আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া মানুষগুলোর জন্য
সরকার, গার্মেন্টস মালিক এবং তাদের সংগঠণ কি ভেবে দেখবেন ?
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
মানব সভ্যতার ইতিহাস বিনির্মানে পৃথিবী এবং তার মানুষগুলো নানা ধাপ, পর্যায় ও অবস্থার মুখোমুখি হয়ে ক্রমান্বয়ে সেই সব অবস্থাকে পরিবর্তন, আধুনিকায়ন এবং প্রয়োজনে নিয়ম-নীতিগুলোকে সে তার নিজের ও সমাজের প্রয়োজন আনুযায়ী নিজস্ব অবস্থার আলোকে খাপ খাইয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
এক সময়ের আমাদের এই পৃথিবী সভ্যতার আলো থেকে ছিলো যেমন বঞ্চিত, একই ভাবে তখনকার আদিম যুগে ছিলোনা আজকের মতো আধুনিক এতো সুযোগ-সুবিধা এবং প্রয়োগ করার মতো আইন-কানুন কিংবা এর উপযোগী সংস্থা, মানুষ্য সম্প্রদায়ও ছিলো বড় বর্বর, কখনো যাযাবর, কখনো বা বড় হিংস্র ভয়াবহ, জন্ত-জানোয়ারের মতো আচরণ করতো।
****** ****** ***** *****
আজকের একুশ শতকের এই পৃথিবীতে আমরা বড় সৌভাগ্যবান, সেই সব মনীষী, জ্ঞানী-গুনী, সংস্কারক আর রাষ্ট্রনায়কদের রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা, অবদান আর বিরামহীন কর্মযজ্ঞের ফল আজকের আধুনিক, সুশৃংখল, নিয়ম-কানুনসমেত আমাদের এই সুন্দর সভ্যতা এবং এর পৃথিবী, এবং আমরা যারা এই পৃথিবীতে বাস করি, সমাজ, রাষ্ট্র,সভ্যতা, আইন-শৃংখলা বিনির্মাণ করি, তারা হলাম্ সবচাইতে সুবিধাভোগী অংশ।
কিন্তু এই সভ্যতা, এই সংস্কৃতি, এই উৎপাদন, কল-কার-খানা, ফ্যক্টরী, খেতে-খামার হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যে বা যারা আমাদের সভ্যতার এবং উন্নয়নের ও সামনে এগিয়ে চলার পথকে সচল এবং চালু রেখে চলেছে, আমাদের এই সুবিধাভোগী অংশ তথা সব চাইতে সুযোগলভ্য এই উপাদানের গতিপথ করে দিতেছে, তারা হলো আমাদের এই শ্রমিক,মজুর, মেহনতি জনতা, যাদের সিংহভাগ অংশ সমাজের সবচাইতে নীচু তলার বাসিন্দা, এবং অত্যন্ত অমানবিক জীবন-যাপন করে থাকেন, তাদের অর্থনৈতিক জীবনে নেই তেমন কোন স্বচ্ছলতা, তাদের মানবাধিকার হয় প্রতিনিয়ত লঙ্গিত, তারা থাকেন সামাজিক ও মানষিক সুকুমার দিকগুলো থাকে বড়ই অবহেলিত। হয়তো কখনো কখনো পত্রিকার বদৌলতে কিংবা আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর অগ্নি ট্রাজেডি মিডিয়া ও বিশ্ববিবেকের যৎ সামান্য বদান্যতার বদৌলতে ক্ষণিকের জন্যে এসে থাকে পাদ-প্রদীপেরঅগ্রভাগে।কিন্ত তা নেহায়েত কেবল দূর্ঘটনা এবং ঘটনা-রটনা না হলে আলোর মুখ দেখেনা।
দূর্ভাগ্য এই জাতির এবং তার নিরন্ন জনতার, যারা তাদের হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে আমাদের এই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, অথচ তাদের সুযোগ-সুবিধা, তাদের কাজের নিরাপত্তা, জীবন-মানের ন্যূনতম মানবিক অধিকারগুলো সমুন্নত করার লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত কোন সরকার, কোন সংস্থা, কোন সংগঠণ এমনকি তাদের মিল- মালিক ও মিল- মালিক -শ্রমিকদের কোন সংগঠণই সামান্যতম কোন উদ্যোগ গ্রহণ করার ব্যবস্থা করে নাই। অথচ তাদের এই রক্তে আর তাদেরই ঘামে তিল-তিল করে গড়া এই সভ্যতা, এই দালান, এই প্রাসাদ সম বাড়ী, গাড়ী, এসি, সবই সমানতালে ভোগ করে চলেছে।