সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ, লন্ডন থেকে ।১০ মে ২০২২।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সাম্প্রতিককালে ঘটে গেছে স্মরণকালের সব চাইতে অবিশ্বাস্য এক রাজনৈতিক মেরুকরন। সেই মেরুকরনের শুরুতেই জনতার ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসা নয়া পাকিস্তান দর্শনের প্রতিভু প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে, খোদ ইমরান সরকারের ভাষায় “বিদেশী দেশের হুমকী” নিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।
ইমরান খান বিদায়ের রেশ কাটতে না কাটতেই শ্রীলংকায়ও জনতার ভোটে ক্ষমতায় আসা রাজা পাকসে, যার সাথে পুরো পরিবারও ক্ষমতায়, সেই মাহিন্দা রাজা পাকসেকেও প্রচন্ড জনবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে একরাশ ব্যর্থতা আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থা নিয়ে।
পাকিস্তানের ইমরান খান কিংবা শ্রীলংকার মাহিন্দা রাজা পাকসে দুজনই চীন সরকারের ঘনিষ্ট এবং চীনমুখী নীতিতে দেশ পরিচালনা করছিলেন। দুই সরকারই চীন থেকে মাত্রাতিরিক্তহারে লোন নিয়ে একের পর এক উচ্চাভিলাসি প্রকল্প-যতোটা না ছিলো সাধারণ জনগনের জীবন মান উন্নয়ন ও প্রয়োজন পূরণের স্বার্থে, ততোটাই ছিলো সামগ্রিকভাবে নিজ নিজ দেশের আর্থিক সঙ্গতি ও সক্ষমতার সাথে চরম সাংঘর্ষিক প্রকল্প ।
বিশ্ব রাজনীতির ভূ-কেন্দ্রে ইসরায়েল, মধ্যপ্রাচ্য, প্যালেস্টাইন, ইরান, সিরিয়া, ইউরোপ আর ভারত চীন মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র সমর, বাণিজ্য, কূটনীতি, ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি কেন্দ্রীক অনেক পরিবর্তন ও নয়া এক বলয় তৈরি হয়ে যায়, ঠিক তখনই রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন ইস্যুতে বিশ্ব রাজনীতিতে নাটকীয় এক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। যদিও সেই পরিবর্তনের অনেক কিছুই এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছেনা সহসাই। খোলা চোখে চীন-মার্কিন-ইসরায়েল-ইউরোপ-ভারত-রাশিয়া কেন্দ্রিক সমীকরণ বিশ্লেষণ করে ত্রিপক্ষীয় বিশ্ব ভুরাজনীতি আবর্তীত হতে মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত অনেক বিষয় এখনো সামনে আসার আরও কিছুটা বাকী রয়ে গেছে। কেননা, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ যেমন রাশিয়াকে নয়া আগ্রাসি শক্তি হিসেবে আবির্ভুত করেছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সাধনার পর আচমকাই ইউরোপকে মার্কিনের একেবারে কোলে(করায়ত্ব) সপে দিয়েছে। বিপরীতে চীনকে করে তুলেছে বিশ্ব ভুরাজনীতিতে এক শক্তিধর রাষ্ট্রে ।এই সমীকরণ তখনই কেবল সঠিক হবে যখন ইসরায়েল, রাশিয়া, ইরান, ভারত, ওয়াশিংটনের বিশ্ব ভুরাজনীতির বলয় প্রকাশ্যে আসবে।
বিশ্ব ভুরাজনীতির এই টালমাটাল অবস্থায় চীনের ঘনিষ্ট সহযোগী খ্যাত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলংকা দুটো দেশই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার হলেও অতিরিক্ত চীন ঘেষা ও দুই দেশে চীনের উপস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছিলো। শুধু যে দুই দেশের নিজস্ব স্বার্থ সেটাতেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা, উপরন্ত দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রিক ভুরাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব প্রতিপত্তি ও ভবিষ্যৎ জ্বালানী বাণিজ্য, রুট, সাম্রাজ্য নিরবচ্ছিন্ন ও অক্ষুন্ন, প্রাধান্য রাখতে চীন ভারত মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র একাট্রা এবং একে অপরের বৈরি শত্রু ও প্রতিদ্বন্ধি হলেও ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তার করতে একে অন্যের সাথে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য বাণিজ্যিক সম্পর্কও জিইয়ে রাখতে কার্পণ্য করছেনা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন বাণিজ্য এবং সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই অভাবিত উন্নতি করেছে, যা পশ্চিমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আবার লাদাখে চীনের বাড়াবাড়ি ভারতও ভালো চোখে দেখছেনা। এমনি পরিস্থিতিতে কাড়ি কাড়ি বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে উন্নয়নের স্বপ্নের প্রকল্পসমূহে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে চীন পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার