সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ- লন্ডন থেকে
সারা বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের শীর্ষ স্থান দখল করে আছে ব্রিটেনের এই লন্ডন শহর। লন্ডন শুধু বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রের মধ্যেই নয়, বরং ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর মিলনের এক মধ্যমণি হয়ে আছে। লন্ডনকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের নামী দামী বহু রাজনীতিবিদ, সমাজবিদ, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এমনকি বিপ্লবী রাজনীতির প্রকাশ্য এবং নেপথ্যের নায়কদের কলকাঠি নাড়ার এক তীর্থ স্থান হয়ে আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য-ডাক্তার-পথ্য সেবা নানাবিধ ক্ষেত্রে অভাবনীয় এক উন্নতি যেমন করছে, একইভাবে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এর জুড়ি মেলা ভার। এই লন্ডনেই প্রবাসী সরকারের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অনেকদিন ছিলেন- যেখান থেকে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বীকৃতির জন্য দেন দরবার করতে পেরেছিলেন। এই লন্ডন হয়েই বঙ্গবন্ধু বিশেষ ব্যবস্থায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
এই লন্ডনেই থাকতেন একসময়ের বঙ্গবন্ধুর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি, লন্ডনের বর্ষীয়ান সাংবাদিক, লেখক আমিনুল হক বাদশা। গত রাত ১১.৩০ মিনিটে (লন্ডন সময়) লন্ডনের অর্পিংটন হাসপাতালে দীর্ঘদিন রোগভোগের পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। খবরটি লন্ডনে বিদ্যুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা মিডিয়া অঙ্গন সহ প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া এবং শোকের ছায়া নেমে আসে। বাদশাভাই বেশ কিছুদিন ধরে এই অর্পিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার লেখনী চিন্তা, ভাবনার মধ্যে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাই প্রকাশ পেতে। বাদশা ভাইয়ের লেখনীতে নিজের অজান্তেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ফুটে উঠতো। যখন সুস্থ্যছিলেন, জিজ্ঞেস করলে স্বীকারও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সংগঠনটি অত্যন্ত গোপনে এবং এর নেপথ্যের যারা কারিগর ছিলেন, যারা বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম এক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃতি লাভ করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে- আর সেই সব ঘটনার পরিকল্পণা, বাস্তবায়নকারীদের নেপথ্যরে সংগঠন নিউক্লিয়াস এবং সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, শেখ মণি- এদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু যেমন ছিলেন, তাদের সাথে মিলে কাজ করার দুর্লভ সৌভাগ্য ও গৌরবের অধিকারী ছিলেন বাদশা।
আমিনুল হক বাদশা যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন অসুস্থ অবস্থায়ও বন্ধুত্বের অগাধ টান ও ভালোবাসায় ছুটে আসেন সিরাজুল আলম খান। সে সময় সাথে ছিলাম বলেই সেই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। অথচ আমিনুল হক বাদশা সারা জীবন যে রাজনীতি ও আদর্শের প্রচার করে গেলেন, সেই আওয়ামীলীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের কাছে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে হয়ে পড়লেন অবহেলিত, উপেক্ষিত। রাজনৈতিক মতাদর্শে সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়া সত্যেও আমিনুল হক বাদশার জীবন সায়াহ্নে সিরাজুল আলম খান অসুস্থ হ্নদয়ে বঙ্গবন্ধুর এই কলম সৈনিককে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সহানুভূতি জানাতে কার্পণ্য করেননা অথচ বঙ্গবন্ধুর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারিকে বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও পরিবার জীবন সায়াহ্নের শেষ ভালবাসা টুকু দিতে কার্পন্য করলেন ।
বাদশা ভাই যখন গুরুতর অসুস্থ, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরে আসলে পত্র পত্রিকা এবং আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে আমিনুল হক বাদশা ভাইকে এক নজর হাসপাতালে দেখে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আশা ছিলো বঙ্গবন্ধুর কন্যা হাজারো ব্যস্ততা সত্যেও বাদশা ভাইকে একনজর দেখে যাবেন। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে যে লোকটির, সারা জীবন যে বঙ্গবন্ধুর কলম সৈনিক হয়ে কাজ করে জীবন পার করে দিলো- জীবনের শেষ সময়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা কিংবা আওয়ামীলীগের কাছ থেকে এক ফুটো ভালোবাসার কণা টুকুও পেলোনা- কি বিচিত্র এই রাজনীতি, কি বিচিত্র এই সেল্যুকাস।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিরাচরিত ব্যবস্থার ফলেই শেখ হাসিনা পাছে বেঁকে বসেন বা নেত্রীর আস্থা-ভাজন হারান, রোষানলে পড়ার ভয়ে লন্ডনের আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরাও তাই তাদের কলম সৈনিককে জীবনের শেষ সায়াহ্নে প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সহানুভূতি দিতে ভয় পেয়ে যান বা বঞ্চিত করেন। হায়রে দলীয় রাজনীতি! হায়রে নেতা-নেত্রীর প্রতি ভক্তি!