লজ্জা হয় সেই সব রাষ্ট্রনায়ক, সেই সব নেতা-নেত্রী, সেই সব মালিক-শ্রমিক নেতা, আর সংগঠণের পদের আসীন ব্যক্তিদের, টেলিভিশন ও মিডিয়ায় যখন তাদের চেহারা দেখি, বক্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা, সাজেশন শুনি, তখন কষ্ট হয়, ধীক্কার দেই, সেই সব লোকদের, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে, বারে বারে অগ্নিকান্ড ঘটে যায়, জান-মালের ক্ষতি সাধিত হয়, শ্রমিক ভাই-বোনদের কলাপসিবল গেইট তালাবদ্ধ রেখে মৃত্যুর কোলে আগুনের লেলিহান শিখায় অঙ্গার হতে দেই,গার্ডার ধ্বসে শ্রমিকভাইয়েরা অমানবিকভাবে মৃতুর কোলে ঢলে পড়ে, তার পরেও একটু খানি সতর্কতা, একটুখানি প্রাক-নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা কোন মিল মালিক পক্ষ কিংবা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠণ অথবা সরকার নামক বিশাল দেহী এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের একচ্ছত্র মালিক কখনো নিয়েছেন বলে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে বলে কারো কাছে মনে হয়না।তাহলে কি করে সেই রতি মহা-রতিরা মিডিয়ায় আবার নসিহত করে চলে ?লজ্জা হয় সেই সব রতি-মহারতিদের চেহারা দেখতেও, ধিক, শত ধিক তাদের প্রতি।
বার বার পোশাক-শিল্প কারখানায় আগুন লাগবে, আর নিরীহ শ্রমিকগুলো এই ভাবে আগুনে পুড়ে ছার-খার হয়ে যাবে, তার পর মিডিয়া কিছু হৈ-চৈ করবে, সরকার কিছু ক্ষতি পূরণ দিবে, বিশ্ব আমাদানী কারকরা কিছু শর্ত আরোপ করবে, তার পর যেমন ছিলো, তেমনি সব কিছু আগের মতো রয়ে যাবে, এটা কি কোন সভ্য-ভভ্যতার নিদর্শন, আধুনিক বিশ্বে কি এই সব ভন্ডামী চলে? আজকে সময় এসেছে, সেই সব প্রশ্নের শুধু ভাববার নয়, প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার। তা না করে এই ভাবে আর কতো মানুষ দিনের পর দিন আগুনে জ্বলসে অঙ্গার হয়ে মারা যাবে ? এরকম চলতে দেওয়া যায়না। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় এই রকম আদিম বর্বর, ব্যবস্থা কোন অবস্থাতেই চলতে দেওয়া যায়না। সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে সেই সব ভাবতে হবে এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে ।
আজকের যুগে সাধারণতঃ কোন বাসা-বাড়ী, ব্যবসা-প্রতিষ্টান, কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল-রেস্তুরা, মার্কেট ইত্যাদি বানানো বা প্রতিষ্টা করার জন্য যখন কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্টান, সংঘ আবেদন করেন, তখন আজকের যুগের রাজউক, নগর মন্ত্রণালয় সহ স্থানীয় সংস্থাগুলো পুরোপুরি ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে, যে প্রস্তাবিত প্রকল্পে(তা ছোট কিংবা বড় হউক) পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা, নিরাপত্তা আক্সেস ডোর,সিড়ি,এবং তদসংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদির রাখা ও প্রদর্শন, চেকিং, এবং মূল্যায়নের ব্যবস্থা উক্ত প্ল্যান-এ রয়েছে কিনা, কেবল মাত্র সেই সব যদি থাকে অথবা আগে থেকে বানানো বিল্ডিং বা স্থাপনায় সেই সব ব্যবস্থা যদি বিদ্যমান বা বসানোর ব্যবস্থা থাকে, তবেই কেবল উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ঐ প্রতিষ্টান বা সংস্থা, ব্যবসা, দোকান, মিল,কারখানা,বাসা,বাড়ী,কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদির অনুমতি প্রদান করে থাকেন। বলা বাহুল্য এই নিয়ম আজকের যুগে সারা পৃথিবীতে অনুসরণ করা হয়ে থাকে, এতে বিন্দু মাত্র শীতিলতা প্রদর্শন করা হয়না বা দেখানোর মতো কোন ধরনের সুযোগও নেই।
ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ । বাংলাদেশতো বিশ্বের বাইরের কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, বরং দেশে এবং সারা বিশ্বের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের সুন্দর যোগাযোগ, হতে পারে তা পুরনো ও সেকেলে । তারপরেও এর রয়েছে একদল উচ্ছল, সৃজনশীল, তারুণ্য । যারা সহসাই যথোপযুক্ত সুযোগ পেলে নিমিষেই দেশটাকে পুরোদমে পাল্টে দিতে পারে।
ব্যতিক্রম এই কারণে যে, এখানে রয়েছে ব্রিটিশ-পাকিস্তানী আমলের আইন-কানুন, কিঞ্চিৎ রদ-বদল করে চালানো হচ্ছে।কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করার মতো স্বাধীন দেশের উপযোগী একদল স্বাচ্ছা দেশপ্রেমিক, প্রশাসনিক দক্ষ কর্মকর্তার রয়েছে চরম অভাব। কেননা, প্রশাসনে সেই ব্রিটিশ-পাকিস্তানী কায়দার ভূত-প্রেতাত্বারা এবং রাজাকারের বংশধরেরা এতো প্রভাবশালী ও এতো দুষ্টু, শয়তান-নমরুদের চাইতে লোভী-পাপীরা, টাকা আর সামান্য সুযোগ-সুবিধার লোভে আইনের মার-প্যাচে, কিংবা কখনো ঘুষ আর দূর্ণীতির কাছে আত্নসমর্পন করে এই সব অতি প্রয়োজনীয় এবং মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার মতো সবচাইতে মুল্যবান ও সেনসিটিভ বিষয়টিকে সুকৌশলে পাশ কাঠিয়ে প্ল্যানিং পার্মিশন করে দেয় ।শুধু কি তাই, এখানকার সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ব্যক্তি, এর পরে তার ঐ অনুমোদিত বিষয় সরে জমিনে দেখ-ভাল করার মতো তার রুটিন দায়িত্ব বেমালুম ভুলে গিয়ে অফিসে বসেই টাকা আর পেশী-শক্তির কাছে নতজানু হয়ে সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। আর যে বা যারা এর উদ্যোক্তা তথা ব্যবসা বা শিল্প-প্রতিষ্টান করার জন্য টাকা লগ্নি করে থাকেন, তারাও সমভাবে এতো পাপী যে, নিজের বিবেক বিবর্জিত ভাবে নিরাপত্তার মতো গুরু দায়িত্বকে নির্বিঘ্নে অবহেলা ও পাশ কাঠিয়ে ব্যবসা বা শিল্পে টাকা লগ্নি করতে পেরে যেন মহা-কাজ উনি সম্পন্ন করে ফেলেছেন, এমন করে ঢেকুর গিলে থাকেন। আর দায়িত্বশীলতার সব চাইতে শক্তিশালী যে জায়গাটি অবশিষ্ট থাকে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং তার সচিব হয় নিজেদের অজ্ঞতা, অদক্ষতা, বাস্তব জ্ঞানের অভাব, অথবা টাকা আর পেশীশক্তি আর ঐ দূর্ণীতির কাছে এমনভাবে নতজানু হয়ে পড়ে যে, নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কোন প্রশ্ন বা পর্যালোচনার কোন অবকাশ থাকেনা বা করতে দেয়না। কারণ সেতো আগেই বাসর ঘরে বউ-এর সাথে দেখা হওয়ার আগেই যেমন করে কবুল করা হয়ে থাকে, সেরকম ভাবেই নিজেকে বিক্রী করে থাকে।
আর এই রকম অবস্থার প্রেক্ষিতে যখন একটা নতুন এবং পুরাতন প্রতিষ্টান কোন শিল্প-কারখানা বা ব্যবসা বা বাণিজ্যিক ভবনে পরিগ্রহ লাভ করে থাকে, তখন দেখা দেয়, প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনা।
