সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
মাহে রমজান মাসের ফজিলত নিয়ে কিছু কথা-দ্বিতীয় পর্ব
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
রমজান মাসে এশার নামাজের পর জামায়াতের সাথে তারাবীহ নামায আদায় করা বিশেষ ফজিলত এবং সুন্নত হিসেবে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে-বিদেশে এক শ্রেণীর টেলিভিশন চ্যানেলে এবং মিডিয়াতে দেখা যায়,অহেতুক কিছু রেফারেন্স টেনে বিভিন্ন মাযহাবের কথা বলে তারাবীহ নামায বিশ রাকাত,কারো কারো জন্য আট রাকায়াত, আবার কারো কারো জন্য বিশেষ চার রাকায়াতের কথা বেশ জোরে-শোরে বলা হয়ে থাকে। এই নিয়ে দেখা যায় অনেকের মাঝে বিভ্রান্তি।বিশ পড়েন, আট পড়েন- যাই পড়েন- সুন্নতে নফল এবাদত যতো করবেন ততো মঙ্গল বিশেষ করে এই রমজানে।কারণ প্রতিটি এবাদত আর প্রতিটি সময়(রমজানে), ক্ষণ অতীব মূল্যবান। এখন মাগফেরাতের দিন, বৃস্টির মতো অগণিত রহমত জমিনে বর্ষিত হচ্ছে, হাজারো লাখো লোককে আল্লাহ পাক মাগফেরাত করে দিচ্ছেন।এভাবে চিন্তা করলে আর বিশ না আট রাকায়াত- এই সমস্যা বা অহেতুক বিতর্ক থাকবেনা।বেশী এবাদত বেশী সওয়াব- এই হিসেবে শুধু মাত্র কিছু রেফারেন্স এখানে তুলে ধরলাম-
এই ব্যাপারে হযরত আবু হুরায়রা রাজিয়াল্লাহু আনহু,যাকে হাদিস শাস্রের সবচাইতে নির্ভর যোগ্য সর্বাধিক হাদিস উপস্থাপক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সহীহ বোখারী শরীফ,মুসলিম শরীফ,তিরমিযি শরীফ,ইমাম আবু হাণিফা,ইমাম মালিক,ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল,ইমাম ক্কাসীর,আবু দাউদ,বায়হাক্কী,শোয়াব-আল-ঈমান,কাণজুল ঈমান,ইত্যাদিতে-তিনি বলেছেন,রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,যিনি বা যারা রমজান মাসে দিনের বেলা সকল প্রকার পানাহার থেকে বিরত থাকবেন,পূর্ণ বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার বা মাফি চাইবেন,রাতের বেলা নামায-এবাদত করবেন, লাইলাতুল ক্কদরের রাতে এবাদত করবেন,আল্লাহ পাক তাকে বা তাদেরকে মাফ করে দিবেন।তিনি আরো বলেছেন,রমজান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়,শয়তানকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।এখানে নামায বলতে তারাবীহকে বুঝানো হয়েছে।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ রাকায়াত তারাবীহ পড়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন তার বর্ণিত হাদিসে,পরবর্তীতে হাদিস ব্যাখ্যাকারীরা আবু হুরায়রার হাদিসকে সবচাইতে নির্ভর যোগ্য বলেছেন।
হযরত সাঈব বিন য়্যাযিদ বলছেন, আমরা সাহাবীরা বিশ রাকায়াত তারাবীহ নামায পড়তে অভ্যস্ত হয়েছিলাম এবং খলিফা হযরত ওমর ইবনূল খাত্তাব-এর সময় থেকে সর্ব সম্মত ভাবেই বিশ রাকায়াত তারাবীহ পড়ার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়(এটা মিরক্কাত আল মাফাতিহ-আনোয়ারুল হাদিস গ্রন্থের ভলিয়ূম ২ এর পৃষ্ঠা ১৭৫ এ বর্ণিত হয়েছে)।
সাহাবী হযরত যাইয়দ ইবনে রুমান রাজিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, হযরত ওমর ইবনূল খাত্তাবের সময় থেকেই রমজানে ২৩ রাকায়াত(২০ রাকায়াত তারাবীহ,তিন রাকায়াত ভিতর নামায) প্রচলিত হয়ে আসছে,যা আমরা অভ্যস্ত ছিলাম।
একই রকম বিশ রাকায়াতের বর্ণনা আল্লামা আলা দীন আবু বকর ইবনে মাসুদ আল ক্কাসানী এবং বদর-আল-দীন এর ঊম্মাতুল ক্কারী গ্রন্থের হাদিসের বর্ণনাতে বিশ রাকায়াত তারাবি নামাযের কথা বলা হয়েছে,রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেফারেন্স থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।
