীর্ঘায়িত হওয়ার সুস্পষ্ট ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেই অর্থাৎ সমঝোতার যে কথা বাতাসে উড়ছে, সেরকম কিছুর দিকে বাস্তবতায় অনেকটা সমর্থনের ইঙ্গিত মিলে। গত কাল কাদের সিদ্দিকী নিজ দলীয় সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, যারা রায়ের আগে কারাগারে মোল্লার সাথে দেখা করেছেন, তারাও রাজাকার বলেছেন। এটাও বলেছেন, তাদের সাক্ষাতে কি আলোচনা হয়েছে, তা জাতিকে জানাতে হবে। কাদের সিদ্দিকীর এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে জাতির জন্য সেটা অত্যন্ত অশনি এক সংকেত । যারা যেনে-শুনে এধরনের ব্যবস্থা করেছেন, তাদেরকে প্রজন্ম চত্বরের কাঠগড়ায় দাড় করাতে হবে।নতুবা এই সব অনাচার বন্ধ হবেনা, বিচার কার্যও সুষ্ঠু হবেনা।২৪ ঘন্টারও বেশী সময় হয়ে গেছে, কাদের সিদ্দিকীর এই দাবিকে প্রতিবাদ কিংবা কোন জবাবও দেয়া হয়নি।তবে কি কাদের সিদ্দিকী সত্যিই বলেছেন ?
শাহবাগ মঞ্চে তোফায়েল আহমদের বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করে লাকিকে পেছন থেকে লাঠি দিয়ে আঘাতের কথা বেশ কয়েকজন বলেছেন, সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের ভার জনতার। যদি তা হয়ে থাকে, তা শোভনীয় হয়নি। এখানে অনেকেই রাজনীতিকীকরণের
গন্ধ খুজে পাচ্ছেন, যদিও লাকি আগের মতোই দায়িত্বশীল অগ্নিকন্যার মতোই বক্তব্য দিয়ে
হাসপাতালে ফিরে গেছেন।
প্রজন্ম চত্বরের ঘোষণা অনেক বড় এবং ব্যাপক হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের বিরাজমান বাস্তবতায়, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন কতোটুকু সম্ভব, তা আগামীতে সময়ই বলে দেবে। কারণ নিকট অতীতের তত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপক কর্মকান্ড বাস্তবের মুখ দেখেনি, ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের ব্যাপক রাজনৈতিক ঘোষণাও বাস্তবায়ন করা যায়নি, ১৪ দলের ২৩-দফা কর্মসূচীও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বা করা সম্ভব নয়, যদিও ঐগুলোর সাথে শাহবাগের ঘোষণা ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রার। ঘোষণা তৈরির আগে যদি ৩রা মার্চ -এর পল্টনে পঠিত স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা যেতো, তাহলে আরো ভালো ফল দিতে পারতো। এসব আলোচনায় রাখলাম, মহৎ উদ্দেশ্যে, কোন সমালোচনার উদ্দেশ্যে নয়।কোনভাবে এটাকে ভিন্নভাবে দেখা ঠিক হবেনা।
০৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক, প্রখ্যাত কলাম লেখক ডঃ আসিফ নজরুল ইতিমধ্যে টেলিভিশন মিডিয়ায় সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, এপিল করে কাদের মোল্লাকে ফাঁসী দেয়ার আর কোন সুযোগ নেই। কেননা, তিনি বলেছেন, এপিল করতে হবে একটি মাত্র অভিযোগের উপর আদালতকে বলতে হবে কেন বা কি সব কারণে প্রসিকিউশন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলেন। এখানে আদালত মোল্লার রায়ের কম বা বেশী করার সুযোগ আছে, কিন্তু ফাঁসী দেয়ার আর কোন সুযোগ নেই। প্রায় একই কথাই বলেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং কলাম লেখক ডঃ শাহদীন মালিক। তারা দুজনেই বলেছেন, উভয় পক্ষ যেমন এপিলের সুযোগ নিতে পারেন। তবে মৃত্যুদণ্ড এপিলের মাধ্যমে একটি মাত্র অভিযোগ প্রমাণের সাপেক্ষে পাওয়ার সুযোগ আইনত খুব একটা নেই। ডঃ শাহদীন অবশ্য অভিযোগের শব্দটি উল্লেখ করে মূলত প্রসিকিউশন নয়া অভিযোগ দায়ের করে মামলা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
অথচ সরকার জেনে শুনে বিষ পান করেছি……………এই অবস্থায় এখন শাহবাগের জাগরণে এখন আবার নতুন করে আইন সংশোধনের উদ্যোগের কথা বলছে। বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক এই উদ্যোগের ক্ষেত্রে অনেক টেকনিক্যাল সমস্যার দিকে আলোকপাত করে অবশ্য এপিলের দিকে মৃত্যুদণ্ডের সুযোগের কথা বলেছেন।
কিন্তু, প্রশ্ন হলো, সুপ্রিম কোর্ট অবশ্যই দেশের সর্বোচ্চ আইন। কিন্তু মোল্লার রায় হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আর সুপ্রিমকোর্ট কখনোই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে অসমাপ্ত কিংবা অপর্যাপ্ত বলার মতো রায়ের মধ্যে কোন সুযোগ না থাকার প্রেক্ষিতে তা যেমন বলার সুযোগ নেই, আবার এই রায়কে শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের বা অন্যান্য আমলী আদালতের রায়ের মতো বা আইনে রায় দেয়ার সুযোগ খুব একটা নেই। যদি তাই হয় তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আপনা-আপনি বাতিল হয়ে যায়। আর সুপ্রিম কোর্ট জেনে শুনে জাতিকে এই সংকটের মধ্যে ফেলবেনা।