এই সব দুষ্টু লোকগুলো, প্রশাসন ও লগ্নিকারী উভয়েই এমনভাবেই পারদর্শী যে, দূর্ঘটনা কবলিত পরবর্তী অবস্থা বা দূর্যোগপূর্ণ পরিবেশ এমনকি, দূর্ঘটনা কবলিত অসহায় লোকগুলোর মরদেহ থেকে শুরু করে সমগ্র বিষয়টি এতো নিপুণতার সাথে সামাল দিয়ে পুরো বিষয়টিকে ঘিলে খেয়ে ফেলে যে, তা আর বাস্তবতার মুখ দেখেনা। তদন্ত কমিটির নামে যে ন্যক্কারজনক খেলা বাংলাদেশে খেলা হয়, তা আরো ভয়াবহ। এই তদন্ত কমিটি যারা করেন, এবং যারা তদন্ত করেন, এই রকম দূর্যোগ আর আগুণে পুড়ে মানুষের লাশ যেন তাদের পকেটের সীমা এতো খানি পাওয়ারফুল করে তুলে যে, এরা প্রতিনিয়ত এই রকম দূর্ঘটনার জন্য কাক-পাখীর মতো হা-পিত্যেস করে থাকে। এখানে এই দুই-ই সমানভাবে অপরাধী। এই লোকগুলো একেবারে মানবিক বিবেকশুন্য, বড় নিষ্টুর, হিংস্র এবং বন্যের ব্যঘ্র প্রাণীর হিংস্রতাকে হার মানিয়ে চলে, যদিও এরা রক্ত-মাংশে গড়া মানুষ।এই দুই-তিন- জায়গারই উন্নতি ঘটাতে হবে, যে করেই হউক না কেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ এই ভাবে আর কতো ? কতো মানুষের লাশ পড়লে, বা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হলে এই সব হায়েনাদের আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে নিরাপত্তারমতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রকল্প অনুমোদন ও নিবিড় পর্যালোচনার আওতায় নিয়ে আসবে ?
সরকারের কাজ হলো সুশৃংখল, দক্ষ, জন-প্রশাসন গড়ে তুলবে, যা দিয়ে সরকার তার উপর প্রদত্ত গুরু দায়িত্ব নিষ্টার সাথে পালন করবে। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো যেন তার উল্টো । এরা এই সব দায়িত্ব-টায়িত্ব বলতে কিছুই যেন বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে, এরা পারে শুধু দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন করতে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বে এক অভূতপূর্ব সাড়াই শুধু ফেলেনি, এই খাত আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এক বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে। বিবিসির ভাষ্যমতে, বছরে ২০ বিলিয়ন টার্ণওভার এই খাত থেকে বাংলাদেশ পেয়ে থাকে। যে শিল্প আমার দেশের সার্বিক জিডিপি ও উন্নতিতে এতো অবদান রেখে চলেছে, সেই খাতের সুষ্টু পরিচালনা, শৃংখলা, সেই খাতের সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সার্বিক নিরাপত্তা, কাজের গুণগত মান বজায় ও আরো উন্নত দক্ষ কারিগর সৃষ্টি, উন্নত পরিবেশ তৈরী, লগ্নি কারকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত, মজুরী যথাযথ আইনানুগ ভাবে নিশ্চিতকরণ, উৎপাদন ও শিল্পের যাবতীয় উপকরণ সহজলভ্য, আধুনিক অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র স্থাপন, পরিচালন, প্রশিক্ষণ এবং এর সুষ্টু ব্যবহার ও প্রয়োগ কৌশল সহ যাবতীয় বিষয় দেখ-ভাল করার জন্য সরকারতো এক্ষেত্রে ঐকান্তিক উদ্যোগ গ্রহণ যেমন করতে পারতো, পাশা-পাশি মালিক-শ্রমিক ও তাদের সংগঠণগুলোও এই সব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে পারতো। সচরাচর সব দেশে সব ক্ষেত্রেই যা হয়ে থাকে। আফসোস আমাদের এই উভয় লুটেরারা এই সবের কোন ধার ধারেনা। যাও করে, তা তথাকথিত আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াও, আলোচনা, আর দমন-পীড়নের নামে উভয় শ্রেণী থাকে নিজেদের লুট-পাটের রাস্তা অবারিত করতে, আখের গোছাতে।
