বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নতুন নতুন শক্তির অভ্যূদয়ঃ নতুন নেতৃত্ব কোথায় ?
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ এক অহিংস আন্দোলনের নায়ক মহাত্মা গান্ধীকে চেনেননা বা তার কাজ ও কর্মের সাথে পরিচিত নন-এমন লোক পাওয়া মুস্কিল হবে। মহাত্মা গান্ধী সাতটি সামাজিক পাপ পরিহার করার জন্য তার জনগণকে বলেছিলেন। আর তাহলো:
- নীতিহীন রাজনীতি পরিহার
- নৈতিকতাহীন বাণিজ্য পরিহার
- শ্রমহীন সম্পদ পরিহার
- চরিত্রহীন শিক্ষা পরিহার
- মানবতাহীন বিজ্ঞান পরিহার
- বিবেকবর্জিত আনন্দ পরিহার
- ত্যাগহীন অর্চনা পরিহার
বলা বাহুল্য, এই সাতটি সামাজিক পাপ বা অপরাধ আজকের আমাদের এই বাংলাদেশে এতো বেশী লালিত ও পালিত, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে হয়ে আসছে যে, এর বাইরে আমরা কেউই মুক্ত নই।
আমাদের এখনকার রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বলতে গেলে সর্বক্ষেত্রেই এক অসম্ভব নীতিহীন কর্মকাণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত যে, যে যত বেশী নীতিহীন, বিবেকবর্জিত কাজ করতে পারঙ্গম, সে ততোবেশী নামী-দামী। আর এ কথাটি সমাজের একেবারে উপর তলা থেকে প্রশাসনের সর্বস্তরে সমানভাবে বিদ্যমান।
আর এই নীতিহীন, বিবেক বর্জিত আর চরিত্র বিধবংসী রাজনৈতিক ঢামাডোলের সুযোগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থায় একের পর এক নানা শক্তি ও স্তরের অভ্যুদয় ঘটে গেছে, যা ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদলের সাজানো রাজনৈতিক বাগানে অনেক অতিথি নয়, বরং নানান রঙের নানান শক্তির উন্মত্ত প্রদর্শনে তাদের সাজানো সুন্দর বাগান তছ-নছ করে দিয়ে উদয় হয়েছে। আরো কিছু শক্তি ও শ্রেণীর অভ্যুদয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। নতুন রাজনৈতিক শক্তি হেফাজতে ইসলাম সম্প্রতি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে রাজধানীর শাপলা চত্বরে যে সমাবেশ করলো, জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক মিডিয়া সিএনএন, আল জাজিরা, বিবিসি তাদের এই সমাবেশকে বাংলাদেশের স্মরণকালিন ইতিহাসে সবচাইতে স্বতঃস্ফূর্ত বৃহৎ ইসলামী শক্তির সমাবেশ হিসেবে মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। হেফাজতের এই অভ্যুদয় যে হবে এবং ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে ইসলাম, আল্লাহ-রসূল (সা:) কে নিয়ে যেভাবে কতিপয় অতি আধুনিক লোকের ফ্যাশনের পোশাক পরিবর্তনের মতো বেলেল্লাপনা ভাবে কটাক্ষ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য প্রকাশিত হচ্ছিলো- এহেন পরিস্থিতিতে হেফাজত কেন, যেকোন কলাগাছের ন্যায় সাচ্চা মুসলমান ডাক দিলে মানুষ দলবেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতো, তাতো কোন সন্দেহ নেই। একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ, অর্বাচীন নেতৃত্বদের দ্বারা ঢালাওভাবে ইসলামের, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমালোচনা- পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজিত করে তুলে। সরকার সেখানে শুরুতে কুম্ভকর্ণের ন্যায় নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছিলো, ঠনক নড়লো তখন, যখন সব কিছু অনেকদূর এগিয়ে হেফাজতের মতো নতুন ইসলামিক