আবার আওয়ামীলীগ ঘরানার প্রথিতযশা আইনজীবী -যেমন ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম সহ অন্যরা মিডিয়ায় খুব জোরদিয়ে এমন কোন অভিমত ব্যক্ত করেননি যাতে জাতি কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারে, অ্যাপিলের মাধ্যমে ফাঁসী দেয়ার মতো গ্রাউন্ড এখানে বিদ্যমান। সবমিলিয়ে মোল্লার রায়ের এপিল নিয়ে সন্দেহ ও ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে এবং নীতি-নির্ধারনী এবং হাই-কমান্ড জেনে-শুনেই সুদূর প্রসারী এক রাজনৈতিক পরিকল্পনার ছক একেই এই রায় এভাবে ঘোষণার বন্দোবস্ত করা হয়েছে-এটা বলা হলে খুব একটা অন্যায় বলে মনে করা হবেনা।আর যদি তাই হয় সেটা দেখার জন্য আরো কয়েকটা মাস অপেক্ষা করতে হবে।কেননা আপাতঃ দৃষ্ঠিতে বেশ কিছু মিথ এখানে সুপ্ত অবস্থায় রেখেই(ছক একেই)মোল্লার রায়কে এভাবে হাস্যকর ভাবে সাজান হয়েছে।সেদিকে আজ যেতে চাইনা, সুপ্তমিথকে মিথ হিসেবেই রেখে দিয়ে শাহবাগ চত্বর কেন্দ্রীক আলোচনা রাখতে চাই।
০৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. পিয়াস করীম গত শুক্রবার চ্যানেল আইয়ের সংবাদ পর্যালোচনা ভিত্তিক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন,, অনেক সময় দেখা গেছে একটা জনপ্রিয় আন্দোলন থেকেও ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে রাজনৈতিকভাবে এটি ব্যবহৃত না হয়। অধ্যাপক ডঃ পিয়াস আরো বলেন, আমরা যাতে ভুলে না যাই যে, আমাদের সামনে পদ্মা সেতুর মতো একটা ইস্যু আছে। আমরা যাতে ভুলে না যাই যে, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আমাদের একটা ইস্যু আছে। আমরা যেন ভুলে না যাই যে, আমাদের জাতীয় সম্পদের ওপর আমাদের অধিকারের একটা প্রশ্ন আছে। আর এসব বিষয় যদি ধামাচাপা পড়ে যায়, তবে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেহারা পাল্টে যাবে। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই এবং শাহবাগের এ গণজাগরণ থেকেও ওই একই দাবি উঠে এসেছে। তবে একটা কথা আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা যেন আইনের শাসনের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে না ফেলি। অবশ্য অধ্যাপক পিয়াস করীম প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করেন এবং এই আন্দোলন ও জাগরণ যাতে কোন অবস্থাতেই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
ডঃ পিয়াস করীম বেঞ্জামীন ফ্রাঙ্কলিন এর সেই বিখ্যাত উক্তি উচ্চারণ করে তরুণদের স্বরণ করিয়ে দেন, যে দেশ স্বাধীনতার জন্য তার গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেয়, সে দেশ গণতন্ত্রও পায় না, স্বাধীনতাও পায় না। একইভাবে যে দেশ বিচার করতে গিয়ে আইনের শাসনকে বিসর্জন দেয়, সে বিচারও পায় না, আইনের শাসনও পায় না। সে জন্যই এটা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনকারী তরুণরা যেন এ কথাটা মনে রাখে।
প্রজন্ম চত্বরের এই জাগরণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার ঘোষণা এসেছে, যাতে গোটা বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার ৮০ শতাংশ মানুষের প্রাণের দাবী একাকার হয়ে বাংলাদেশের হ্রদয় হতে আজ বিশ্ব সভায় উত্থিত হয়ে বিশ্ব বাঙালিকে একই সূত্রে গ্রথিত করেছে। কিন্তু এই জাগরণ, এই আন্দোলন যাতে কোন ভাবেই রাজনৈতিক কূট-চালের কাছে আত্মাহুতি না দেয়, রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে সকলের সমানভাবে সতর্কদৃষ্ঠি দেয়া আশু কর্তব্য। এক্টিভিষ্টরা সেজন্য কিছু পরিকল্পনা ও ছক একে নিলে ভালো করবেন বলে আশা করি। এক্টিভিষ্টদের মতো বিশ্ব-বাঙালির আজ একটাই চাওয়া, একটাই কামনা হউক, ভলতেয়ারের ভাষায়, আমরা হারিয়ে যেতে পারি, নিঃশেষ হয়ে যেতে পারি, কিন্তু মাথা নত করবোনা। আর বাঙালি কখনো মাথা নত করতে শিখেনি। বাঙালি যখন জাগে তখন দাবী আদায় করেই ছাড়ে। এই হউক আপনার আমার সকলের ঐকান্তিক চাওয়া।জয় হউক শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের নয়া জাগরণের।
9th February 2013,UK.