সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ- লন্ডন
শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে শোক সহানুভূতি জানাতে গুলশানের কার্যালয়ে গেলেন, কোন প্রটোকলের ব্যত্যয়ের চিন্তা করেননি। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো উদ্যোগ, রাষ্ট্রনায়কোচিত এই সিদ্ধান্তের জন্য শেখ হাসিনা যেকোন বিচারে ধন্যবাদ পাওয়ার দাবী রাখেন। আর শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার এই দেখা না দেখাকে কেন্দ্র করে কোন রাজনীতি হওয়াটা কোনভাবেই সমীচীন নয়। খালেদা জিয়া ছেলে হারিয়েছেন, শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন ছেলে হারানো মাকে সান্ত্বনা দিতে। শোকার্ত খালেদা জিয়ার পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা তিনিও দুই- দুই বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ছেলে হারানোর যন্ত্রণা ও বেদনায় খালেদা জিয়া পাগলের মতো থাকবেন, বেদনাহত বা ভগ্ন হ্রদয়ে ক্ষত- বিক্ষত হয়ে জ্ঞান হারাবেন অথবা রাজনৈতিক রোষানলের অতীতের তিক্ততার কথা শোকের এই মাতমের সময়ে স্মৃতির পাতায় ভিড় করতেই পারে বা আশে পাশের কুশীলবরা সেই দুঃসহ স্মৃতিকে জাগিয়ে দিতেই পারেন- এরকম বিচিত্র নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু যত রাজনৈতিক তিক্ততা, যয় বিতন্ডা থাকুক, কিংবা অতীতে হাজারো দুঃসহ স্মৃতি এই প্রধানমন্ত্রীর কারণে হয়েই থাকুক, একজন শোকার্ত মাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য রাষ্ট্রের একজন সর্বোচ্চ কর্তা যখন যান, তখন কে সেই ব্যক্তি সেটা বিবেচনা করা হয়না, বরং বিবেচনায় সর্বাগ্রে যে বিষয়টি স্থান পায়, সেটা হলো অমুক রাষ্ট্রের প্রধান বা সরকার প্রধানই প্রাধান্য পায়। আর ঘোষণা দিয়ে একজন রাষ্ট্রীয় প্রধানই শুধু নয়, একজন মাও গিয়েছিলেন- শোকার্ত খালেদা জিয়া অসুস্থ বা ঘুমের ইনজেকশনে অচেতন ছিলেন, কিন্তু দুই মিনিট পরে যে অফিস স্টাফ বা গেট কিপার এসে গেট খুলে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে পারলেন, সেই গেট কিপার বা অফিসের স্টাফরা মাত্র দুমিনিট আগেও কি সৌজন্যতার খাতিরে দরজা না খুললেও একজন অতিথির শোকের বার্তা নিয়ে এসেছেন- সেটা দেখভাল করা কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো ? বিএনপির পক্ষে একজন লোকও কি গেটের কাছে এসে সাধারণ সৌজন্যতা প্রকাশ করা যেতোনা ? কারণ ঐ সময় গুলশানের গেটে যারা ছিলেন, তারা টেলিফোনে জানিয়েছেন, ভিতরে লোক ছিলো- দেখা গেছে এবং কোথায় যেন ফিসফাস মনে হচ্ছিলো, প্রধানমন্ত্রী ভিতরে গেলে শোকার্ত খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা- দুজনের মধ্যে যে হ্রদ্যতার দৃশ্য জমে উঠতো- বাংলাদেশের শান্তি ও জনগনের জান মালের নিরাপত্তা যারা চাননা, তারাই তথাকথিত ঘুমের ইনজেকশনের ধুয়া তুলে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছেন। এদের মতো দুই দলের এই মধ্যপন্থীরাই দুজনের মাঝখানে বিশাল পাহাড় দাড় করিয়ে দিয়েছে- যা বাংলাদেশের সাধারণ নিরীহ জনগণ তাদের জীবনের বিনিময়ে প্রতিমুহুর্তে খেসারত দিতেছে।