শক্তির অভ্যুদয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ও জানান দিয়েদিলো। হেফাজতে ইসলামের যখন পূর্ণ অভ্যুদয় হয়ে গেছে, শাপলাচত্বরের সমাবেশের সাজ-সাজ রব পড়ে গেছে, তখনি সরকার গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের বার্তা শাহবাগে জ্বালিয়ে হেফাজতে সাথে গান্ধী প্রদর্শিত পাপ পরিহারের বদলে ধোঁকা আর নীতিহীন চাল চালাতে গিয়ে গোটা বাংলাদেশকে একদিন আগে থেকেই অবরুদ্ধ করে, জনজীবনে দূর্বিসহ মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে হেফাজতের রাজনৈতিক ইসলামিক শক্তির অভ্যুদয়ে নতুন মাত্রা আরোপ করে মাত্র।
হেফাজতের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের পর, তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে এখন দেশে চলছে গরম আলোচনা। আজকের গ্লোবাল বিশ্বের প্রেক্ষাপটে হেফাজতের বেশ কিছু দাবি যে কোনভাবেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, সেটা হেফাজত বুঝে কিনা জানিনা, কিন্তু আল্লাহ-রসূল এবং ধর্ম নিয়ে কটাক্ষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনতা- সে আওয়ামীলীগ, বিএনপি,জাসদ,জাতীয়পার্টি,জামায়াত-যেই হউক না কেন, সকলেই যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমর্থন দিবেন বা দিতেছেন তাতো সকলের কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। কারণ মুসলমান মাত্রই আল্লাহ-রসূলের অপমান কিছুতেই সহ্য করবেনা।
আর এই সুযোগে হেফাজতের বিপরীতে যে শক্তিগুলো রয়েছেন, ভোটের রাজনীতিতে তারা কেউই এখন পর্যন্ত তেমন কোন ক্রেডিবিলিটি দেশ ও জাতির কাছে উপস্থাপন বা প্রতীয়মান হয়েছে বলে কারো কাছে দৃশ্যমান নয়। সুতরাং ভোটের রাজনীতির হিসেব-নিকেশে ঐ শক্তিগুলো হেফাজতের বিপরীতের প্লাট ফর্ম বেশ শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে নিজেদের অবস্থান খুব নেতিবাচক রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন, সরকারের সকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এবং ফোর্সকেও ব্যবহারের মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করবেননা তাতো বুঝাই যায়।
আর নারী অধিকার সংক্রান্ত হেফাজতের ঐ দাবি নারী সমাজকে যে বিক্ষুব্ধ করেছে বা করবে- সরকার তা আগে থেকে ভালো করেই উপলব্ধি করেই আজকের বিক্ষুব্ধ পরিবেশটাকে ভোটের রাজনীতিতে আরো একধাপ নিজেদের অনুকূলে নিয়ে রাজনৈতিক চাল খেলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, তা অনেকটাই বলাই বাহুল্য। হেফাজতের নারী সমাজের অবজ্ঞা আর অবহেলার দাবী নিয়ে আজকের সারা বাংলাদেশের নারী সমাজ বলা যায় এতোই বিক্ষুব্ধ যে, নারী সমাজের সকল সংগঠনকে করে তুলেছে আন্দোলনমুখী এবং হেফাজতের সাথে সাংঘর্ষিক এক সমান্তরাল শক্তির অভ্যুদয়ের নতুন এক ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে- যা বাংলাদেশের আগামী রাজনীতি-অর্থনীতির গতি-পথকে অনেকটাই নতুন এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
