অফুরন্ত ফজিলত ও নেয়ামতের মাস এই রমজান মাস-(০১)

অফুরন্ত ফজিলত ও নেয়ামতের মাস এই রমজান মাস-(০১)

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

মাহে রমজান মাসের ফজিলত নিয়ে কিছু কথা-
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

মাহে রামাদান বা রমজান মাস মুসলমানদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে এক বিশেষ রহমত স্বরূপ।কোরআন এবং হাদিসে এই রমজান শরীফ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান এবং প্রতিটি সক্ষম মুসলমান নর-নারীর উপর এই রোযা বা সিয়াম সাধনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে,সাথে সাথে এর অসংখ্য ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। এক রেওয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে,রোজাদারের পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ পাক তার বান্দাদেরকে প্রদান করবেন। অন্য এক হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে রোযা মুমিনের জন্য ঢাল স্বরূপ।

এই রমজান মাস আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার জন্য রহমত-বরকত-মাগফেরাত হিসেবে আভির্ভূত হয়ে থাকে।হাদিস শরীফে(সহীহ বোখারী,সহীহ তিরমিযি,ইমাম হাম্বলী,ইবনে ক্বাসীর,প্রভৃতি)বর্ণিত আছে, বিশেষ করে সাহাবী ক্কাআব বিন ঊজাইর রাজি আল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, একদা জুমআর খুৎবা প্রদানের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখেন,তখন বলেন আমীন,দ্বিতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখেন,তখন বলেন আমীন,তৃতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখেন,তখন বলেন,আমীন

নামায শেষে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এই তিনবার অস্বাভাবিক ধরনের আমীন,আমীন,আমীন বলার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,আমি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি,তখন জিব্রাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহী নিয়ে আসেন,বলেন,হালাক বা ধ্বংস হয়ে যাক, সেই সব ব্যক্তি,যে রমজান মাসের রোযা পেলো অথচ গুনাহ মাফ করাতে পারলোনা,এর জবাবে আমি বললাম আমীন।দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিব্রাইল বললেন,ধ্বংস হয়ে যাক,সেই সব,যার সামনে আমার নাম নেওয়া হলো অথচ দুরুদ শরীফ পড়লোনা,জবাবে বলেছি আমীন । তৃতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখলাম,জিব্রাইল বললেন,ধ্বংস হয়ে যাক,সেই সব যে বা যারা তার মা-বাবা কিংবা উভয়ের যেকোন একজনকে পেলো অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাত হাসিল করতে পারলোনা,জবাবে বলেছি আমীন।

প্রিয় পাঠক ভেবে দেখুন ফেরেশতাদের সর্দার জিব্রাইল আল্লাহর তরফ থেকে ওহী নিয়ে দোয়া করেছেন আর নবী-রসূলদের সর্দার,সারা বিশ্ব জাহানের জন্য রাহমাতুল লীল আলামীন,বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়ার জবাবে বলেছেন আমীন। আসমান-জমিন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে,কিন্তু আল্লাহর রসূলের আমীন কিছুতেই মিথ্যে হতে পারেনা।বলা যায় আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই দোয়াতে সীল বা মোহর মেরে দিয়েছেন। এই হাদিসের শুরুতেই বলা হয়েছে রমজান শরীফের কথা।রমজান মাস যখন শুরু হয়, তখন আল্লাহ পাক এই মাসের প্রথম রাতেই দশ লক্ষ বান্দাদের মাফ করে দেন,যাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে আছে, এমন সব গুনাহগারদের মাফ করে দেন,লাইলাতুর ক্কদরের রাতে অসংখ্য,অগণিত বান্দাদের মাফ করে দেন,আর শেষ ২৯ তারিখ রাতে সারা মাসের যত মাফ করা হয়েছে তার দ্বি-গুন, আর ঈদের রাতে আরো দ্বি-গুন বান্দাদের গুনাহ মাফ করে দেন বলে হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে।তবে কবিরা গুনাহের জন্য তওবা করে মাফি চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সাহাবী হযরত আবু হূরাইরা রাজি আল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, যে বা যারা পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশ্বাসের সাথে রমজান মাসে দিনের বেলা যাবতীয় পানাহর থেকে বিরত থাকবেন, রোযা রাখবেন, রাতের বেলা পরিপূর্ণ ঈমানের সাথে নামায পড়বেন, এবাদত-বন্দেগী করবেন, লাঈলাতুল-ক্কদরের রাতে জেগে এবাদত-বন্দেগী করবেন, আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লাহ বান্দার পেছনের সব গূণাহ মাফ করে দেবেন। ইমাম বোখারী, ইমাম মালিক, তিরমি্যি, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল,মুসলিম শরীফ, ইমাম আবু হাণিফা,আবু দাউদ, বায় হাক্কী, যোয়াব আল ঈমান সহ প্রভৃতি কিতাবের অধিকাংশ হাদিস ব্যাখ্যাকারীদের উদ্ধৃতিতে এই হাদিসের সত্যতা নির্ভুল ভাবে পাওয়া যায়।