তাজরীনের মালিক দেলোয়ারের বক্তব্য প্রকাশ করেছে এটিএন নিউজ।মালিকের বক্তব্যে বেশ যুক্তি আছে, কিছু মানবিক কথা রয়েছে।তাই বলে কি দেলোয়ার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন? এদিকে কানাডার গ্লোবাল খবর দিয়েছে, দেলোয়ার বাংলাদেশ-কানাডার দ্বৈত নাগরিক, তাজরীনে আগুন লাগার পর বিজেএমইর পরামর্শে তিনি মিডিয়ার সামনে থেকে আড়ালে চলে গিয়েছিলেন।মিডিয়ায় আরো খবর হলো, কুখ্যাত ডেসটিনিরও অন্যতম পরিচালক এই দেলোয়ার।দেশের পত্রিকা আমার দেশ খবর দিয়েছে, বিগত নির্বাচনের সময় এই দেলোয়ার মীর্জা আজমের পক্ষে কাজ করেছিলেন।এই সমস্ত লিংক এবং নেপথ্য ঘটনা কিন্ত দেলোয়ার-এর বক্তব্যকে সমর্থন করেনা।
বার-বার আগুণে পুড়ে এই ভাবে অমানবিক এবং অসহায়ভাবে নিরন্ন, খেটে-খাওয়া শ্রমিকগুলোকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরকার, পোশাক মালিক, শ্রমিক সংগঠণ, বিজেএমসি, এফবিসিসিআই, মন্ত্রণালয় অত্যন্ত মানবিক দিক বিবেচনা করে নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ন্যুনতম ঐক্যমতে পৌছতে অতি সাধারণ কিছু সুপারিশ উপস্থাপণ করছি। আশা করছি সংশ্লিষ্ট সকলেই সদয়তার সাথে বিবেচনা করে দেখতে পারেনঃ–
স্বল্প বা আশু করণীয়ঃ-
০১) প্রতিটি শিল্প-প্রতিষ্টান, মিল-কারখানা, গার্মেন্টস সহ সকল প্রতিষ্টানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা আক্সেস ডোর আছে কিনা, জরুরী ভিত্তিতে খতিয়ে দেখে আধুনিক এবং সহজলভ্য এবং এক সাথে দলবদ্ধ মানুষ যাতে বের হতে পারে এমন ওয়াইড- আক্সেস ডোর স্থাপণ বা ব্যবস্থা করা, প্রতিটি তলা থেকে একাধিক আক্সেস ডোর, আক্সেস সিড়ির ব্যবস্থা করা, এবং সেটা জরুরী ভিত্তিতে, কোন প্রকারের ছাড় না দিয়ে করা।
০২) প্রতিটি প্রতিষ্টানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা যন্ত্র, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, প্রতিটি তলাতে সহজে দৃশ্যমান, এবং প্রয়োজনের সময় যাতে সকলের জানা থাকে এমন ব্যবস্থায় রাখার ব্যবস্থা, করা জরুরী ভিত্তিতে।
০৩) এই সব নিরাপত্তা যন্ত্র প্রয়োগের বাস্তব জ্ঞান, কৌশল সংশ্লিষ্ট কর্মীদের সকলেরই কম-বেশী জানার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা, সেজন্য জরুরী ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কারখানার প্রতিটি ফ্রন্ট ওয়ার্কারদের তালিকা করে প্রশিক্ষণের বাস্তব সম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী
০৪) কারখানার নিরাপত্তা ম্যনেজার এর দায়িত্ব-জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, প্রতিটি কারখানায় কাজ শুরুর আগে নিরাপত্তা ম্যনেজার ও অপারেটর-এর কাজ হবে কারখানায় কর্মীদের কাজ শুরুর অন্তত এক ঘন্টা আগে অগ্নি নির্বাপনের যন্ত্রগুলো পরীক্ষা করা, ঘন্টা বাজানো-যাতে সিগন্যাল যথাযথ কাজ করছে কিনা তা পরীক্ষা করা, এবং কাজ শুরুর আগে সকলের দৃশ্যমান হয়, এমন জায়গায় এই সংক্রান্ত তথ্য প্রদান ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা, যাতে কর্মীরা কাজে যোগদানের পূর্বে এই সংক্রান্ত বিষয়ে অবগত হয়েই কাজে মনোনিবেশ করে।