কিন্তু আশংকা থেকে যায়, হেফাজতের সকল দাবিকে অতি-প্রগতিশীলতার চাপে বা প্রকাশ্যে পেছনে ফেলে দিলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে হেফাজত নামক এই নয়া শক্তি যে অনেক ওলোট-পালট এবং অঘটন ঘটিয়ে দিবে- তা এখনি যেমন অনুমান করা যায়, আবার সাধারণ জনগণ এখনি হেফাজত সহ সকল নতুন নতুন শক্তিকে চটিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল- আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য শুভও হবেনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক আসিফ নজরুল সহ অনেকেই একই মত পোষণ করেন। আর এক্ষেত্রে কবি, লেখক, সাংবাদিক, দক্ষ আমলা সাযযাদ কাদির সবচাইতে সুন্দর এবং একই সাথে যথার্থই বলেছেন, এক চোখা নীতি নিয়ে দেশ ও জনগণকে এগিয়ে নেয়া যায়না। আর ইসলামকে গালি না দিয়েও আধুনিক হওয়া যায়।ছোট করে হলেও সাযযাদ কাদির লক্ষ-কোটি বাঙালির মনের কথাই বলেছেন। কে কিভাবে নেন সেটা তার নিজের ব্যাপার, কিন্তু সাযযাদ কাদির বেশ সার্থকভাবে সংক্ষেপে অথচ দৃঢ়তার সাথে সঠিক কথাটাই তুলে ধরেছেন। আবার সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী বিবিসি বাংলার সাথে অকপটেই স্বীকার করেছেন, অভিমত প্রকাশ করেছেন, আগামীতে হেফাজত নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আভির্ভুত হবে। প্রথিতযশা সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরীর এই অভিমত, আজকের বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে নতুন এক বার্তা হিসেবেই প্রতিভাত হয়, একথা অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক একমত পোষণ করেন।
আজকে বাংলাদেশের দম বন্ধ হওয়া এই অসহিঞ্চু রাজনৈতিক পরিবেশে আরো অনেক নতুন নতুন শক্তির যে অভ্যুদয় হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। ২০১৩ শাহবাগের জাগরণ মঞ্চ- যা তরুণদের দ্বারা নতুন এক বাংলার জাগরণ ঘটিয়েছে, তাকে যদি বাংলাদেশ ধারণ করতে সম্ভব না হয়, তবে এখান থেকেই আরো কিছু শক্তির জন্ম হবে অবশ্যই। রুমী স্কোয়াডের আমরণ অনশন সেকথাই বলে দেয়।
বাংলাদেশ প্রস্তুত হউক বা না হউক, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারণ ক্ষমতার বাইরে এবং অবশ্যই বুঝে উঠার আগেই এখনকার বাংলাদেশে আরো নতুন নতুন শক্তির উদয় হবে, এটা দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়। সমাজ বিকাশের নতুন নতুন সম্ভাবনাকে বিকশিত করে তোলার জন্য পুরনো বিজাতীয় শক্তির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের ঐতিহ্য নিয়েই বাঙালি জাতির জন্ম। স্বাধীনতা যুদ্ধে উপনিবেশিক স্বৈরাচারী শক্তিকে পরাভূত করে বাঙালি জাতি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে। গত ৪০ বছর ধরে এ দেশের নেতৃবৃন্দ জাতির উর্ধমুখী আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই জনগণ আজ হতাশ ও বিক্ষুব্ধ।রাজনৈতিক দলগুলো দেউলিয়া ও দিশেহারা। এখন জাতি চায় এমন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী-যা শান্তি দেবে, সংহতি দেবে, উন্নয়ন আর প্রগতির নতুন যুগের সূচনা করবে।কিন্তু এক্ষেত্রে উপনিবেশিক ধাঁচের রাজনৈতিক দলগুলি ব্যর্থ ও অক্ষম।
আবার বলা যায়, বাঙালির জীবনে দু`বার জাগরণ এসেছিলো; বাংলার ইতিহাস থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাঙালি চতুর্থ জাগরণের ( আরেক অর্থে চতুর্থ জাগরণ এই কারণে যে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে নতুন এক ইউনিক জাগরণ সৃষ্টি করেছে, তারই বিপরীতে চট্টগ্রাম থেকে হেফাজতের মতো ইসলামি জাগরণ অভ্যুদয় এবং তাকে কেন্দ্র করে সম্মিলিত নারী সমাজের একীভূত হয়ে প্রতিবাদী জাগরণ – যা বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর সুসংহত এবং আজকের বিশ্ব-প্রেক্ষাপটের সাথে যুগোপযোগী নারী শক্তি) ধাপ অতিক্রম করছে। অন্যভাবে বলা যায় বাঙালি তাই চতুর্থ জাগরণের পর্যায়ে রয়েছে।