হযরত আবু হোরায়রা রাজি আল্লাহু তাআলা আনহু আরো বর্ণনা করেছেন, রমজান মাসে বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে দোজখের দরজা যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়, একই সাথে সকল শয়তান ও জিনদের তালাবদ্দ্ব করে রাখা হয়।রমজানের প্রতিটি দিন ও রাতে অসংখ্য অগণিত বান্দাদেরকে আল্লাহ পাক দোজখের আজাব থেকে মাফ করে দিতে থাকেন।

এই রমজান মাসে কেউ একজন রোজাদারকে এক ফোটা দুধ বা পানি বা খেজুর দিয়ে ইফতার করালে আল্লাহ পাক তাকে দোযখের আযাব থেকে মাফ করে দিবেন, তাকে ঐ পরিমাণ রিওয়ার্ড দিয়ে ভূষিত করা হবে, আল্লাহ পাক তাকে বেহেশতের ফাউন্টেন বা কওসর থেকে পান করাবেন,যা কখনো সে তৃষ্ণার্ত হবেনা, এবং তা বেহেশতে প্রবেশ পর্যন্ত অনুভূত হবে।আবু হোরায়রা হতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মাগফেরাতের দোয়া রমযানের শেষ রাতে গ্রান্ট হয়েছে,সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলে ওটা লাইলাতুল ক্কদরের রাতে কিনা বললে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, না, কারণ আল্লাহ পাক তার বান্দার মজুরী রমজান পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই দিয়ে দেন।বলাই বাহুল্য হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নির্মল ও নেক শ্রেষ্ঠ নবী হওয়া সত্ত্বেও রমজানে আল্লাহর দরবারে এতো এবাদত বন্দেগী করেছেন, আর আমরাতো উনার উম্মত, আমাদেরও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বেশী- বেশী করে ইবাদত-বন্দেগী করা উচিৎ।

রমজান মাসের প্রতিটি সময়, প্রতিটি ক্ষণ অত্যন্ত মূল্যবান। অন্য যে কোন মাসে যেমন নির্দিষ্ট সময় বা শেষ রাতে বা তাহাজ্জুদের সময় বান্দার দোয়া কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু রমজান মাসে প্রতিটি সময় বান্দার দোয়া কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে।দিনে-রাতে আল্লাহ পাক তার রহমতের তজল্লী খুলে বান্দার নিকটবর্তী হয়ে গূণাহগার বান্দাদেরকে মাফ করে দিতে আছেন এবং তা চলতে থাকবে অনবরত একেবারে ঈদের রাত তথা জামায়াত পর্যন্ত।

এই রমজান মাসে শেষ দশ দিনের মধ্যে বেজোড় এক রাত লাঈলাতুল ক্কদরের রাত নামে কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যা হাজারো-লক্ষকোটি রাতের এবাদত বন্দেগীর চাইতে উত্তম রাত।লাঈলাতুল ক্কদরের রাতের ইবাদত বন্দেগীর অফুরন্ত ফজিলত বহু কিতাবে উলামায়ে কেরামবৃন্দ হাদিস শাস্র থেকে আলোকপাত করেছেন, তা আমরা সকলেই কম-বেশী জানি।একাগ্র চিত্তে এই রাতে এবাদত করলে বান্দার গোনাহ মাফ করে দেন আল্লাহ পাক।হাজারো রাত্রির এবাদতের চাইতে এই রাতের এবাদতের মর্যাদা সর্বোচ্চ, বলা যায়, আল্লাহ পাক রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লামের উম্মতদেরকে আগেকার নবী রসূলদের উম্মতদের তুলনায় একরাতের নফল এবাদতের সাথে তখনকার উম্মতদের শত-হাজারো বছরের এবাদত বন্দেগীর উপরে অধিক মর্যাদা দিয়েছেন।সূরা দোখান এবং সূরা ক্কদরের বর্ণনা থেকে এই রাতের বিশেষ মাহাত্ম্য প্রতিফলিত হয়।