ইমাম তিরমিদি বলেছেন তিনির তিরমিদি শরীফে চ্যাপ্টার ওরশীপিং নাইটস অফ দ্য রামাদান পৃষ্ঠা ৯৮ তে বলেছেন, মেজরিটি সকল স্কলার,খলিফা, ইমাম,হাদিস বয়ানকারী,সাহাবী রাজিয়াল্লাহু আনহু সকলেই একমত তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত। ঊমর-আল ফতোয়াতে হযরত আলী রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ অন্য সকল সাহাবী বিশ রাকায়াতের কথায় মতামত দিয়েছেন।ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক,ইমাম সূফিয়ান আল তাওহরী,ইমাম শাফি, সহ অন্য সকল ইমাম তারাবীহ বিশ রাকাত বলে অভিমত জোর দিয়ে উল্লেখ করে মতামত প্রদান করেছেন।
বাবুল ফেইথ ঈনায়া এ শরীয়াই নূক্কায়ায়হ ইমাম মোল্লা আল-ই- আল ক্কারী ইমাম বায়হাক্কীর অনুরূপ বিশ রাকাত তারাবীহ বলে মতামত দিয়েছেন,যেখানে তাদের মতে হযরত আবু বকর,হযরত ওমর,হযরত আলী,হযরত ওসমান রাজিয়াল্লাহু আনহুদের রেফারেন্স টেনে মতামত বর্ণিত হয়েছে।
একইভাবে তাতোয়াই মারাক্কাই আল ফতোয়া(পৃ-২২৪)বলা হয়েছে আমীরুল মো-মেনীন হযরত আবু বকর রাজিয়াল্লাহু আনহু বিশ রাকায়াত তারাবীহ পড়েছেন এবং সেভাবে সকলেই পড়েছেন,বিশ রাকায়াতের ব্যাপারে খলিফা নির্দেশ দিয়েছিলেন।
যেইয়ি আল দীন ইবনে নোজাইম আল মিসরী,ইমাম হানাফি,ইমাম শাফেই,ইমাম গাজ্জালী,ফতোয়াই আলমগীরী,ইবনে আবেদীন আল শামী, সহ অসংখ্য সাহাবী,ইমাম,ফতোয়ার গ্রন্থে তারাবীহ বিশ রাকায়াত বলে অভিমত দেওয়া হয়েছে।ফতোয়া আলমগীরীর সাথে ফতোয়াই সিরায়ায়াইতে ও একই কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হযরত ওমর ইবনূল খাত্তাব,হযরত ওবাঈব ইবনে ক্কায়াব একই মত দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছেন।(হাদিসের রেফারেন্স গ্রন্থ ফিক্কাহ আল মিল্লাত,হযরত আল্লামা মুফতি জালাল আদ দীন ,দিল্লী থেকে ২০০১ ১৪২১ হিজরি প্রকাশিত)।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত পড়া উত্তম । তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে রাত ব্যাপী দীর্ঘ লম্বা নামায পড়েছেন,রাসূলুল্লাহর সকল সাহাবী রাজিয়াল্লাহু আনহুগনও একই মত পোষণ করেছেন। যেহেতু কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহ নামাজ সুন্নতে নফল- সেজন্যে এতে বাড়াবাড়ি না করে কারো সময় থাকলে এবং স্বাস্থ্য ভালো থাকলে, সওয়াবের আশায় সুন্নতে নফল এবাদত বেশী বেশী করা রমজান মাসে উত্তম। শারিরীক অজুহাতে বা কাজের চাপে কেউ যদি নফল এবাদত এদিক সেদিক করেন, তাতে দোষের কিছু নেই।এতে কটুক্তি করাটাও উচিৎ নয়। আর একদিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতদের সুবিধার্থে)অর্থাৎ তিনি বলেছেন, তিনি তৃতীয় দিন আর ঘর থেকে বের হননি, তাতে তার আশঙ্কা যদি তিনি এভাবে আজও করেন, তাহলে উম্মতের জন্য বিশ রাকায়াত ফরজ হয়ে যাবে)বিশ রাকায়াত আদায় না করতে আসার অজুহাতে রেফারেন্স টেনে রাকায়াত ছোট বা বড় করার কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ নেই, যেহেতু তিনিও কারণ বলে গেছেন। আবার ওমর রাজিআল্লাহু আনহু করেছেন, বলে আমরা মানবোনা- এটাও যুক্তি সঙ্গত নয়। কারণ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পরে আমার একটি সুন্নত অথবা একজন সাহাবীকেও অনুসরন করলে আপনার জন্যে কামিয়াবী আখেরাতে।সুতরাং বিতর্ক সৃষ্টি না করে বরং রমজানের এই অফুরন্ত নেয়ামত, আর বিশেষ করে মাগফেরাতের এই দিনগুলোতে শুধু বিশ রাকায়াত নয়, আরো বেশী বেশী করে নফল এবাদত, কোরআন তেলাওয়াত, সদকা, খয়রাত, দ্বীনী কাজ বেশী করে করা উচিৎ, ভুল ত্রুটির জন্য আল্লাহর দরবারে মাফি চাওয়া উচিৎ …
চলবে..