এখানে বিশেষ করে উল্লেখ না করলেই নয়, “ ষোড়শ খ্রিষ্টাব্দে শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও বৈষ্ণব ধর্ম, অপরদিকে মুসলিম সুলতানদের রাজত্বকাল ইসলামী সংস্কৃতির প্রসার উভয়ই বাঙালি জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলো। প্রথম জাগরণের এ সময়কালের মুসলিম সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ( ১৪৯৩-১৫১৯)।“
“পরবর্তী উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এবং ইউরোপীয় দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবে বাংলা দ্বিতীয় বারের মতো নব জাগরণ-এর আলো দেখতে পেলো। একেই বলা হয় উন-বিংশ শতাব্দীর বেঙ্গল রেনেসাঁ- যা দ্বিতীয় জাগরণ হিসেবে পরিচিত।“
এই দুই জাগরণ ছিলও ক্ষণস্থায়ী। তা হওয়াটাই স্বাভাবিক । কেননা এই জাগরণের উন্মেষ ঘটেছিলো কেবলমাত্র নাগরিক সমাজের উঁচু শ্রেণীর মধ্যে এবং সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিলও। আমরা জানি, যে কোন সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন স্থায়িত্ব পায় তখনই, যখন তা সমাজের প্রতিটি শ্রেণী এবং পর্যায়কে ছুঁয়ে যায়।
“পাশ্চাত্য দেশের পণ্ডিতদের ধারণা ছিলও ষোড়শ এবং উনবিংশ শতাব্দীর সেই দুই জাগরণের পর বাঙালি আর কখনো একক সত্ত্বা ফিরে পাবেনা। তারা হয়তো পাকিস্তানী বাঙালি কিংবা ভারতীয় বাঙালি হয়ে পরিচিত থাকবে। তাই বাংলাদেশের জন্মক্ষণ পর্যন্ত বাংলা এবং বাঙালি ছিলও তাদের কাছে এক বিস্মৃতির পর্যায়ে চলে যাওয়া জাতির পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন স্বরূপ।“
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সেই ধারণা ভেঙ্গে দিলো। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এ এক বিশাল অর্জন।
বাঙালি সেই তৃতীয় জাগরণের পর্যায় অতিক্রম করে প্রজন্ম চত্বরের জাগরণের মধ্য দিয়ে শাহবাগের এই নয়া জাগরণ আমাদেরকে বাঙালির এই চতুর্থ জাগরণের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে , আর এই জাগরণ পূর্ববর্তী তিনটি জাগরণ থেকে ভিন্ন ধরনের। এই জাগরণে বাঙালির রাজনীতি ও সমাজের ভিত্তিমূলে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করে দিয়েছে।
কিন্তু এই পরিবর্তিত নয়া জাগরণের সূচনায় হাল ধরার জন্য নেতৃত্ব কোথায় ? এই নয়া জাগরণের অভ্যুদয়ের পূর্বে নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে মাহমুদর রহমান মান্না, ১০ দফা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে আ স ম আবদুর রব, জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ডঃ কামাল হোসেন, ডাঃ বি চৌধুরী, বাঙালির জীবনে নয়া পরিবর্তনের কথা বলে কাদের সিদ্দিকী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, কিংবা যারা সমাজের এই ঊর্ধ্বমুখী নতুন নতুন চাহিদার পক্ষে কথা বলেন, দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা বলেন- তারা আজ কোথায় ? অবশ্য আ স ম আবদুর রব কে ধন্যবাদ এই কারণে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছেন, গতকাল পত্রিকায় দেখলাম জনগণের প্রাণের কথাটাই তার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে। বের হওয়ারই কথা, পরিবর্তনের কথা, নয়া আন্দোলনের কথা- কেবল মাত্র আ স ম আবদুর রবের জবানিতেই মানায়। এক সময় জীবন বাজি রেখে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তানী শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, ৭২ সালে যুদ্ধ বিধবস্থ বাংলাদেশে যুব সমাজকে সাথে নিয়ে বাঙালি জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন, মাজখানে জীবন-জীবিকা আর বিরুদ্ধ-প্রতিরুদ্ধ সময়ের প্রেক্ষিতে যাই ঘটে থাকুক, জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে নেতৃত্বের হাল সে বা কাউকে না কাউকে তো ধরতে হবে। বাংলাদেশে নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় হয়ে যাচ্ছে, অথচ যারা সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ও জাতীয় ঐক্যের কথা বলেন, তারা যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন মনে হয়। কেননা, আজকের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নিজেদের অজান্তেই অনেক নতুন নতুন বিরোধী শক্তি তৈরি করে ফেলেছে, তা যেমন ঘর থেকে বাইর পর্যন্ত সমানভাবেই প্রযোজ্য। আবার আওয়ামীলীগের সীমাহীন ব্যর্থতা, দুর্নীতি, লুট-পাট, হলমার্ক-ডেস্টিনি-শেয়ার বাজার আর পদ্মার মতো বৃহৎ কেলেঙ্কারি আর ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের সীমাহীন মারামারি,কাটাকাটিতে জনগণ নতুন প্ল্যাটফর্ম খুঁজছে ( জাগরণ মঞ্চ আর শাপলা চত্বর আর এখনকার নারী সমাজের প্রতিবাদে জনতার অংশগ্রহণ), আবার আওয়ামীলীগের বিপরীতে বিএনপির অতীত দুর্নীতি আর অতি জামায়াত-জঙ্গি ঘেঁষা অবস্থার কথা মনে করে জনগণ শিউরে উঠে, তাই বিএনপিকে তাদের ভরসাস্থল হিসেবে খুব একটা তারা দেখতে বা মেনে নিতে পারেনা। আর পারেনা বলেই সাধারণ ছিঁচকে ও ঠুনকো অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সহ স্থায়ী ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সকল নেতৃবৃন্দকে একসাথে কারাগারে নিক্ষেপে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে ভয়ংকর ও ব্যতিক্রম এই গ্রেপ্তারী অবস্থায় তেমন কোনপ্রতিবাদ-বিক্ষোভ না হওয়াতে সে কথাই বলে দেয়। জনগণ নতুন প্ল্যাট ফর্ম খুঁজছে, কিন্তু হেফাজতের মতো প্ল্যাট-ফর্ম ও নয়। কিন্তু নেতৃত্বের যথাযথ অভাবের ফলে জনগণ এই সব দিকে ঝুঁকা ছাড়া বিকল্প কিছু দেখছেনা।
আমাদের এই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ এবং প্রতিনিয়ত খৈ ফুটিয়ে চলেন রাজনৈতিক নেতৃত্বসমূহ এবং এই বাংলাদেশ নতুন নতুন শক্তির ঊর্ধ্বমুখী এই সব চাহিদাকে ধারণ ও লালন এবং বাস্তবায়নে, আগামীর সাথে এখনকার সমন্বয় করে, সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে কতটুকু প্রস্তুত বা পারেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। কেননা ব্যর্থতা আর নেতৃত্ব শুন্যতার ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আর হানাহানি ও বিশৃঙ্খলার পথই শুধু তৈরি করবেনা, স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিবে, যা আমাদের অস্তিত্বের জন্যও হুমকি হয়ে দেখা দিবে- আমরা কেউই তা চাইনা।
10th April 2013.UK