এই রমজান মাসেই কোরআন শরীফ নাযেল হয়েছিলো।সুতরাং আমাদের সকলের উচিৎ রমজানে বেশী বেশী করে কোরআন তেলাওয়াত করা।যারা কোরআন পড়তে পারেননা তাদের উচিৎ হলো মসজিদ, মক্তবের বা মাদ্রাসার ইমাম সাহেবদের সাথে যোগাযোগ করে কোরআন তেলাওয়াত শিখে নেওয়া, এতে কোন দুষ নেই বরং অধিক সোওয়াব। যাদের হাতে সময় অল্প, বিভিন্ন প্রফেশনাল ও পারিবারিক কারণে ব্যাস্থ , তাদেরও উচিৎ অন্তত দিনে-রাতের কিছুটা সময় হলেও কোরআন তেলাওয়াত করা, একান্ত অপারগ হলে অন্তত সূরা ইয়াসিন, সূরা দোখান, সূরা মূলক, সূরা ক্কাহফ-এই সব ফজিলত ওয়ালা সূরা তেলাওয়াত করা।সূরা ইয়াসিনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র কোরআনের সারাংশ তথা কোরআনের হার্ট বলেছেন এবং তা তেলাওয়াতে মাগফিরাত লাভ হয়ে থাকে বলে উল্লেখিত আছে, একথা পাওয়া যায় মসনূদ ইমান,পৃষ্ঠা নং ২৮৬, ভলিউম-৭, হাদিস ২০৩২২- এ এই সূরা তেলাওয়াতের অসংখ্য সাক্ষাত ফজিলত রয়েছে।কোন পেরেশান ব্যক্তি যদি সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করেন, তবে সূরা তেলাওয়াতের শেষ হওয়ার আগেই ইনশাআল্লাহ তিনি এই সূরা তেলাওয়াতের ফললাভ করবেন,দেখা যাবে তার অনেক প্রশান্তি ফিরে এসেছে, এটা হাদিস শরীফে যেমন বর্ণিত হয়েছে, একইভাবে অনেকের বাস্তব জীবনেও তাই হয়েছে। সূরা দোখান রাতের বেলা তেলাওয়াত করলে আল্লাহ পাক বান্দার পেছনের গোনাহ মাফ করে দেন।জামে তিরমিযির পৃষ্ঠা নম্বর ৪০৬ এর ভলিউম নম্বর ০৪ এর ২৮৯৭ নম্বর হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কেউ সূরা দোখান যে কোন রাতের বেলা পড়লে ৭০,০০০ ফেরেশতা অনবরত তার মুক্তির জন্য দোয়া করতে থাকেন।একই কিতাবের ৪০৭ নম্বর পাতায় ২৮৯৮ নম্বর হাদিস থেকে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতের বেলা অর্থাৎ সোবে জুমা বারে এই সূরা তেলাওয়াত করলে আল্লাহ পাক বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন।

রমজান মাসে যেকোন এবাদতের দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে।অন্য যেকোন মাসের নফল এবাদতের চেয়ে রমজান মাসে এক রাকায়াত নফল এবাদতের ৭০ গুন সওয়াবের কথা হাদিসে বলা হয়েছে, অন্য যেকোন মাসের ফরজ এক রাকায়াতের ৭০০ গুন সওয়াব প্রদানের কথা বর্ণিত হয়েছে।কোন কোন রেওয়াতে এক রাকাতের বদলে ১৭০০ রাকাতের সওয়াবের উল্লেখ রয়েছে।সব চাইতে বড় কথা, স্বয়ং আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, রোযা আমারই জন্য, আর আমিই এর প্রতিদান দেবো। পবিত্র তিরমিয শরীফে সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা রাজি আল্লাহু তাআলা আনহূ হতে বর্ণিত আছে যে, রোজাদারের দোয়া আল্লাহ পাক কবুল করে থাকেন।আম্মাজান আয়েশা রাজিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা হতে বর্ণিত আছে যে, রমজান মাস এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে যেতো, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশী বেশী করে দোয়া করতেন, নামায, তেলাওয়াত করতেন বেশী বেশী করে।রমজান মাসের শেষ দশ দিন এতেকাফের বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, এর ফলে দুই হজ্জ্বের সওয়াব লাভ করা যায়।সব চাইতে বড় কথা হলো, এতেকাফের ফলে বান্দার ভাগ্যে লাইলাতুল কদরের মহিমান্বিত রজনী ভাগ্যে জুটে থাকে, যা হাজার বছরের রাতের এবাদতের চাইতে উত্তম,ফলে বান্দার গোনাহ আল্লাহ পাক মাফ করে দেন।

চলবে……….

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *