কিছুদিন আগে জাতি সংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো ফার্নান্দেজ বাংলাদেশে এসে আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দুই নেত্রী সহ উর্ধ্বতন সকল রাজনৈতিক, পেশাজীবী, ও সুশীল সমাজের দাবীদার অনেকের সাথেই সাক্ষাত করেছিলেন।তারানকোর বিদায়লগ্নে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক দন্ধ, সংঘাতের পথ পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে উভয় পক্ষ সমঝোতার পথে এগুবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। বলাবাহুল্য সেদিন তারানকোর সাথে বৈঠকের পর উভয় পক্ষ থেকেই জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বেশ আশাব্যঞ্জক বক্তব্য জাতিকে জানানো হয়েছিলো,সে সময় অনেকেই আশ্বস্থ হয়েছিলেন, এবার বুঝি সমঝোতার পথে বড় দুই দল এগুবে।
কিন্তু তারানকোর বিদায়ের পর রাজনৈতিক সংকট আরো ঘোলাটে যেমন হয়েছে, একই সাথে ক্ষমতাসীন মহাজোটের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চার চারটি ফ্রন্ট ওপেন সহ বেশ কিছু সংকটের জন্ম দিয়ে পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে ও ভয়ঙ্কর এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক পথের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন। এই যখন অবস্থা তখনো বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এবং এই নির্বাচন যদি হয়, তাহলে কি ভাবে বা কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চিত এক সংকট, যেখান থেকে বাংলাদেশের আগামীর রাজনীতির অস্থিতিশীল অবস্থার সূচনাই করবেনা শুধু, দেশ এক ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডঃ আতাউর রহমান টক শোতে খোলামেলা ভাবেই মত প্রকাশ করেছেন, ঠিক তার আগেই খোদ জাতি সংঘের মহাসচিব দুই নেত্রীর সাথে টেলিফোনে সরাসরি কথা বলে সংলাপের মতো গণতান্ত্রিক সমঝোতার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে মহাসচিব বান কি মুনের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং আমরা আশা করতে পারি দুই বড় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীর মধ্যে সংলাপের মতো গণতান্ত্রিক পন্থায় অগ্রসর হয়ে আমাদের দেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে যে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, তা থেকে সুন্দর এক পন্থায় জাতিকে জাতীয় সংসদের নির্বাচন উৎসব মুখর পরিস্থিতি করার উপহার দিবেন।
আমাদের রাজনৈতিক সংকট কতো গভীর ও ভয়াবহ এক আগামীর ইঙ্গিত দিচ্ছে, খোদ জাতি সংঘের মহাসচিবের মতো সর্বোচ্চ পদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও সরাসরি ফোনালাপ করে সংলাপের তাগিদ দিতে হয়েছে। বান কি মুনের এই ফোনালাপের তাগিদে এটাই প্রমাণ করে বিশ্ব এখন বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির সংকট নিয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন। কিন্তু যাদের জন্য এতো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সেই রাজনীতির কুশীলব তথা দুই রাজনৈতিক দলের দিকপালদের যেন এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হচ্ছেনা। বান কি মুনের সংলাপের সমঝোতার তাগিদের পরেও প্রধান বিরোধীদলের নেত্রী জোটের কঠিন কর্মসূচী থেকে সরে এসে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করলেও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী এবং মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্য মারমুখী এবং জেদি ও বিদ্বেষমূলক- যেন ডঃ পিয়াস করীম যেমন বলেছেন, বান কি মুনের একটি মাত্র টেলিফোনে সরকারের জ্ঞান চক্ষু খুলবে, এমন আশা করাটা ঠিক হবেনা। ঠিক তাই বলেই সভানেত্রী থেকে শুরু করে তার দপ্তর বিহীন মন্ত্রীও বলছেন, নির্বাচন হবে সংবিধান মোতাবেক। ভাল কথা, সংবিধান মোতাবেকই হবে, কিন্তু কোন সংবিধান, যে সংবিধানকে আপনারা কাটা-ছেড়া করে এই সংকটের জায়গায় নিয়ে এসেছেন, সেই সংবিধান মোতাবেক ? বাংলাদেশের ১৬/১৭ কোটি জনগণের কোন ম্যান্ডেট আছে বলেতো খোদ সভানেত্রী দাবী করতে পারবেননা ?