০৫) নিরাপত্তা ম্যানেজার তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কিনা, তা সরে জমিনে দেখার দায়িত্ব ঐ প্রতিষ্টানের প্রশাসনিক কর্মকর্তার, তাকেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলা।
০৬) কারখানার ভিতরে সকল প্রকারের দাহ্য পদার্থের প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি চেক ছাড়া যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সিকিউরিটি চেক আধুনিক, উন্নত এবং এই সম্পর্কে দায়িত্বরত ব্যক্তির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
০৭) কারখানার ভিতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, অক্সিজেন-হাইড্রোজেন গমণ-নির্গমণ চেকের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সম্বলিত পদক্ষেপ গ্রহণ
০৮) কলাপসিবল গেট লক সিষ্টেম উঠিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় মণিটরিং ব্যবস্থা, কেন্দ্রীয় সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, প্রধান গেট নিয়ন্ত্রণ সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা সিষ্টেমের আওতায় নিয়ে এসে এবং তা সার্বক্ষনিক পর্যালোচনার মধ্যে রেখে আদিম ও বন্য পন্থার ঐ তালাবদ্ধ জেলের অবস্থায় কাজের পরিবেশ উঠিয়ে দিয়ে আধুনিক উন্নত ব্যবস্থার দিকে মনোনিবেশ করা আশু জরুরী
০৯) এই সব ব্যবস্থা যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা, আক্সেস ডোরগুলো কাজ করছে কিনা, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রগুলো কাজ করছে কিনা এবং সকলের জ্ঞানের মধ্যে কিনা অর্থাৎ কিভাবে, কখন ব্যবহার করতে হবে, তা জানা আছে কিনা, নিরাপত্তা ম্যানেজার সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষ এবং কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সিষ্টেম যথাযথ ভাবে কাজ করছে কিনা- তা মণিটর ও সরে জমিনে তদন্ত প্রতি তিন মাস অন্তর- অন্তর সরকারী সংশ্লিষ্ট বিভাগ চেক করে দেখে যথাযথ কতৃপক্ষের নিকট রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করা। যদি এর কোন ব্যত্যয় কোন প্রতিষ্টানে দেখা যায়, এতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাগ্রহণ, মারাত্নক নিরাপত্তা ঝুকি দেখলে সঙ্গে সঙ্গে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার ঐ কর্মকর্তাকে দেওয়া উচিত, যা সারা বিশ্বে এই রকম ব্যবস্থা রয়েছে। এতে ঐ প্রতিষ্টান সঙ্গে- সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই কেবল কারখানা আবার চালু করতে পারবে বলে নিয়ম কঠোরভাবে পালন করার আবশ্যক।
মধ্যমেয়াদী ব্যবস্থাঃ-
০১) প্রতিটি প্রতিষ্টানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা যন্ত্র-পাতি যথাযথ ভাবে এবং উপযুক্ত কতৃপক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অন্ততঃ বাৎসরিক রুটিন চেকের মাধ্যমে তা করা, প্রয়োজনীয় সুপারিশ মালা, আশু ও মধ্যমেয়াদী করণীয় নির্দেশনা প্রদান করা, সেই সব বাস্তবায়নের টাইম-স্কেল বেধে দেয়া এবং তা আবার বাস্তবায়নের অবস্থা দেখার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।