সরকারের কাছে গেলে আর্থিকভাবে কাবু শ্রীলংকা, পাকিস্তান এবং নেপাল চীনের অফার ও আর্থিক সব প্যাকেজগুলো সক্ষমতা যাচাই বাছাই না করেই গ্রহণ করে ও করছে। শ্রীলংকা, নেপাল মানবসম্পদ, রফতানি বাণিজ্য, রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থেকেও চীনের দেয়া উচ্চাভিলাসি প্রকল্পের আর্থিক প্যাকেজ গ্রহণ করে ও করছে, যা অনেক অর্থনীতিবিদেরা কোনভাবেই সঠিক ঋণ প্যাকেজ কিংবা বিদ্যমান ব্যবস্থায় অত্যাবশ্যকীয় জরুরী প্রকল্প বলে মনে করছেন না। বিপরীতে পাকিস্তানের মানসম্পদে শ্রীলংকা নেপালের চাইতে এগিয়ে থাকলেও রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক রফতানি বাণিজ্যের অবস্থা খুব একটা আশানুরূপ নয়।
ভুরাজনৈতিক অবস্থান ও দক্ষিণ এশিয়ার বলয়ে পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ভারতের সন্নিকটে এবং শ্রীলংকা নেপাল ইতোপূর্বে অনেকটা ভারতের উপর নির্ভরশীলতা হওয়ার পরে চীনের আর্থিক প্রকল্পের সহায়তায় ভারতের উপর থেকে সেই নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনে-যা থেকে টানা পোড়েন প্রকাশ্যে চলে আসে।
অন্যদিকে জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানের সাথে মার্কিনীদের দহরম মহরম থাকলেও ইমরান খানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে অতিরিক্ত চীন এবং সৌদিআরব, রাশিয়া, সিরিয়া ঘেষা হওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইমরান খানের সরকারের বুঝাপরায় ঘাটতি দেখা দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভুরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক কৌশলগত প্রেক্ষিতে এতদ অঞ্চলে চীনের অতিরিক্ত উপস্থিতি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। যেমন পারেনি ভারত। যদিও ভারতের সাথেও চীনের রয়েছে বিশাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর চীন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত এক কাতারে যখন পৌছে যায়, ঠিক তখনি বিশ্ব রাজনীতিতে ভ্লাদিমির পুতিন আচমকা নতুন মেরুকরণ শুরু করে দেন। অনেক বোদ্ধা পণ্ডিত বলছেন, ইসরায়েলের অনেক অলিখিত ও অনুচ্চারিত অনেক ইস্যু ধীরে ধীরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সামনে চলে আসবে, যা তাকে করে তুলবে আরও মারমুখী ও প্যালেস্টাইন ইস্যুতে আগ্রাসি। যদিও সেটা দেখার আরও অনেক বিষয় এখনও সামনে আসার বাকী রয়ে গেছে। কিন্তু ইসরায়েল তাই বলে বসে নেই। এতদ অঞ্চলে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের সাথে বুঝাপরা করে, আবার কখনও কখনও নিজেরাই এককভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় অতি সন্তর্পনে নিজেদের উপস্থিতি বেশ গেড়েই বসেছে, যা টুথ পেস্টের ন্যায় আলতো করে চেপে ধীর স্থিরে বের করে আনলেই তবে অনুমেয় বা দেখা যায়-যেন এক অনুবীক্ষণ যন্ত্রের খেলা।
রাজাপাকসে এক সময় ভারত ঘেষা এবং মার্কিনীদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। চীনের কল্যাণে রাজাপাকসে ভারতীয় পাত্র থেকে নেমে চীনের টাকার পাত্রে উঠে বসলে ভারত মার্কিন চীন বধে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মাহিন্দা রাজা পাকসে বধে ছক সাজায়। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে যেভাবে মার্কিনীরা খেলে থাকে, শ্রীলংকাতে গণতন্ত্র ও অর্থনীতির বিপর্যস্ত ধবসাকে ইস্যু করে ক্যাপ্টেন ভারতের উপর ভর করেই মিশন একমপ্লিশড সাধিত হয়। পাকিস্তানে ইমরান খান একা হলেও শ্রীলঙ্কাতে মাহিন্দা রাজা পাকসে পরিবার সহ গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তথাপি চীনের কাড়ি কাড়ি টাকাও তার শেষ রক্ষা হয়নি।
এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, ভারত চীন ও পশ্চিমারা যেভাবে রাজনীতি অর্থনীতি কূটনীতি ও সামরিক কৌশল নিয়ে খেলে, বিপরীতে চীন কেবল ব্যবসা আর ব্যবসা নিয়েই অন্য দেশে ব্যস্ত থাকে। নিজ দেশের আর দেশের বাইরে তাইওয়ান ব্যতিরেকে অন্যদেশের সরকার বিপর্যয়ের সময়ে চীন এমন কৌশলী ভুমিকা পালন করে, যেন আমার টাকা আমার হাত থেকে না পরে যায়।
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে শ্রীলংকা স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করে। ২০১৯ সালে ইস্টার সানডে চার্চ হোটেলে বোমা বিস্ফোরণে ২৫০ জনের মতো নিহত হয়ে বিশ্ব শিরোনাম হয়েছিলো। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪১.৫ বিলিয়ন ডলার।