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে- এ নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে এবং সকল পক্ষকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছে, কি হতে চলেছে বা এই অসহনীয় অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কি- কোন পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে কোন কিছুই যেমন বলা হচ্ছেনা, বরং সেই সংকটময় পরিস্থিতিকে কি করে আরো উত্তপ্ত ও সংঘাতময় করে তুলা যায়- দায়িত্বশীলদের তরফ থেকে এই যখন অবস্থা দেখা যায়, তখন দেশ ও বিদেশের সকল স্বজন, বন্ধুদের ভাবিয়ে তুলে। বিরোধীদল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের অবস্থান বলা যায় অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার করেছে। সরকারও এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে বর্তমান সংশোধিত সংবিধানের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনে বদ্ধপরিকর। দুই দলের এই দুই ইগোতে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এহেন অনমনীয় অবস্থায় জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করবে- সেটা অনেক আগেই ডঃ পিয়াস করীম টক শোতে বলেছিলেন। মহাসচিব বান কি মুনের টেলিফোন আলাপের মধ্য দিয়ে জাতি সংঘের হস্তক্ষেপের মতো স্পেইস নেয়া অনেকটাই এখন পরিষ্কার । অথচ আমরা এবং এই নেতা-নেত্রীরা যদি একটুখানি উদার ও গণতান্ত্রিক হতেন, তাহলে নিজেদের এই সমস্যা নিজেরাই মিঠিয়ে ফেলতে পারতাম, যার অজস্র ভুরি ভুরি উদাহরণও নিকট অতীতে রয়েছে।
আওয়ামীলীগের মোহাম্মদ নাসিম আজকে বলেছেন, তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে উনারা সংসদ সদস্য পদও ছেড়েছিলেন। ধন্যবাদ নাসিমকে সত্য কথা বলার জন্যে। তাহলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন করতে বাধা কোথায় ? যেহেতু এখনো এখানে গণতান্ত্রিক ইন্সটিটিউশনগুলো শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো হয়নি, রাজনৈতিক অঙ্গনে একে অন্যের প্রতি এখনো যথেষ্ট বিশ্বাস ও আস্থার অভাব রয়েছে।
দেশের ভিতরে বৃহৎ জনগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে মার্কিনী ও ইউরোপীয়দের মধ্যে ডঃ মোহাম্মদ ইউনূসের ঈর্ষনীয় খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা ও আস্থা রয়েছে। একথাটি সরকারের নীতি-নির্ধারকরা স্বীকার করেন আর নাই করেন, আড়ালে-আবডালে ভালো করেই জানেন এবং বলেও থাকেন। দেশের এই ঘোলাটে ও আশু সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকেই ডঃ মোহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্ব এখন প্রকাশ্যেই বলেছেন, আগামী নির্বাচন অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতেই হবে। বিরাজমান বাস্তবতা ও কূটনৈতিকদের বিশেষত: মার্কিনী ও ইউরোপীয়দের লবিংযের প্রেক্ষিতে ডঃ মোহাম্মদ ইউনূসের এই আহ্বান বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ডঃ মোহাম্মদ ইউনূসের এই দাবীর কিংবা পরামর্শের অথবা তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের নসিহত যাই বলা হউক না কেন, বক্তব্যের পর পরই জাতি সংঘ মহাসচিবের স্পেস নিয়ে টেলিফোনে দুই নেত্রীর সাথে সমঝোতার পরামর্শ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান আশু সংঘাতময় অবস্থা থেকে উত্তরণের নয়া এক অবস্থা হিসেবেই পর্যবেক্ষকরা দেখছেন। যদিও ইতিমধ্যে মার্কিন কূটনীতিক মজীনা মহাসচিবের এই উদ্যোগের সফলতার ব্যাপারে অনেক আশাবাদী, তারপরেও চলমান রাজনৈতিক অবস্থা কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি মনে হচ্ছে।এই অবস্থায় দেশে বসছে আগামী মাসে সংসদ অধিবেশন। দুই বড় রাজনৈতিক দলের ভিতর সমঝোতার সদিচ্ছা থাকলে, আগামী মাসের এই অধিবেশনের মধ্যেই সংকট সমাধানের সূচনা করতে পারে। কিন্তু দুই বড় দলের অহেতুক ইগো আর অহমিকতা সমঝোতার মতো কোন পরিস্থিতির ইঙ্গিত করেনা।