এখানে কারো ভুল আর শুদ্ধ নিয়ে বিশ্লেষণ বা ভালো মন্দ বিচার্য করা হচ্ছেনা। কারণ আমাদের জনগনের মন-মানসিকতা এমনভাবে বিভাজিত ও বিভক্ত যে একজনের সমালোচনা বা একজনের ভালো কাজের প্রশংসা করলেই আপনাকে চিহ্নিত করে বসবে আপনি অমুকের দালাল বা অমুক দলের লোক। আর এসব তারাই প্রচার করে সর্বাগ্রে- কারণ সে নিজেই তল্পীবাহক হয়ে আছে, অতএব আরো একজনকেও তার মতো না বানাতে পারলে তার পেটের ভাত হজম হয়না। সেটা শিক্ষিত অশিক্ষিত, জ্ঞানী পাপী সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কেননা এই সব শ্রেণী দুই দলের অন্ধ সমর্থক হয়ে আছে। সে কোরআনকে কিংবা আদর্শ জ্ঞানকে অথবা তার সঠিক বিবেক বুদ্ধিকে তার বাছ বিচার করতে, জীবনের পাথেয় মনে না করে দুই দল আর দুই নেত্রীকে ভাগ্য বিধাতা মনে করে বসে আছে। সেজন্যেই নিরপেক্ষভাবে ভালো মন্দ বিচারের ক্ষমতা আমাদের সমাজ সংসার রাজনীতিতে লোপ পেয়ে গেছে।
বিএনপির অতি জ্ঞানী নেতারা খালেদা জিয়ার আশে পাশে থেকে খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে যেমন ডুবাচ্ছেন, যেমন ঢুবাচ্ছেন লন্ডনে তারেক রহমানের ভিতর বাহিরের বিভিন্ন শ্রেণীর কমিটি আর নেতারা, তেমনি শেখ হাসিনার আশে পাশের অতি বুদ্ধিমান অহংকারী নেতারাও হাসিনাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অতি লৌহ এক মানবী রূপে তুলছেন। এই দুই-তিন শ্রেণীর বিশিষ্ট ক্ষমতা লোভী পাপীরা মৌসুমী পাখির ন্যায় দুই দলে সমানভাবে সক্রিয়- এরা ঠিকই সুযোগ বুঝে কেটে পড়তেও ওস্তাদ।
বিএনপি বার বার ভুল করে, ভুল থেকে কখনো শেখার ইচ্ছে করেনা। শেখ হাসিনার সাথে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতে ( কোন কথা না হলেও) আপাতঃ দৃষ্টিতে হাসিনার লাভ মনে হলেও রাজনীতির সূক্ষ্ম এবং মানবিক বিচারে খালেদা জিয়া ও বিএনপিই লাভবান হতো। হাসিনার সরকার খালেদা জিয়ার প্রতি এতো ঝুলুম অত্যাচারের পরে শোকার্ত অবস্থায় অতিথি এবং একজন মাকে নিজ কার্যালয়ে, যেখানে তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন, সেখানে সাক্ষাত করে জাতির সামনে ম্যাসেজ সঠিকভাবেই তুলে ধরতে সক্ষম হতেন- নিষ্ঠুর আচরণের পরেও মহানুভবতায় খালেদা জিয়া বাংলাদেশের হাজারো সংবেদনশীল মনের মানুষের মতোই। কারণ খালেদা জিয়ার পলিসি মেকার বা গেট কিপারদের কেউ যদি শেখ হাসিনাকে রিসিভ করে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিতেন, সেটাও বিএনপির জন্যে ভালো হতো। অপরদিকে লাখো বিএনপির নেতা কর্মীদের নিপীড়ন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার নেগোসিয়েশনের সরাসরি পথ উন্মুক্ত হয়ে যেতো। তাছাড়া গোটা বাংলাদেশের অসহনীয় অবস্থার ড্রামাটিক এক পরিবর্তন এসে যেতো। বিশ্ব নেতাদের কাছেও সেটাই হতো অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তা না করে গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়া- বিদেশী সরকার প্রধানদের কাছে নেগেটিভ ম্যাসেজের জন্য বিএনপি ও খালেদা জিয়া প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়েই থাকার নতুন সুযোগ করে দিলেন, যা আদৌ সঠিক হলো কিনা আগামীর রাজনীতি সেটাই বলে দিবে ।
24th January 2015, London