জীবনের শেষ সময়টুকু আমিনুল হক বাদশা পেতে পারতেন সরকারের ও সরকারী দলের অকৃত্রিম অগাধ ভালোবাসা আর সহানুভূতি। তাতে খুব একটা খরচ বা সময়ের অপচয় হতোনা। বাদশা ভাইয়ের পরিবার ও স্বজনেরা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেতেন।
একই চিত্র আমরা দেখেছিলাম- আব্দুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রেও । বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন কঠিন বিপদের সময় বঙ্গবন্ধুর পাশে যারা ভ্যানগার্ডের ন্যায় দাঁড়িয়েছিলেন- সেই আব্দুর রাজ্জাককেও লন্ডনের হাসপাতালে জীবনের শেষ সময়টুকু অত্যন্ত অসহায় আর নিদারুণ অর্থাভাবে তিলে তিলে বড় অভিমানে নেতা কর্মী শুন্য অবস্থায়, বড় একেলা, নিষ্ঠুরভাবে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো। সেদিনের অবস্থা যারা দেখেছিলেন, যেন আব্দুর রাজ্জাক এক অস্পৃশ্য, কিংবা ছোঁয়াচে কোন মারাত্মক এক রোগী- যারা সান্নিধ্যে কিংবা দেখার জন্য আওয়ামীলীগের লাখো নেতা কর্মী থাকা সত্যেও কেউ প্রকাশ্যে আসার সাহস পায়নি- কারণ আব্দুর রাজ্জাকও আমিনুল হক বাদশার মতো শেখ হাসিনার নিজস্ব গুড বুকের মধ্যে ছিলেননা। পাছে নেত্রী অখুশী হন- তাই শেষ দেখাটুকুও তারা দেখতে আসেননি। যে দু-একজন এসেছিলেন লুকিয়ে- যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে আব্দুর রাজ্জাককে দেখতে তারা এসেছিলেন। হায়রে রাজনীতি, হায়রে মানবতা! এই কি আদর্শ, এই কি মহানুভবতা? দলীয় নেতা কর্মীর সামান্য ভুলের খেসারত মৃত্যু নামক অনিবার্য অবস্থাও নেতা কর্মী আর হাইকমান্ডের কাছে সহানুভূতি পায়না, গুড বুক নামক লিস্টের খাতায় কিছুক্ষণের জন্যও স্থান পায়না- মৃত্যুও চরম বাধা হয়ে দাঁড়ায়- ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। সেদিনও আব্দুর রাজ্জাকের প্রিয় বন্ধু সিরাজুল আলম খান রাজনৈতিক চরম বিরোধ থাকা সত্যেও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, দেখে গিয়েছিলেন প্রিয় সহকর্মীকে। বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি দুটি ভিন্ন বিপরীতমুখী রাজনৈতিক আদর্শ।
আব্দুর রাজ্জাক মৃত্যুর পরে যেভাবে আওয়ামীলীগের সহানুভূতি পেয়েছিলেন, তেমনি আমিনুল হক বাদশাও মৃত্যুর পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতির শোক বানী পেয়েছেন। আরো কিছু সহানুভূতি পাবেন, পুরো দলীয় ভালোবাসায় সিক্ত হবেন সন্দেহ নাই। কিন্তু সেই দলীয় ভালোবাসা কি পৌছবে আমিনুল হক বাদশার কাছে, হ্নদয়ে, কর্ণ-কোহরে- আওয়ামীলীগের লাখো কোটি নেতা কর্মী আর আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বলতে পারবেন ? বাদশা ভাই, রাজ্জাক ভাই কি এখনো শেখ হাসিনার গুড বুকের বাইরে অবস্থান করছেন কিনা- জানতে বড় সাধ জাগে।
প্রিয় বাদশা ভাই- আল্লাহ পাক তোমাকে জান্নাতবাসী করুন- এই আমাদের মিলিত প্রার্থনা।
10th February 2015, London