ডঃ পিয়াস করীমের বিশ্লেষন আর জাতি সংঘ মহাসচিব যখন খালি স্পেস নিয়ে ঢুকেই পড়েছেন, এখানে যদি দুই নেত্রীকে সমঝোতার টেবিলে নিয়ে আসতে নতুন কোন ফর্মুলা নিয়ে আসেন, তবেই কেবল জাতি সংঘের উদ্যোগে সমঝোতার নতুন মাত্রা লাভ বৈ নতুন কোন আশাবাদ এখানে তিরোহিতই নয়, কাঙ্ক্ষিত কোন ফল এনে দিবে বলে মনে হচ্ছেনা। কেননা আমরাতো এখন নিজেকে ছাড়া আর কারো কথাই শুনতে অভ্যস্ত নই।
রাজনৈতিক অঙ্গনে কল্যাণকামী তৃতীয় কোন শক্তির অনুপস্থিতে দুই বড় রাজনৈতিক দল অনেকটা মনোপলি ব্যবসার মতো একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জেদি মনোভাব জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে চলেছে।এই তৃতীয় কোন রাজনৈতিক শক্তির অভাব কিংবা অনুপস্থিতিহেতু বিরাজমান সংঘাত থেকে আশু উত্তরণেরও কোন পথও খোলা রাখতে চাচ্ছেনা বর্তমানের জেদি ও অহংকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলো। কেননা এই শক্তিগুলো জানে, তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান বলা যতো সহজ, করাটা ততো কঠিন এবং বাস্তবতার নিরিখে আরো এভারেস্ট শৃংঘ জয়ীর মতো কঠিন। আর এই সুযোগের পূরণ সদ্ব্যবহার করে চলেছে ক্ষমতাসীন দল। কূটনৈতিক দূতিয়ালির চাপে কিংবা মার্কিন-ভারত-ইউরোপীয় লবীরসুবাধে বর্তমান সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ পদ-বিন্যাস ও ষ্ট্রাকচারের সুবিধাজনক সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের ফায়দা ঘরে তুলে ক্ষমতাসীন সরকার জানে ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস কেন্দ্রিক তৃতীয় লবি সেনা সমর্থন পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, আর জীবন বাজী রেখে, জীবনের উপর পুরোটা ঝুঁকি নিয়ে কেউ এখন আর ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস কিংবা ডঃ কামাল-ডাঃ বি চৌধুরী বা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভুমিকার বিশেষ কুশীলব সেই কথিত তাত্ত্বিক রাজনীতিক বয়সের ভারে ন্যুব্জ লম্বা শ্বেত-শ্মশ্রুমণ্ডিত দার্শনিক কতোটুকু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউনূস-কামাল-চৌধুরী লবিকে ক্ষমতার লাইম লাইটে নিয়ে আসতে উদ্যত হবেন, সেটাও এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আর রাজনৈতিক নেপথ্যের কুশীলব ও সুশৃঙ্খল সেই বাহিনীর সমর্থন বিহীন শুধুমাত্র কূটনৈতিক সমর্থন নিয়ে ইউনূস গং কতটুকু সফল হবেন সেটা নিয়েও রয়েছে সংশয়। আর এই সংশয়ের পেছনে ঘি ঢেলে দিয়ে খালি স্পেসের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত, যা দুই নেত্রীর জন্য অনেক মন্দের ভালো হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও ডঃ মোহাম্মদের ইউনূসের প্রকাশ্য অবস্থান চীন-ভারত-আমেরিকা আর খোদ জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানকেও অনেকটা ইউনূস কেন্দ্রিক আগ্রহের মাত্রায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসে ফসল ঘরে তুলতে সহায়ক বৈ বিমাতাসূলভ আচরণ যে হবেনা, তাতে অনেকেই একমত। এখন শুধু দেখার বিষয়, আমাদের ঘরের রাজনৈতিক সমস্যা এখন বিশ্ব পরিমণ্ডলের আবহে পরিগ্রহ লাভ করে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়- তা দেখার জন্য আমাদেরকে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই।
২৫শে আগস্ট ২০১৩ .