০২) মূল্যায়ন ও বাস্তবায়নকারী সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্টান ও কর্মকর্তার যথাযথ প্রশিক্ষণ ও কাজের মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
০৩) সেই লক্ষ্যে একদল প্রশিক্ষিত দক্ষ, সৎ, নিবেদিত প্রাণ কর্মীবাহিনী প্রশাসন ও প্রতিষ্টানে তৈরী ও রিক্রুট করতে হবে
সুদূর প্রসারী ব্যবস্থাঃ-
ঘাটে-ঘাটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ডেস্ক, শিল্প,শ্রম,নগর,রাজউক,বেপজা, দমকল, শিল্প পুলি্শ, ছাড়-পত্র, সার্টিফিকেট, প্রভৃতি বিভাগ আলাদা আলাদা অবস্থান পরিবর্তন করে সব কিছুকেই এই সেক্টরের জন্য একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ওয়ান-ষ্টপ সার্ভিসের আওতায় এবং তা একই স্থানে, একই ডেস্কের আওতায়, কেন্দ্রীয় কপম্পিউটারাইজড ডাটা সিষ্টেমের আওতায় নিয়ে এসে, অতি সহজ এবং সুলভ, দক্ষতা, নিপুণতা, পর্যাপ্ত এবং নিবিড় নিরাপত্তার আওতায় পোশাক শিল্প মালিক-শ্রমিক-সংগঠণ-কারখানার যাবতীয় কাজ একই নথিভূক্ত, একটিমাত্র কেন্দ্রীয় রেফারেন্স-যেখানে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আদ্যক্ষর চাপ দিলেই ঐ বিভাগের সাথে যুক্ত যাবতীয় তথ্য সহজেই চলে আসে, পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হয়, অহেতুক হয়রানি ও দূর্ণীতি বন্ধ হয়, অযথা তদবির বন্ধ হয়, ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়-এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলা উচিৎ। মালিক-শ্রমিক-সরকার সকলের এবং দেশ ও জনগনের উন্নয়নের ও জাতীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি, নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যে, একই সাথে দলাদলি, হানাহানি, পেশী শক্তি, দূর্ণীতি বন্ধের লক্ষ্যে এই রকম সহজ একটা পন্থা গ্রহণের উদ্যোগ আরো গভীর আলাপ-আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে গ্রহণ করা যেতে পারে।
এখানে আমি, এক সম্য়, ব্রিটেনের সর্বাধিক কম্পিউটার ও তার সফটওয়ার সামগ্রী উৎপাদনকারী ভায়া সিষ্টেম নামক শিল্পে কাজ করার ক্ষেত্রে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যক্তিগত কাজের অভিজ্ঞতা জনগণের সাথে শেয়ার করলাম মাত্র। আমার উদ্দেশ্য মহৎ, কোন প্রকারের ভনিতা কিংবা কারো কোন সমালোচনা করার জন্য নয়, বরং মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমার দেশের শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের অমানবিক ও অসহায়ভাবে আগুনে পুড়ে জ্বলে মরা কিংবা কখনো দেয়াল ধ্বসে, কখনো গার্ডার ধ্বসে, কখনো ভবনের ছাদ ধ্বসে, নির্মম মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার করার ক্ষুদ্র এক প্রয়াস মাত্র । সংশ্লিষ্ট সকলে যদি এই ব্যপারে উদ্যোগী হন, তাহলেই কেবল এই অপ-মৃত্যুর হাত থেকে আমরা তাদেরকে যেমন রক্ষা করতে পারবো, একইভাবে সেই সব অসহায় পরিবারগুলোর মতো আর কোন পরিবারকে আমরা ক্ষত-বিক্ষত হওয়া থেকেও রক্ষা করতে পারবো।
27th November 2012.UK